নিখোঁজদের পরিবারে মাতম দেশ ছাড়ছে দালালরা

এরা ভাগ্য বদলাতে অবৈধ পথেই কক্সবাজারের
চকরিয়া থেকে মালয়েশিয়া যাত্রা করেছিলেন।
দীর্ঘদিন নিখোঁজ। এদের পরিবারে এখন শুধু কান্না
দালাল চক্রের প্রলোভন আর প্রতারণায় ফাঁদে পড়ে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় বাংলাদেশের বিভিন্ন বয়সের শত শত মানুষ মালয়েশিয়ার পথে পাড়ি দিয়ে এখন নিরুদ্দেশ, নিখোঁজ। তাদের পরিবারে এখন কান্নার রোল। এ মাসের প্রথমদিকে থাইল্যান্ডে অভিবাসীদের গণকবর আবিষ্কার এবং দুদিন আগে মালয়েশিয়ায় গণকবর আবিষ্কারের খবরে পরিবারগুলোতে শুধুই মাতম। এদিকে গ্রেফতার ও জনরোষ এড়াড়ে মানব পাচারকারীদের গা ঢাকা দিয়েছে। অনেকে বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। আবার অনেকে দেশ ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
কক্সবাজার : ২০১৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বরের কথা। কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালী তেলখোলা গ্রামের হে কুমার চাকমা, ছপাইংগ্যা, কিনডু চাকমা, মংতেছ রাখাইন প্রতিদিনের মতো গিয়েছিল পার্শ্ববর্তী উপকূলীয় এলাকায় পোনা আহরণে। তখন স্থানীয় কয়েকজন মানব পাচারকারী তাদের জোর করে একটি নৌকায় তুলে দেয়। তাদের বর্তমান অবস্থান থাইল্যান্ডের পুলছোয়ান কারাগার। তাদের মতো করুণ পরিণতি হয়েছে উখিয়ার বড় ইনানী গ্রামের আবুল মনসুরের কপালে। তিনি জানান, স্থানীয় ডেইলপাড়ার দালাল শামশু আড়াই লাখ টাকা চুক্তিতে তার ছেলে ইমরানকে মালয়েশিয়ায় পাচারকারীদের হাতে তুলে দিয়েছে। এখনও ছেলের মুখ দেখার আশায় দিন কাটাচ্ছেন মনসুর ও তার পরিবারের সদস্যরা। এভাবে শুধু কক্সবাজার থেকে নিখোঁজ রয়েছে ৫ সহস্রাধিক মানুষ।
চকরিয়ায় মানব পাচারকারী দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে ২০১২ সালের পর চলতি বছর পর্যন্ত সাগরপথে অবৈধ পন্থায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বপ্নের মালয়েশিয়া ফাঁড়ি দিয়েছেন অন্তত পাঁচ শতাধিক নানা বয়সের মানুষ। এরই মধ্যে চার শতাধিক মানুষ সেই দেশে পৌঁছে দালাল চক্রের টাকা পরিশোধ করে কাজে যোগ দিলেও এখনও নিখোঁজ রয়েছে অন্তত শতাধিক মানুষ। মালয়েশিয়া পৌঁছার পর পরিবারের লোকজনের সঙ্গে ওই সময় কেউ কেউ মুঠোফোনে যোগাযোগ করলেও এখন হদিস নেই অনেকের। এ অবস্থায় নিখোঁজ এসব মানুষের পরিবারে চলছে শোকের মাতম। অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলার খুটাখালী ইউনিয়ন থেকে বেশির ভাগ মানুষ মালয়েশিয়া গেছেন। জানতে চাইলে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বলেন, বিগত সময়ে নানা কায়দায় তার ইউনিয়ন থেকে অন্তত তিন শতাধিক মানুষ মালয়েশিয়া গেছেন। তার মধ্যে নিখোঁজের সংখ্যা ৩০ থেকে ৫০ জনের মতো। উপজেলার উপকূলীয় অঞ্চলের সমুদ্র চ্যানেল হয়ে বিগত কয়েক বছর ধরে অন্তত সাতটি পয়েন্ট দিয়ে এসব মানব পাচারের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় চকরিয়া থানায় ইতোমধ্যে বেশ কটি মামলা হলেও পুলিশ দু’জন ছাড়া বেশির ভাগ মানব পাচারকারীকে শনাক্ত কিংবা গ্রেফতার করতে পারেনি।
গণকবরের সন্ধানের খবরে সর্বত্র মাতম : সম্প্রতি থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে গণকবরের সন্ধান লাভ এবং সর্বশেষ সোমবার পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় নতুন করে আরও ১৩৯টি কবরের সন্ধান লাভ ও ২৮টি বন্দিশিবিরের সন্ধান পাওয়ার খবরে নিখোঁজ স্বজনদের মাঝে দেখা দিয়েছে শোকের মাতম। কক্সবাজার জেলার যেসব এলাকা থেকে প্রলোভনে পড়ে কিংবা নিজ ইচ্ছায় মালয়েশিয়ায় সোনার হরিণ ধরতে গিয়ে যুবকরা নিখোঁজ রয়েছে সেসব এলাকায় স্বজনদের আহাজারিতে এলাকার বাতাস ভারি উঠেছে।
উধাও মানব পাচারকারীরা : মানব পাচারের বিষয়টি আলোচিত হয়ে ওঠার পর পুলিশ-বিজিবি-কোস্টগার্ড-র‌্যাবসহ আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তৎপর হয়ে উঠার পর থেকে গা ঢাকা দিয়েছে মানব পাচারকারীরা। সম্প্রতি জেলার টেকনাফ ও সদরে ছয়জন শীর্ষ মানব পাচারকারী ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার পর পাচারকারীদের অনেকেই ট্রলারে করে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করেছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। তাছাড়া অনেক পাচারকারী ঢাকা-চট্টগ্রাম হয়ে বৈধ পথেই মধ্যপ্রাচ্যর বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমানোর অপেক্ষায় রয়েছে।
চুনারুঘাটের ২৫ যুবকের হদিস নেই : হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থেকে প্রতিনিধি জানান, উপজেলার গাজীপুর ইউনিয়নের পাচার হওয়া ২৫ যুবকের কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের মোটা অংকের টাকার লোভ দেখিয়ে বিভিন্ন সময়ে মালয়েশিয়া পাচার করা হয়েছিল। তাদের পরিবারগুলোতে এখন চলছে শোকের মাতম। স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ার পথে বের হলেও আজও তারা নিরুদ্দেশ।
যে ২৫ জনের খোঁজ নেই তারা হলেন- গাজীপুর ইউনিয়নের টেকেরঘাট গ্রামের সুলেমান মিয়ার পুত্র আবদুল বাছির (২১), সুন্দর আলীর পুত্র জামাল (২৫), বাল্লা গ্রামের মরফত উল্লাহর পুত্র মতলিব মিয়া (৩৫), আশরাফ উল্লাহর পুত্র সেলু মিয়া (২১), জমির আলীর পুত্র লাভলু মিয়া, গোবরখলা গ্রামের মজিবুর রহমানের পুত্র মোজাম্মেল হক (২১), খেলু মিয়ার পুত্র গাজীপুর হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাসকৃত রাসেল মিয়া, আঞ্জব আলীর পুত্র গাজীপুর হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস মুকতাজিল, দিলু মিয়ার পুত্র জসিম (২২), দিঘীরপাড় গ্রামের আবদুল হাইয়ের পুত্র জসিম (২৫), গাজীপুর ইউনিয়নের আলীনগর গ্রামের ময়না মিয়া (২৩), বড়জুস গ্রামের সাইফুল মিয়া (২১) উল্লেযোগ্য। তারা দালালের খপ্পরে পড়ে উচ্চাবিলাস ও দ্রুত বড়লোক হওয়ার আশায় মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমায়। তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে এখন পর্যন্ত কেউ জানতে পারেননি।
এদিকে ১৯ মে হবিগঞ্জে মানব পাচার অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাইফুল ইসলাম দুলাল নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেছেন উপজেলার বগাডুবি গ্রামের সাব্বির খানের কন্যা শিউলি আক্তার। তাকে একই গ্রামের সাইফুল ইসলাম দুলাল নামে এক ব্যক্তি পাচারের চেষ্টা করেছিল।
উল্লাপাড়ায় নিখোঁজ ৭ : উল্লাপাড়া প্রতিনিধি জানান, মানব পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার সলপ ইউনিয়নের ৭ যুবক তিন মাস ধরে নিখোঁজ রয়েছে। পার্শ^বর্তী বেলকুচি উপজেলার সাতলাঠি গ্রামের মানব পাচারকারী দালাল জালাল উদ্দিন ও রমজান আলী ওই যুবকদের বিদেশে পাঠানোর নাম করে বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। এরপর যুবকদের অভিভাবকদের কাছ থেকে ২ লাখ করে টাকা হাতিয়ে নেয় দালালরা। গত তিন মাস ধরে ওই যুবকদের কোনো খোঁজ না পেয়ে তাদের স্বজনরা জামালের মোবাইল নম্বরে (০১৭৩০-৮৪৬৮১৩) যোগাযোগ করা হলে ওই নম্বরটি বন্ধ পাচ্ছে।
শার্শার নিখোঁজ ১৩ : বেনাপোল প্রতিনিধি জানান, দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেলেও বিভিন্ন সময় নদীপথে মালয়েশিয়ায় যাওয়া যশোরের শার্শার ১৩ যুবকের খোঁজ আজও মেলেনি। এসব যুবকের পরিবারে এখন শুধুই কান্নার রোল।
স্থানীয় দালাল চান্দালীর ছেলে আকবার ও সামসুর রহমানের ছেলে শুকুর আলীর প্রতারণার ফাঁদে পড়ে বিত্তিবাড়ি পোতা গ্রামের রবিউল ইসলামের ছেলে জামাল হোসেন, আয়ুব আলীর ছেলে মোহর আলী, মুজিবুর রহমানের ছেলে মুনসুর আলী ও নজরুল ইসলাম, নারানপুর গ্রামের সামসুর রহমানের ছেলে তানা, বলিদাহ গ্রামের জাহান আলীর ছেলে মোকলেস আলী, শার্শার পান্তাপাড়া গ্রামের আবদুল খালেকের ছেলে ইকলাস হোসেন, গঙ্গানন্দপুর গ্রামের সামাদ আলীর ছেলে শরিফুল ইসলাম, ইদ্রিস আলীর ছেলে মেহেদী হাসান, আতিয়ারের ছেলে রাসেল হোসেনসহ ১৩ যুবক। তারা মালয়েশিয়ার উদ্দেশে রওনা হয়ে আর ফিরে আসেনি। এখন তারা কোথায় কি অবস্থায় আছে তাও জানেন না কেউ।

No comments

Powered by Blogger.