মানুষ বেচে কোটিপতি by রাসেল চৌধুরী

ওরা কারবারি। মানুষ নিয়েই কারবার তাদের। মানুষ বেচাকেনা করে সংসার চালায়। কোটিপতি হয়। কিন্তু যাদের নিয়ে তাদের কারবার সেই মানুষ যে বিভীষিকার অতল গহ্বরে পড়ে নিঃশেষ হচ্ছে সেদিকে তাদের খেয়াল নেই। আর খেয়াল করার দরকারও নেই। কারণ, মানুষ তাদের কাছে পণ্য। মানুষকে পণ্য করেই তারা বানাচ্ছে অট্টালিকা। আয়েশি জীবন তাদের। এমনই একজন টেকনাফ পৌর এলাকার মধ্যম জালিয়াপাড়ার বাসিন্দা জাফর আলম ওরফে টিটি জাফর। বয়স ৪৫। তাকে সবাই চেনে মানব পাচারের সূচনা পুরুষ হিসেবে। মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া পর্যন্ত তার নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। মানব পাচারের সুবিধার জন্য ভাড়ায় একাধিক ট্রলার নিয়েছেন তিনি। মানব পাচার করে রাতারাতি কোটিপতি তিনি। উখিয়া উপজেলার জালিয়াপালং ইউনিয়নের পাইন্নাসিয়া গ্রামে দুই বছর আগে এসে জায়গা কিনে বসতি করেন সানাহ উল্লাহ (৪০)। ঝুপড়িঘরসহ ভিটে কিনে তিনি এখন ওই এলাকার আলোচিত ব্যক্তি। রাতারাতি অনেক টাকার মালিক। ঝুপড়ি ঘর এখন আলিশান প্রাসাদ। শুধু তিনি নন, তাকে ঘিরে অসংখ্য ব্যক্তি এখন কোটি টাকার মালিক। কিভাবে এলো এতো টাকা? মানব পাচার করেই তিনি রাতারাতি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এ পর্যন্ত মানব পাচারবিরোধী অভিযানে অনেক চুনোপুটি ধরা পড়লেও সানাহ উল্লাহরা রয়েছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
আদম পাচার কাজে জড়িত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত আরেক শীর্ষ মানব পাচারকারী কোটিপতি ফয়েজ। উখিয়া সদর স্টেশনের পশ্চিম পাশে রয়েছে একটি বিলাসবহুল বাড়ি। জালিয়াপালং ইউনিয়নের মনখালী এবং জুম্মাপাড়ায় রয়েছে আরো ২টি বিলাস বহুল বাড়ি। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে নামে-বেনামে রয়েছে কোটি কোটি টাকার জায়গা জমি। এত অপকর্ম করার পরও তিনিও অদ্যাবধি অধরা। জাফর, ফয়েজ, সানা উল্লার মতোই অল্প সময়ের ব্যবধানে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে মানব পাচারকারী শতাধিক গডফাদার-দালাল। ইতিমধ্যে ‘ক্রসফায়ারে’ মারা যাওয়া ধলু হোসেন, নুর আহাম্মদও বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক ছিলেন। তাদের পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজনরাও রাতারাতি কোটিপতি বনে গেছেন।
টেকনাফ থেকে কক্সবাজার আসার পথে লেদা এলাকায় মূল সড়ক ঘেঁষেই সুরম্য অট্টালিকা তৈরি করেছেন ‘ক্রসফায়ারে’ মারা যাওয়া ইয়াবা ব্যবসায়ী নুর আহাম্মদের ভাই নুরুল হুদা। মাত্র তিন বছর আগেও তিনি ছিলেন ট্রাকের হেলপার। ইয়াবা ব্যবসা ও মানব পাচারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এখন তিনি কোটিপতি। মন্ত্রণালয়ের তালিকায় নাম থাকার কারণে আপাতত গা-ঢাকা দিয়েছেন চোরাকারবারি নুরুল হুদা।
মানব পাচার বিরোধী অভিযানে এ পর্যন্ত ৬ জন মানব পাচারকারী নিহত ও অর্ধশতাধিক আটক হয়েছেন। কিন্তু জাফর, সানাহ উল্লাহ, ফয়েজের মতো সাগরপথে মানবপাচারকারী চক্রের বড় একটি অংশ এখনও রয়েছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
মানব পাচার প্রতিরোধে কর্মরত স্থানীয় এনজিও সংস্থা হেলপের নির্বাহী পরিচালক এম আবুল কাশেম বলেন, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত উখিয়া-টেকনাফে উপকূলীয় বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানের প্রায় ৫০ হাজারের অধিক লোকজন মালয়েশিয়া পাড়ি দিয়েছে। এর মধ্যে অনেকেরই সমুদ্রে সলিল সমাধি হয়েছে বলে জেনেছি। কিছু লোক থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়ার জেলে বন্দি অবস্থায় মানবেতর দিন যাপন করছে।
এ ব্যাপারে উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ জহিরুল ইসলাম খান বলেন, মানব পাচারকারীদের গ্রেপ্তারে পুলিশ সার্বক্ষণিক তৎপর। রাত-দিন পাচারকারীদের বাড়িঘরে অভিযান চালানো হচ্ছে। তবে তারা আত্মগোপনে থাকার কারণে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হচ্ছে না।
পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও কোস্টগার্ডের পাশাপাশি স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার মূল ঘাঁটি টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ। এছাড়া পাচারের রুট হিসেবে কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়া, ফিশারিঘাট, নাজিরারটেক, সমিতিপাড়া,  কলাতলী, মাঝিরঘাট, সদর উপজেলার ঈদগাহ, খুরুশকুল, চৌফলদন্ডী, পিএমখালী, রামু উপজেলার হিমছড়ি, দরিয়ানগর, পেচারদ্বীপ, মহেশখালী উপজেলার সোনাদিয়া, গোরকঘাটা, কুতুবজোম ও ধলঘাটা।
উখিয়ার সোনারপাড়ার মানবপাচার প্রতিরোধ কমিটির সদস্য সচিব আবদুল হামিদ জানান, উখিয়ার সোনারপাড়ার বাদামতলীঘাট, রুস্তম আলীঘাট,  রেজুনদী, ইনানী, ছেপটখালী, মনখালী, শফিরবিল পাচারের নিরাপদ রাস্তা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এখনও এখানে পাচারের কাজে ব্যবহৃত ট্রলারগুলো রয়েছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহমেদ জানান, কক্সবাজারের উপকূলীয় অঞ্চলের ৪৫টি পয়েন্টকে মানব পাচারকারী বিভিন্ন চক্র ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করে। জেলার সাড়ে চার শতাধিক পাচারকারীকে ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান চলছে।

No comments

Powered by Blogger.