ঘরে-বাইরে কোথাও নারীরা নিরাপদ নয়

বাইরে কিংবা অন্দরমহলে নারী এমনকি মেয়েশিশুরাও এখন অহরহ যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এখন আর কোথাও নারীরা নিরাপদ নয়। নতুন করে গণপরিবহনে নারী ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। পুলিশ অধিকাংশ ধর্ষণের ঘটনারই আসামি ধরতে পারছে না। বাস্তবায়ন হচ্ছে না হাইকোর্টের নির্দেশনাও। সর্বক্ষেত্রেই অবহেলা ও উদাসীনতার একটি সুস্পষ্ট চিত্র ফুটে উঠেছে। গত ৬ মাসে শুধু গণপরিবহনে কমপক্ষে ১৫ জন নারী ধর্ষণ বা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বৃহস্পতিবার রাতে খোদ রাজধানীতে এক গারো তরুণীকে জোর করে মাইক্রোবাসে তুলে চলন্ত অবস্থায় গণধর্ষণ করা হয়। এমন অবস্থায় রাজধানীসহ সারা দেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীসহ কর্মজীবী নারীদের মধ্যে নতুন করে আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। মহিলারা এখন গণপরিবহনে উঠতেও ভয় পাচ্ছেন। এক ধরনের অজানা আতংক এবং নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে সর্বত্র। এ প্রসঙ্গে নারী নেত্রীরা প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, পুলিশের উদাসীনতা ক্ষমার অযোগ্য। রাষ্ট্রও এর দায়িত্ব এড়াতে পারে না। পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থায় নারীরা এখনও সেই মধ্যযুগীয় বর্বরতার শিকার হচ্ছেন, যা আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তিকেও প্রশ্নের সম্মুখীন করছে। সরকারকে অবশ্যই এর বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক জরিপ থেকে জানা যায়, গত ৬ মাসে দেশে শুধু গণপরিবহনে ১৫ জন নারী ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। জরিপে উল্লেখ করা হয়, ১১ মে রাতে রাজধানীর অদূরে সোনারগাঁর আড়াইহাজারে চলন্ত বাসে এক নারী শ্রমিককে বাস ড্রাইভার ও সহকারীসহ চারজন মিলে গণধর্ষণ করে। ১৩ মে ময়মনসিংহের চুরখাই এলাকায় বাসের চালক ও সহকারী মিলে এক তরুণীকে ধর্ষণের চেষ্টা চালায়। ৩ মে আশুলিয়ার বাস কাউন্টারে ট্রাংক থেকে এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিশ জানায়, ওই তরুণীকে ধর্ষণের পর ট্রাংকের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। ১ মে চট্টগ্রামে ঈগল পরিবহনের বাস থেকে লাগেজ ভর্তি তরুণীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ, ১৯ এপ্রিল ঢাকা থেকে জামালপুরগামী ট্রেনে এক নারী যাত্রীকে ২-৩ বখাটে শারীরিক নির্যাতন করে। ২৫ এপ্রিল রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় এক গৃহবধূকে মাইক্রোবাসে নির্যাতন চালিয়ে ওই মাইক্রোবাসেই চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়। ৩০ এপ্রিল দুপুরে টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরে চলন্ত শ্যালো নৌকায় দু’বোনকে হাত-পা বেঁধে গণধর্ষণ করে নৌকার মাঝিসহ একদল বখাটে। ২১ মার্চ বাগেরহাটের রামপাল এলাকায় চলন্ত নৌকায় গণধর্ষণ করা হয় এক গৃহবধূকে। ৮ ডিসেম্বর কুমিল্লা রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় পরিত্যক্ত বগিতে এক তরুণীকে গণধর্ষণ করে দুর্বৃত্তরা। ২৪ ডিসেম্বর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ড এলাকায় চলন্ত প্রাইভেট কার থামিয়ে দুই তরুণীকে গণধর্ষণ করে ছিনতাইকারীরা। ১ মার্চ গোপালগঞ্জ সদরের ভেন্নাবাড়ী এলাকায় এক মেয়েশিশুকে মাইক্রোবাসে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়।
এদিকে জাতিসংঘের হিসাব মতে, সারা পৃথিবীতে প্রতি তিনজনের একজন নারী জীবনকালে ঘরে-বাইরে কিংবা গণপরিবহনে ধর্ষণ বা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষের মধ্যে এই হিসাবে নির্যাতিত নারীর সংখ্যা শত কোটি ছাড়িয়ে যাবে। টানা নির্যাতন, ধর্ষণসহ নানান অপবাদ সহ্য করতে না পেরে মেয়েশিশু থেকে শুরু করে নানা বয়সী মহিলা ব্যাপকহারে আÍহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। নারী উন্নয়ন নিয়ে কাজ করছেন এমন বেশ কয়েকটি সংস্থা সূত্রে জানা যায়, নারী নীতি, যৌতুক নিরোধ আইন, গার্হস্থ্য শ্রমের স্বীকৃতি, গৃহশ্রমিকের অধিকার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় আইন ও নীতিমালা কার্যকর করার ঘাটতি আছে। তাদের অভিযোগ নারী ও মেয়েশিশু অধিকার প্রতিষ্ঠা, নির্যাতনবিরোধী সচেতনতা বৃদ্ধি করতে ও আইন কার্যকর করতে সরকারি উদাসীনতা সীমাহীন। ২০১৩ সালে ১৯ হাজার ৬০১টি নারী-মেয়েশিশু নির্যাতনের মামলা হলেও বিচার শেষ হয়নি একটিরও। এরই মধ্যে ২০১৪ সালে নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছে আরও ২১ হাজার ২৯১টি। গত বছর ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ২ হাজার ৯৫১টি অভিযোগ গ্রহণ করা হয়েছে, যা বিগত কয়েক বছরের তুলনায় সর্বাধিক। কিন্তু এসব অভিযোগের একটিরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি ২০০৮ সালের ৭ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণপরিবহনে এবং কর্মস্থলে নারী ও শিশুদের প্রতি যৌন হয়রানি প্রতিরোধের দিকনির্দেশনা চেয়ে একটি রিট (রিট পিটিশন নং ৫৯১৬/২০০৮) দায়ের করেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ১৪ মে হাইকোর্ট সব কর্মক্ষেত্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি, বেসরকারি, আধাসরকারি অফিস এবং সব ধরনের প্রতিষ্ঠান ও গণপরিবহনে নারীর প্রতি যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ১২টি দিকনির্দেশনা প্রদান করে। যার কোনোটিই এখনও পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ নিয়ম পালন করেননি।
ইউএন উইমেন প্রকাশিত এক জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, গত বছর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ৭৬ শতাংশ ছাত্রীই কোনো না কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হন। পাবলিক বা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি আরও খারাপ। যেখানে যৌন হয়রানির হার ৮৭ শতাংশ। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৬ শতাংশ, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোতে ৭৬ শতাংশ, মেডিকেল কলেজগুলোতে ৫৪ শতাংশ শিক্ষার্থী যৌন হয়রানির শিকার। জরিপ অনুযায়ী ৫৩ শতাংশ ছাত্রী যৌন হয়রানির কারণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন।
নারী নেত্রীদেও ক্ষোভ ও অভিযোগ : এ প্রসঙ্গে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি জানান, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সামাজিকভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে অপরাধীদের সামাজিকভাবে চিহ্নিত করে আইনের হাতে সোপর্দ করতে হবে। তিনি বলেন, নারীদের সম্মান রক্ষায় কেবল নারীরাই নয়, সম্মিলিতভাবে পুরুষদেরও এগিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, গণপরিবহনে নারী ধর্ষণ কিংবা যৌন নির্যাতন কোনোভাবেই কাম্য নয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নারী নির্যাতনকারীদের ধরতে বদ্ধপরিকর। বৃহস্পতিবার রাতে গারো তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনায় অপরাধীদের যে কোনো মূলে গ্রেফতার করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, নারী নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে সোচ্চার হতে হবে।
জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, সমিতি ২০১০ সালে আরও একটি রিট পিটিশন দায়ের করে যার পরিপ্রেক্ষিত্রে হাইকোর্ট ২৫ জানুয়ারি ২০১১ সালে হাইকোর্ট যেসব নির্দেশনা জারি করে তা হল- . প্রতিটি পুলিশ স্টেশনে যৌন হয়রানি সংক্রান্ত অভিযোগ গ্রহণের জন্য পৃথক সেল থাকবে . সব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য স্থানে যেখানে নারীদের অংশগ্রহণ থাকে সেখানে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে ৩. উপরোক্ত সেল জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটিকে এ উদ্দেশ্যে রিপোর্ট পেশ করবে। এসব নির্দেশের কোনোটাই যথাযথ হচ্ছে না। তিনি বলেন, দেশে যেহারে নারী নির্যাতন বাড়ছে, একই সঙ্গে গণপরিবহনের নারী ধর্ষণ নির্যাতনের ঘটনা দেশের মানুষের মধ্যে আতংক সৃষ্টি হচ্ছে। বিচারহীনতার কারণেই নারী নির্যাতনকারীরা বীরদর্পে নারীর প্রতি সহিংসতা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশ পুলিশ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে প্রায় ৫ হাজার নারী ও মেয়েশিশু নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এসব সহিংসতার মধ্যে রয়েছে, এডিস নিক্ষেপ, অপহরণ, ধর্ষণ, ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যা, পাচার, খুন এবং যৌতুকের জন্য নির্যাতন। কিন্তু এসব নির্যাতনের অভিযোগের মধ্যে কতগুলোর বিচার হয়েছে তার কোনো প্রতিবেদন কখনোই প্রকাশ করা হয়নি। ফলে নারী নির্যাতনের ঘটনার অধিকাংশই থানায় নথিভুক্ত বা আদালতে মামলা হয় না। সে কারণে নির্যাতনের প্রকৃত সংখ্যাটি আরও অনেক বেশি, যা দ্বিগুণের মতো। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অপরাধী বিচারের ঊর্ধ্বে থেকে যায়, তাদের যথাযথ বিচারের আওতায় আনা হয় না।
দেশে নারী নির্যাতন এবং ন্যায়বিচারের প্রশ্নটি প্রচণ্ডভাবে উপেক্ষিত জানিয়ে মানবাধিকার নেত্রী অ্যাডভোকেট এলিনা খান যুগান্তরকে জানান, দেশে ঘরে-বাইরে তথা গণপরিবহনে নারী নির্যাতন চলছেই। আর প্রতিরোধকারী সংস্থার পুলিশরা যেন এসব ন্যক্কারজনক কাজ চেয়ে চেয়ে দেখছেন। চুরি-ডাকাতিসহ বেশ কিছু ঘটনায় আসামি ধরার সফলতা থাকলেও নারীদের সম্মান রক্ষা ও নির্যাতন প্রতিরোধে তাদের ভূমিকা শূন্য। ধর্ষণ কিংবা নির্যাতনকারীদের গ্রেফতারে তাদের সফলতা একেবারেই নেই। তিনি বলেন, সাম্প্রতিককালে গণপরিবহনে ধর্ষণ নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া মেয়ে শিক্ষার্থী তথা চাকরিজীবীরা চরম আতংকের মধ্যে রয়েছেন। এমন অবস্থায় রাজধানীসহ দেশের সর্বত্র অভিভাবকরাও তাদের মেয়েদের নিয়ে শঙ্কায় ভুগছেন। কখন তাদের মেয়েরা নির্যাতনের শিকার হবেন- তা নিয়ে ঘরে ঘরে এখন আতংক বিরাজ করছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা মেয়েরা এখন সন্ধ্যার পর গণপরিবহনে উঠতে চাচ্ছেন না। পুলিশ কেন নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পাচ্ছে না, এর জবাব রাষ্ট্রকেই দিতে হবে। তিনি বলেন, রাজধানীতে বৃহস্পতিবার গারো তরুণী ধর্ষণের মামলা করতে গিয়ে চরম হয়রানির শিকার হয়েছেন ওই নারী। পুলিশ তথা দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্ট সংস্থা মনে করেন, ধর্ষিতরাই যেন অপরাধী। ধর্ষণকারীদের গ্রেফতারে তাদের অনীহা অনেক। কারণ ধর্ষিত কিংবা ধর্ষিতার পরিবার অর্থ লেনদেন করতে পারে না বলেই পুলিশের ভূমিকা তৎপর হয়ে ওঠে না।

No comments

Powered by Blogger.