ঘায়েল করতেই মামলা -আ জ ম নাছির উদ্দিন by সোহরাব হাসান ও একরামুল হক

সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের আগে ২০-দলীয় জোট-সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী মোহাম্মদ মনজুর আলম ও আওয়ামী লীগ-সমর্থিত আ জ ম নাছির উদ্দিন প্রথম আলোর মুখোমুখি হন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান ও জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক একরামুল হক
প্রথম আলো: আপনি দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতি করলেও নগরের নেতৃত্বে এসেছেন অনেক পর। এর আগে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই তুলনায় সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব অনেক বড়।
আ জ ম নাছির উদ্দিন: দায়িত্ব পালন করতে করতে অভিজ্ঞতা বাড়ে। জেলা ক্রীড়া সংস্থার দায়িত্ব হলো নিয়মিত খেলাধুলার আয়োজন করা। প্রতিটি ইভেন্টে খেলোয়াড় তৈরি করা ও তাঁদের মান বৃদ্ধি করা। এটা বিশাল কর্মযজ্ঞ। গত তিন বছর চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার মাধ্যমে ২৪টি ইভেন্ট আয়োজন করেছি। উপজেলা পর্যায়ে ক্রীড়া কর্মকাণ্ড বিস্তৃত করেছি।
প্রথম আলো: আপনি বলেছেন সদ্য বিদায়ী মেয়র সব ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছেন। আপনি সফল হবেন, তার নিশ্চয়তা কী?
নাছির উদ্দিন: সিটি করপোরেশনের নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার জন্য প্রথম দরকার সদিচ্ছা। সদ্য বিদায়ী মেয়র পাঁচ বছরে অফিস করেছেন মাত্র দুই মাস। উনি চট্টগ্রামে থেকেও অফিস করেননি। মেয়রের যদি অফিস করায় অনীহা থাকে, তাহলে সেই মেয়র দিয়ে কীভাবে নাগরিক সেবা নিশ্চিত হবে? আজকে সিটি করপোরেশন এলাকায় বিনোদনের সুযোগ নেই। ছেলেমেয়েরা কোথাও যেতে পারছে না। তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বাড়ছে। বিনোদনের জন্য সিটি করপোরেশনের স্বাধীনতা পার্ক আছে, কিন্তু সঠিক ব্যবহার নেই। পুরোনো সার্কিট হাউস ও আগ্রাবাদ শিশুপার্কেরও একই অবস্থা। আগ্রাবাদ শিশুপার্ক তো এখন ক্রাইম জোনে পরিণত হয়েছে।
প্রথম আলো: আপনি যে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার কথা বলছেন, তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেক সেবাসংস্থা সিটি করপোরেশনের অধীনে নয়।
নাছির উদ্দিন: অন্যদের কথা পরে ভাবা যাবে। আগে সিটি করপোরেশনের নিজস্ব দায়িত্ব তো নিশ্চিত করতে হবে। একসময় চট্টগ্রাম মহানগর প্রাচ্যের রানি হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিল। কিন্তু পাঁচ বছরে এটা কোন জায়গায় গেছে? ডাস্টবিন, রাস্তাঘাট—সবকিছুর শোচনীয় হাল।
প্রথম আলো: চট্টগ্রামকে মেগাসিটি করার কথা বলেছেন। কীভাবে করবেন?
নাছির উদ্দিন: আমি চিটাগাং কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটিতে আছি। অভিজাত এই সংস্থায় বিপুল ভোট পেয়ে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলাম। সেখানে ২০-৩০ বছরের জটিল সমস্যার সমাধান করেছি। এটা উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়।
প্রথম আলো: সম্প্রতি এই সংস্থার নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। জাল ভোটের অভিযোগ উঠেছে?
নাছির উদ্দিন: একটি ভালো সংস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্যই এটা করা হয়েছে। কেউ নিজের ব্যর্থতাকে আড়াল করতে এটি করেছেন। গতবার আমরা (প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী) একই প্যানেল থেকে নির্বাচন করেছি। আমার ভাবমূর্তির কারণেই তাঁরা বিজয়ী হয়েছিলেন। এবারে ভোট গণনা পর্যন্ত সবাই উপস্থিত ছিলেন। তাহলে কারচুপি হলো কীভাবে? নির্বাচনে যে হারবে, সেই বলবে ঠিক হয়নি। জিতলে ঠিক আছে। এটা ঠিক নয়।
প্রথম আলো: যে দলের সমর্থন নিয়ে মেয়র পদে নির্বাচন করছেন, সেই দলের নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক আপনি। সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীও নির্বাচনে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। তিনি সমর্থন পাননি। এখন পুরো কমিটি কি আপনার সঙ্গে আছে বলে মনে করেন?
নাছির উদ্দিন: অবশ্যই আমার সঙ্গে আছে। শতভাগ আছে। দলে কোনো মান-অভিমান নেই। বিভক্তি নেই। তবে একেকজনের সক্ষমতা একেক রকম। অনেক নামীদামি খেলোয়াড় শূন্য রানে আউট হচ্ছেন। তাহলে কী আমরা বলব, তিনি ইচ্ছা করেই খারাপ করেছেন?
প্রথম আলো: নামীদামি খেলোয়াড় আউট হচ্ছেন বলেই আপনি নেতৃত্বে এসেছেন, আপনার প্রার্থিতা নিশ্চিত হয়েছে?
নাছির উদ্দিন: না, না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নগর আওয়ামী লীগের কমিটি করার ক্ষেত্রে অনেক সময় দিয়েছেন। অনেক কিছু যাচাই-বাছাই করেছেন। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।
প্রথম আলো: আপনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ আছেন। কিন্তু ছাত্রলীগের মধ্যে মহিউদ্দিন ও নাছির গ্রুপের দ্বন্দ্বের কথা সবাই জানেন।
নাছির উদ্দিন: এখানে তথ্যের ঘাটতি আছে। আমার কোনো গ্রুপ নেই। একটা পত্রিকা লিখেছে, আগে ছিল দুটি গ্রুপ। এরপর লিখেছে, চার গ্রুপে বিভক্ত। তবে আমি বলব, যারা গ্রপিং আবিষ্কার করতে চায়, তারা হতাশ হবে। নগর আওয়ামী লীগ গতিশীল সংগঠন হবে।
প্রথম আলো: আপনি একসময় চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। এখন সেই কলেজটি ছাত্রশিবিরের নিয়ন্ত্রণে।
নাছির উদ্দিন: আমি বলব, এটার জন্য অনেকেই দায়ী। এখন যদি কিছু করতে চাই, বলবে ছাত্রলীগ সন্ত্রাস করছে। প্রথম আলো সবার আগে বলবে। অথচ শিবির যে সন্ত্রাস করছে, পত্রিকায় তা লেখা হচ্ছে না। আমার বিশ্বাস, সেখানে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী শিবিরের রাজনীতি অপছন্দ করে। প্রগতিশীল রাজনীতির উত্থান হোক, নিয়মিত সাংস্কৃতিক চর্চা হোক, তারা চায়। এটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কলেজ কর্তৃপক্ষের। মিডিয়ারও। শিবিরের কাউকে বের করে দিলে সেটা মিডিয়ায় আসছে। ছাত্রলীগের কর্মীকে বের করে দিলে সেটা আসছে না।
প্রথম আলো: আপনি মেয়র প্রার্থী হয়েছেন। কিন্তু চট্টগ্রাম শহরের উন্নয়ন নিয়ে আপনার পরিকল্পনা দেখছি না। কেবল প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর ব্যর্থতার কথা বলছেন।
নাছির উদ্দিন: শুধু পরিকল্পনা করলে হবে না। বাস্তবতার নিরিখে কাজ করতে হবে। ৪১টি ওয়ার্ডের বেহাল অবস্থার কথা মিডিয়ায় এসেছে। মূল শহরের বাইরে দুর্গম এলাকার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। আট-দশ দিন আগে বৃষ্টি হলেও অনেক এলাকায় এখনো পানি রয়ে গেছে। আমার প্রথম অগ্রাধিকার হবে জলাবদ্ধতার নিরসন। সরকারের সহযোগিতা নিয়ে এর স্থায়ী সমাধান করতে হবে। সদ্য বিদায়ী মেয়র বলেছেন, সরকারের সহযোগিতা পাননি। শতভাগ মিথ্যাচার। আমার দ্বিতীয় অগ্রাধিকার হবে চট্টগ্রামকে পরিচ্ছন্ন শহরে পরিণত করা। তৃতীয় হলো শিক্ষার বিস্তার। এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী অনেকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বস্তি এলাকার ছেলেমেয়েরাও পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। তবে গত পাঁচ বছর শিক্ষার মান কমেছে। নতুন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও গড়ে ওঠেনি।
প্রথম আলো: সিটি করপোরেশন এলাকায় করপোরেশনকে পাশ কাটিয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) ওভারব্রিজসহ বেশ কিছু উন্নয়নকাজ করেছে। আপনি মেয়র হলে অন্য সংস্থার মাধ্যমে এসব করতে দেবেন কি না।
নাছির উদ্দিন: প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামের দায়িত্ব নিজ হাত তুলে নিয়েছেন। এটাকে রক্ষা করতে হবে। বিদায়ী মেয়র চার বছরে কোনো প্রকল্প দেননি। প্রধানমন্ত্রী যেহেতু চট্টগ্রামবাসীর প্রতি অঙ্গীকার করেছেন, সে জন্য বিকল্প হিসেবে চউক দিয়ে উন্নয়নকাজ করানো হয়েছে।
প্রথম আলো: চট্টগ্রামের প্রতি সরকারের আচরণে কি আপনি সন্তুষ্ট, যেখানে বাণিজ্যিক রাজধানী কেবল মৌখিক ঘোষণায় সীমাবদ্ধ?
নাছির উদ্দিন: এটা দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। আমি সন্তুষ্ট। উন্নয়নকাজগুলো কোনো না কোনো বিভাগের মাধ্যমে করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের বড় ভূমিকা আছে। আমি নির্বাচিত হলে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করব।
প্রথম আলো: আপনার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলা আপনার দলের লোকেরাই করেছেন।
নাছির উদ্দিন: একটি মামলা হয়েছিল বিএনপির আমলে। যেহেতু আমি ভালো সংগঠক, সেহেতু আমাকে ঘায়েল করতেই এটা করা হয়েছে। আরেকটি মামলা ২২-২৩ বছর স্থগিত ছিল। আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ওখানেও একই অভিযোগ। কিন্তু আমার কোনো মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করা হয়নি। আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে একটি বাতিল হয়ে গেছে। আরেকটি বিচারাধীন। এটিও ছিল ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যমূলক।

No comments

Powered by Blogger.