ফুল আর অশ্রুতে নিহতদের স্মরণ by হাফিজ উদ্দিন

সাভারের ভয়াবহ রানা প্লাজার ধসের দুই বছর পার হয়ে গেল। ভয়াবহ এ ঘটনায় হাজারের বেশি শ্রমিক-কর্মচারী নিহত হন। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে ছিন্নভিন্ন হয়েছে অসংখ্য পরিবার। দুই বছর পরও এখনও থামছে না স্বজনদের কান্না। কেউ কেউ দেশ-বিদেশের সহযোগিতা পেলেও দুই বছরেও এখনও  ক্ষতিপূরণ পায়নি অনেক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার। গতকাল সাভারের সেই রানা প্লাজার ধসের স্থানটি লোকারণ্য হয়েছিল। নিহত শ্রমিক পরিবারের সদস্য, আহত শ্রমিক ও বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা সেখানে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। পরে এক সমাবেশে বলা হয়, ভবন ধসের দুই বছর পার হলেও ক্ষতিগ্রস্তদের অনেকে ক্ষতিপূরণ পাননি। তাদের দ্রুত ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি জানানো হয়। সাধারণ শ্রমিকদেরও মুখেও ছিল একই কথা।
গতকাল সরজমিনে ধসে যাওয়া রানা প্লাজায় গিয়ে দেখা যায়, দিনের শুরুতেই বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন এবং আহত শ্রমিক ও  নিহত, নিখোঁজ শ্রমিকদের স্বজনরা নিহত শ্রমিকদের স্মরণে রানা প্লাজার সামনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদেন করেন। এসময় নিখোঁজ নিহত শ্রমিকের স্বজনদের কান্নায় বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। পরে নিহত শ্রমিকদের স্মরণে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ঢাকার জেলা প্রশাসক, ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার, স্থানীয় সংসদ সদস্য ডা. এনামুর রহমান, গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন, শিল্প পুলিশের পরিচালক, ফায়ার সার্ভিস, রানা প্লাজা শ্রমিক ইউনিয়ন, বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি, শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরাম, গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয় কেন্দ্র, বাংলাদেশ শ্রম অধিকার ফোরাম, জাতীয় গণফ্রন্ট, বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ টেক্সটাইল গামের্ন্টস শ্রমিক ফেডারেশন, রানা প্লাজা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী সমিতিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও শ্রমিক সংগঠন।
শ্রদ্ধা নিবেদনের পর থেকে শ’ শ’ আহত নিহত নিখোঁজ শ্রমিকদের স্বজনেরা রানা প্লাজার সামনে এসে জড়ো হতে থাকে। এ সময় ভবন ধসের সঙ্গে জড়িত সবার ফাঁসি দাবি করে বিক্ষোভ মিছিল করে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনগুলো। এছাড়া নিহত শ্রমিকদের স্বরণে বাংলাদেশ টেক্সটাইল গামের্ন্টস শ্রমিক ফেডারেশন আলোকচিত্র প্রদর্শনের আয়োজন করেন।
বিকালে বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের উদ্যোগে রানা প্লাজা ধসে নিহত, আহত ও নিখোঁজ শ্রমিকদের পরিবারের মাঝে সারা জীবনের আয়ের সমান ক্ষতিপূরণ ও আহত শ্রমিকদের সুচিকিৎসা ও ভবন মালিক সোহেল রানার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে সমাবেশ করে তৈরী পোশাক কারখানার শ্রমিকরা। সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান খঁন। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি মন্টু ঘোষ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার, আজম খানসহ আরও অনেকে।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, রানা প্লাজা ধসের দুই বছর হলো। তবুও এখন পর্যন্ত ভবন ধসের সঙ্গে জড়িতদের বিচার করেনি সরকার। আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে জড়িতদের অনেকেই পার পেয়ে গেছে। এছাড়া অনেকেই জামিন নিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছে। অবিলম্বে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিও করেন তারা।
বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের সমাবেশ: সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ধ্বংসস্তূপের সামনে সমাবেশ করেছে। সমাবেশে বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সমন্বয়ক তাসলিমা আখতার বলেন, ভবনধসের দুই বছর পার হলেও নিয়ম অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত অনেকেই ক্ষতিপূরু পাইনি। এ ঘটনায় যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তারা অনেকে জামিনে আছেন। তিনি দোষীদের কঠোর শাস্তির দাবি জানান। রানা প্লাজা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি এমদাদুল হক বলেন, এ ভবন ধসের ঘটনা নিছক কোনও দুর্ঘটনা নয়, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তাই এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানান তিনি। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান জাফরউল্লাহ চৌধুরী বলেন, শ্রমিকেরা গণতন্ত্রের ভিত্তি। অথচ এ দেশে তারাই সবচেয়ে বেশি অবহেলার শিকার হন। প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে রানা প্লাজার শ্রমিকদের জন্য কোনও অর্থ নেই- এ ধরনের বক্তব্য শ্রমিকদের সাথে প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয় বলেও তিনি জানান। নিখোঁজ শ্রমিক স্বজনরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, নিহত ও আহত শ্রমিকদের কথা সবাই বলছে, সাহায্য দিচ্ছে। কিন্তু নিখোঁজ শ্রমিকদের পরিবারের সহায়তায় এখনও কেউ এগিয়ে আসেনি, কেউ তাদের খোঁজও নেয় না।

No comments

Powered by Blogger.