একই সময়ে দুটি গণধর্ষণ? by রুদ্র মিজান

মাইক্রোবাসে তুলে গারো তরুণীকে গণধর্ষণের সময়ে একই ধরনের আরও একটি ঘটনা ঘটে। ওই গাড়িতে থাকা এক ধর্ষকের ফোনালাপ থেকে এমন তথ্য মিলেছে। বাইরের কারও সঙ্গে ফোনালাপের সময় ওই দুর্বৃত্ত ফোনে কাউকে বলেছিল, তোদের ‘মালের’ চেয়ে আমাদের ‘মাল’ ভাল। ধর্ষিতা তরুণীর ভাষ্য অনুযায়ী, ধর্ষকেরা অপর একটি গ্রুপের সঙ্গে কথা বলে যারা কোন মেয়েকে একই কায়দায় তুলে নিয়ে ধর্ষণের ঘটনা ঘটায়। নির্যাতিত গারো তরুণী তার স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে সেই রাতের বীভৎসতার বর্ণনা দিয়েছেন। তার বর্ণনা অনুযায়ী দুর্বৃত্তরা মাইক্রোবাসে তুলে আদিবাসী তরুণীকে গণধর্ষণের সময় গাড়িতেই পোশাক বদল করেছিল। এমনকি ধর্ষণের সময় গাড়িতে এয়ারফ্রেশনার ব্যবহার করে। নির্যাতিত তরুণীর বর্ণনা অনুযায়ী, পাঁচ ধর্ষকের মধ্যে দুজন ফরসা চেহারার ও তিন জন শ্যামলা কালো বর্ণের। একজনের হাতে ব্রেসলেট ছিল। সকলেই ছিল মোটামুটি স্বাস্থ্যবান। চালকের মাথার চুল লম্বা আর একজনের মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি ছিল। নির্যাতিতার বর্ণনা অনুসারে, তাকে তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে গাড়িটি চলতে থাকে। চার জন পালাক্রমে ধর্ষণের পর চালক কোন এক জায়গায় গাড়িটি থামিয়ে রেখে তাকে ধর্ষণ করে।
এদিকে গণধর্ষণের এই ঘটনার তিন দিন পেরিয়ে গেলেও ধর্ষকদের কাউকে এখনও গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। নির্যাতনকারীদের পরিচয় শনাক্ত করতে থানা পুলিশের পাশাপাশি কাজ করছে গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক টিম। অপরাধী শনাক্ত করতে মোবাইলফোন ট্র্যাকিংকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। চাঞ্চল্যকর এই ঘটনার তদন্ত তদারক করতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে ডিসি ডিবি (উত্তর) শেখ নাজমুল আলমকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অপর দুই সদস্য গুলশান জোনের এডিসি মাহবুব হাসান ও ডিবির এসি ওবায়দুল হক। এ ছাড়া দিনভর তুষার নামে এক ধর্ষককে গ্রেপ্তারের গুজব ছড়ালেও দায়িত্বশীল কেউ বিষয়টি স্বীকার করেনি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নির্যাতিত তরুণীর দেয়া বিভিন্ন বক্তব্যের সূত্র ধরেই তদন্ত করা হচ্ছে। ঘটনার দিনগত রাত ৯টার পর থেকে প্রায় ১০টা পর্যন্ত কুড়ির ফ্লাইওভার এলাকার মোবাইলফোন নেটওয়ার্কের অধীনে থাকা ফোনকলগুলো সংগ্রহ করে পর্যালোচনা চলছে। এসব মোবাইলফোন ট্র্যাকিং করে অপরাধী চিহ্নিত করাকে গুরুত্ব দিচ্ছে ডিবি। একই সঙ্গে যমুনা ফিউচার পার্কের কয়েকদিনের ভিডিও ফুটেজ, কুড়িল এলাকার বিভিন্ন ভবনের সিসিফুটেজ সংগ্রহ করেও গাড়িটি চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। তদন্ত সূত্র জানায়, তরুণীর ভাষ্য অনুযায়ী প্রাথমিকভাবে তারা তুষার নামে এক যুবকের সন্ধান পেয়েছেন। তুষারকে ধরতে ইতিমধ্যে গুলশান, বনানী, বারিধারা এলাকাসহ অন্তত ১৩টি স্থানে অভিযান চালানো হয়েছে। তুষার সম্পর্কে নির্যাতিত তরুণী জানিয়েছে, শ্যামলা ও সুঠাম দেহের অধিকারী সে। তার হাতেই কালো ব্রেসলেটটি ছিল। তুষারের শরীর থেকে উগ্র পারফিউমের ঘ্রাণ পেয়েছেন ওই তরুণী।
ডিবি পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, এই ক্ষেত্রে প্রযুক্তি নির্ভর তদন্তকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। নির্যাতিতা জানিয়েছেন কয়েকদিন আগে তার কর্মস্থল যমুনা ফিউচার পার্কের পোশাকের দোকানে এক ক্রেতা যুবক তাকে নানা প্রশ্ন করেছিল। সে জানতে চেয়েছিল তরুণীর নাম, ঠিকানা ও বেতন সম্পর্কে। ওই সময়ে তরুণী তাকে বেতন সম্পর্কে জানানোর পর সে বলেছিল, এতো অল্প টাকায় জীবনযাপন করাতো কঠিন। ওই সময়ে যুবকের সঙ্গে আফ্রিকান বংশোদ্ভূত এক নারী ও এক সাদা চামড়ার বিদেশী পুরুষ ছিল। তারা সেখানে কেনাকাটা করে। ওই যুবক এ ঘটনায় জড়িত থাকতে পরে বলে ধারণা করছে ডিবি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার বলেন, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ, মোবাইলফোন ট্র্যাকিংসহ বিভিন্ন বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে থানা পুলিশের পাশাপাশি তদন্ত করছে ডিবি। শিগগিরই ধর্ষকদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হতে পারে বলে মনে করেন তিনি। ধর্ষণকারীরা পূর্ব পরিচিত না বলেই নির্যাতিত তরুণী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়েছেন। তবু ওই তরুণীর ব্যক্তিগত বিভিন্ন বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। ডিবি কর্মকর্তারা মনে করছেন, ব্যক্তিগত সমস্যা থাকলেও নানা কারণে নির্যাতিতা তা গোপন করতে পারেন। অথবা পূর্বপরিচিত কেউ এ ঘটনা অন্য কাউকে দিয়ে ঘটাতে পারেন তাও ওই তরুণীর ধারণার বাইরে থাকতে পারে। যমুনা ফিউচার পার্কের ওই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত তরুণীর সহকর্মীরা  জানিয়েছেন, ওই তরুণীর এক ছেলে বন্ধু ছিল। আদিবাসী এ যুবক থাকেন মিরপুরে। প্রায় দিনই ডিউটি শেষ হলে রাত ৯টার দিকে যমুনা ফিউচার পার্ক থেকে তরুণীকে উত্তরার বাসায় পৌঁছে দিতেন ওই তরুণ। নির্যাতিতার সহকর্মী কাকলি জানান, গত এক সপ্তাহ আগে সম্পর্ক ভেঙে গেছে তাদের। কি কারণে সম্পর্ক ভেঙেছে তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, মেয়েটি বিয়ে করতে চাচ্ছিল তাকে। কিন্তু ওই তরুণ বিয়ে করতে অনীহা প্রকাশ করে। এই কারণেই তাদের সম্পর্ক ভেঙে যায়। তবে তরুণীর ওই ছেলেবন্ধু এ ঘটনা ঘটাতে পারেন না জানিয়ে কাকলি বলেন, যতদূর জানি ওই তরুণ নিরীহ ও মধ্যবিত্ত। তবে তার নাম জানাতে পারেননি তিনি। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার মাহফুজুর রহমান জানান, তারাও তরুণীর প্রেম সম্পর্কিত  বিষয়গুলোও গুরুত্ব দিয়ে অনুসন্ধান করছেন। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে কেউ এ ঘটনা ঘটিয়েছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ভাটারা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সাজ্জাদ হোসেন জানান, নির্যাতনকারীদের গ্রেপ্তার করতে একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে পুলিশ কাজ করছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বিত্তশালী বখাটে, মাদকসেবী, সন্ত্রাসীদের টার্গেট করে তুষার নামক যুবককে খুঁজছে পুলিশ। শুক্রবার থেকেই বারিধারা, বনানী, গুলশান ও উত্তরার চিহ্নিত বখাটেদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। সম্ভাব্য স্থানে একের পর এক অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
জানা গেছে, বর্তমানে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি)-এ চিকিৎসাধীন ওই তরুণী। ওসিসি’র সমন্বয়কারী ডা. বিলকিস বেগম জানান, শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি তাকে মানসিকভাবে কাউন্সিলিং করা হচ্ছে। নির্যাতিত ওই তরুণী আগের চেয়ে অনেক সুস্থ আছে বলে জানান তিনি। এদিকে গতকাল দুপুরে ওসিসিতে চিকিৎসাধীন নির্যাতিত তরুণীকে দেখতে ওসিসিতে যান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য সেলিনা হোসেন।  তরুণীর সঙ্গে কথা বলে তিনি জানান, ধর্ষণের একপর্যায়ে এক যুবকের ফোনে কল আসে। ফোনটি ছিল ড্রাইভিং সিটের পাশে। তখন অন্য এক যুবক বলছিল, এই তুষার তোর ফোন...। ফোনকল রিসিভ করে তুষার নামের যুবকটি অপর প্রান্তের ব্যক্তিকে বলছিল, তোদের ‘মালে’র চেয়ে আমাদের ‘মাল’ অনেক ভাল। সেলিনা হোসেনের ধারণা, ওই সময়ে একাধিক গ্রুপ আলাদাভাবে এরকম একাধিক ঘটনা ঘটিয়েছে।  সেলিনা হোসেন বলেন, নির্যাতিত তরুণীর বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে দুর্বৃত্তরা অত্যন্ত প্রভাবশালী। তারা নিয়মিতই এসব অপকর্ম করে বেড়ায়। তিনি বলেন, জাতি চরম অধপতনের দিকে যাচ্ছে। এই ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করে কঠোর শাস্তি দেয়া না হলে এই অবক্ষয় চরম আকার ধারণ করবে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি। একই সঙ্গে গারো তরুণীকে গণধর্ষণের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে উদ্বেগের পাশাপাশি এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানানো হয়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) স্বাক্ষরিত ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২১ মে বৃহস্পতিবার রাতে কর্মস্থল থেকে উত্তরার বাসায় ফেরার পথে কুড়িল বিশ্বরোডে বাসের জন্য অপেক্ষারত গারো তরুণীকে জোরপূর্বক মাইক্রোবাসে তুলে পাঁচ জন পালাক্রমে ধর্ষণ করে যা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এ ঘটনায় মানবাধিকার কমিশন তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে নারী সমাজের ওপর আক্রমণ ও হামলার ঘটনায় কমিশন গভীরভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়াম্যান কাজী রিয়াজুল হকের নেতৃত্বে গতকাল একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপালে নির্যাতনের শিকার ওই তরুণীকে দেখতে যান। এর আগে তাকে দেখতে ওসিসিতে যান নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি। তিনিও এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানান।
উল্লেখ্য, গত ২১শে মে রাত ৯টায় কর্মস্থল থেকে রাজধানীর উত্তরার বাসায় ফেরার পথে গণধর্ষণের শিকার হন আদিবাসী ওই তরুণী। যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে কুড়িল বিশ্বরোড এলাকার সিনহা মটরসের সামনে থেকে জোর করে তাকে মাইক্রোবাসে তোলে নেয় দুর্বৃত্তরা। গাড়িতে গণধর্ষণ শেষে রাত পৌনে ১১টার দিকে উত্তরা পূর্ব থানা এলাকার জসীমউদদীন সড়কে নামিয়ে দেয় তাকে। পরদিন ভাটারা থানায় পাঁচ অজ্ঞাত দুর্বৃত্তকে আসামি করে মামলা করেন ওই তরুণী।

No comments

Powered by Blogger.