চাপে ভোটাররা by শামীমুল হক, সাজেদুল হক ও সিরাজুস সালেকিন

ঘনিয়ে আসছে ভোট। বাড়ছে আতঙ্ক। শঙ্কা ভোটারদের মধ্যে। ভোট দিতে পারবেন কিনা- এ নিয়ে চিন্তিত তারা। আলামত অবশ্য ভাল নয়। ইতিমধ্যে ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে নিষেধ করা হচ্ছে। হুমকি দেয়া হচ্ছে নিষেধ অমান্য করে কেন্দ্রে গেলে ভয়াবহ পরিণতির কথা। গতকাল মিরপুর দারুস সালাম থানা এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে ন্যাশনাল আইডি কার্ড চেয়ে এসেছে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর লোকজন। বাড়িওয়ালাদের এ ব্যাপারে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে আতঙ্ক ভোটারদের মাঝে। বাড়িওয়ালারা ঘরে ঘরে গিয়ে ভাড়াটিয়াদের কালকের মধ্যে ভোটার আইডি কার্ড দিতে বলেছে। মিরপুর-১ নম্বরের জহুরাবাদ এলাকার ভোটার নাসরিন বলেন, তারা বলে গেছে ভোটার আইডি কার্ড দিলেই হবে। ভোট দিতে যেতে হবে না। নির্বাচনের পরদিন ভোটার আইডি কার্ড ফেরত দেবে বলে জানিয়ে গেছে। এ অবস্থায় আমরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি। বশির নামের একজন বাড়িওয়ালা বলেন, নানা কথা চারদিকে। নানা গুঞ্জন। ভোট কেন্দ্রে গেলে তাদের ভোট দিতে হবে। এমন কথা বলে গেছে এক প্রার্থীর লোকজন। ভোটার আইডি কার্ড প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার বাড়ির সবার কার্ড আমার কাছ থেকে নেবে বলে জানিয়ে গেছে তারা। আমি সবাইকে বলে দিয়েছি। নির্বাচন নিয়ে কি যে হয় ভেবে পাচ্ছি না। তিনি বলেন, ভয় আর আতঙ্কে দিন কাটছে এখন। আগামী ২৮শে এপ্রিল নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত আতঙ্ক কাটবে না। এখানে আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে নির্বাচন করছেন মুজিব মাসুম সারোয়ার। তার প্রতীক ফুলের ঝুড়ি। আওয়ামী লীগের আরও দুই জন বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। তারা হলেনÑ আবুল কোম্পানী ও সেলিম খান। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মাসুদ খান ঠেলাগাড়ি প্রতীক নিয়ে লড়ছেন। কিন্তু মাসুদ খান এলাকায় প্রচারণায় নামতে পারছেন না। তার পক্ষে তার স্ত্রী এলাকায় ভোট চাইছেন। শুধু মিরপুর নয়, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির মহল্লায় মহল্লায় এখন চলছে নানা কসরত। ঘরে ঘরে গিয়ে নিজেদের প্রার্থীকে ভোট দিতে নানাভাবে হুমকি দেয়ার ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় ভোটের মাঠে উত্তাপ ছড়িয়ে দিচ্ছে। আতঙ্ক ভর করছে ভোটারদের মনে। মাঠের এ আতঙ্ক এখন ভোট গ্রহণ কর্তাদের মনেও বাসা বেঁধেছে। বৃহস্পতিবার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের রিটার্নিং কর্মকর্তার অফিস মহানগর নাট্যমঞ্চে অনেকেই এসেছেন তাদের নাম নির্বাচনী ডিউটি থেকে প্রত্যাহার করতে। একটি বেসরকারি ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার (মহিলা) নিজ হাতে আবেদন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন রিটার্নিং কর্মকর্তার দপ্তরের সামনে। রিটার্নিং অফিসার মিহির সারোয়ার দপ্তরে না থাকায় তিনি অপেক্ষা করছেন। জিজ্ঞেস করতেই তিনি বলেন, যাত্রাবাড়ী এলাকার একটি বেসরকারি ব্যাংকে তিনি চাকরি করেন। তিনি নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করতে ভয় পাচ্ছেন। বলেন, যেখানে বিএনপি চেয়ারপারসনের গাড়িবহরে অব্যাহত হামলা হচ্ছে, সেখানে কিভাবে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। আমরা কেন্দ্রের ভেতরে থেকে কিভাবে দায়িত্ব পালন করবো। তার চেয়ে নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি অনেক ভাল। রিটার্নিং অফিসার বরাবর আবেদন করে আজই নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিতে চাই। মিরহাজীরবাগ এলাকার ষাটোর্ধ্ব ভোটার নজরুল ইসলাম বলেন, এরশাদ জামানায় ভোট এলে এমন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ত সর্বত্র। এখন আবার সেই এরশাদ জামানার গন্ধ পাচ্ছি। পৃথিবী যেখানে আগায়, আমরা সেখানে দিন দিন পিছে হটছি। এ থেকে কি কোনভাবেই আমাদের রেহাই দেবেন না রাজনীতিকরা। ঢাকা দক্ষিণ ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী সাইদুর রহমান বলেন, নির্বাচনী ময়দানে এখন গুমোটভাব বিরাজ করছে। ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক। এ আতঙ্ক আওয়ামী লীগ প্রার্থীরাই ছড়িয়ে দিচ্ছে। নানাভাবে হুমকি ধমকি দিচ্ছে। দক্ষিণের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী হাজী ইমরানুল ইসলাম ওয়াহিদ বলেন, সরকার সমর্থক নেতাকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধার মুখে প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারছি না। আমার সমর্থকরাও বাইরে বেরুতে পারছে না। এ অবস্থায় ওয়ার্ডজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ঢাকা উত্তর ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের স্বতন্ত্র প্রার্থী রাকিব আহসান গুম হওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন। তাকে ভয়ে ভয়ে প্রচারণা চালাতে হচ্ছে। তিনি বলেন, কর্মী, সমর্থক ও শুভাকাক্সক্ষীরা সাবধানে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন। তার প্রতীক ঘুড়ি। তিনি বলেন, কয়েকবার গুম করে দেয়ার হুমকি পেয়েছি। আমার লাগানো পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে। এই ওয়ার্ডের স্বতন্ত্র প্রার্থী নুরুল ইসলামও আতঙ্কে রয়েছেন। তার প্রতীক লাটিম। তিনি বলেন, সরকার সমর্থক প্রার্থীর লোকজন আমাকে হুমকি দিচ্ছে। এখানকার আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ইসহাক মিয়াও আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এনেছেন। এ অবস্থায় দিন যত ঘনিয়ে আসছে নির্বাচনী ময়দান তত উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। ছড়িয়ে পড়ছে আতঙ্কও। গতকাল যাত্রাবাড়ী পূবালী এলাকার গৃহবধূ হাজেরা বেগম বলেন, দিন দিন ভয় তাড়া করছে। যে হারে সরকর সমর্থক লোকজনের আনাগোনা বেড়েছে মহল্লায় তাতে আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এমন হলে ভোট দিতে যাবো না। ঘরে বসে থাকব। যাত্রাবাড়ী ওয়াপদা কলোনির বাসিন্দা রহিম বক্স বলেন, এলাকায় প্রচার করা হচ্ছে কেন্দ্রে গেলে একজন প্রার্থীকে ভোট দিতে হবে। এ অবস্থায় মতামত প্রকাশ সম্ভব নয়। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি ভোট দিতে যাবো না। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার ঘটনা ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে ভোটের মাঠে। অব্যাহত এ হামলার ঘটনায় সর্বত্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
অপরদিকে নির্বাচন কমিশনের একের পর এক তুঘলকি কা- নির্বাচন নিয়ে তৈরি করেছে গভীর অনিশ্চয়তা। ভোটের তিন দিন আগেও ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে বিরোধী সমর্থক বেশির ভাগ কাউন্সিলর প্রার্থী মাঠে নামতে পারেননি। ঢাকা দক্ষিণে গণসংযোগ করতে পারেননি মির্জা আব্বাসও। গতকাল প্রচারণায় নেমে গ্রেপ্তার হয়েছেন বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী আবুল খায়ের বাবলু। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জুমার নামাজ পড়তে আসবেন এমন কারণ দেখিয়ে মহাখালীর রহিম মেটাল জামে মসজিদে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী তাবিথ আউয়ালকে ঢুকতে দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অন্যদিকে, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে ঢাকা দক্ষিণের আওয়ামী লীগ প্রার্থী সাঈদ খোকন নির্বাচনী আচরণবিধি ভেঙে ভোট চেয়েছেন। যদিও এসব ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন যথারীতি দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।
অনেকটা নাটকীয়ভাবেই তিন সিটি নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট। এরপর নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতের জন্য দলটির পক্ষ থেকে একাধিকবার নির্বাচন কমিশনের কাছে দাবিও জানানো হয়। ক্ষমতাসীনদের দাপটে বিশেষত ঢাকায় ভোটের মাঠে অনেকটা কোণঠাসা ছিলেন বিরোধী সমর্থকরা। তবে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া প্রচারণায় নামাতে পাল্টাতে থাকে ভোটের হিসাব। একাধিক গোয়েন্দা রিপোর্টেও এমন ইঙ্গিতও দেয়া হয়েছে। খালেদা জিয়ার প্রথম দিনের প্রচারণা নির্বিঘœ হলেও দ্বিতীয় দিনেই বাধার মুখে পড়েন তিনি। আর পরের তিন দিন শিকার হন হামলার। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর ওপর হামলার ঘটনায় ভোটের মাঠে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। হামলাকারী চিহ্নিত হলেও এখন পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। চট্টগ্রামেও বিএনপি সমর্থক মনজুর আলমের প্রচারণায় হামলা চালানো হয়েছে। সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত ভোটারদের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি আনলেও তা ছিল একেবারেই ক্ষণস্থায়ী। কারণ একদিনের মধ্যেই নিজেদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে নির্বাচন কমিশন। অভাবনীয়ভাবে কমিশনের পরিবর্তিত সিদ্ধান্তে বলা হয়, নির্বাচনের মাঠ নয়, সেনানিবাসেই থাকবেন সেনাসদস্যরা। নির্বাচন কমিশনের এই পিছুটানে ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক বেড়েছে বহুগুণ।
অন্যদিকে এ পর্যন্ত হুমকি ও ধমকির শতাধিক অভিযোগ পড়েছে কমিশনে। প্রায় প্রতিটি অভিযোগই বিএনপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের। অভিযোগও প্রায় একই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী কর্তৃক প্রচারণায় বাধা ও হুমকি-ধমকির অভিযোগ করা হয়েছে। এমনকি প্রশাসনকে ব্যবহার করেও নির্বাচনী কার্যক্রমে বাধা দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন তারা। কিন্তু এসব ঘটনায় কোন প্রতিকার পাচ্ছেন না বলে অভিযোগকারীরা জানিয়েছেন। কোন কোন প্রার্থী আতঙ্কে প্রকাশ্যে গণসংযোগ পর্যন্ত করতে পারছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা মনে করছেন এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। সিটি নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়টি মনিটর করছেন নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ের যুগ্ম সচিব ড. মো. শাহজাহান। তিনি জানান, এখন পর্যন্ত তার কাছে বড় ধরনের কোন অভিযোগ আসেনি। তথ্য-প্রমাণসহ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ খুব কমই পাওয়া যাচ্ছে বলে জানান তিনি।
গত কয়েকদিন নির্বাচনী প্রচারণায় নামা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে পরপর তিন দফা হামলার পর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের মনে। কারণ, এসব হামলায় বারবার ছাত্রলীগ-যুবলীগের নামই উঠে এসেছে। বুধবার বাংলামোটরে খালেদা জিয়ার গাড়িতে হামলা করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। হামলা লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় খালেদা জিয়া অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও তার গাড়িটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর আগে রোববার উত্তরায় প্রচারণা চালাতে গিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের বাধার সম্মুখীন হন। সোমবার বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের পক্ষে ভোট চাইতে গিয়ে রাজধানীর কাওরান বাজারে ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের হামলার শিকার হন খালেদা জিয়া। মঙ্গলবার রাজধানীর ফকিরাপুল এলাকায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত মেয়রপ্রার্থী মির্জা আব্বাসের প্রচারণায় গিয়ে হামলার শিকার হয় খালেদা জিয়ার গাড়িবহর। এরই মধ্যে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার খবর পাওয়া গেছে। এসব সহিংসতার ঘটনা ঘটছে মূলত ক্ষমতাসীনদের দুই গ্রুপ ও আওয়ামী লীগ-বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে। শুধু তাই নয়, এসব সহিংসতায় পেশাদার সন্ত্রাসী ও খুনিদেরও ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগে উঠেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের স্বতন্ত্র কাউন্সিলর প্রার্থী জাকির হোসেন জানান, বুধবার তার প্রতিদ্বন্দ্বী, আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী আবু আহমেদ মান্নাফ দলীয় ক্যাডারদের নিয়ে তার নবাবপুর রোডের নির্বাচনী ক্যাম্পে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। এ ঘটনায় তিনি সূত্রাপুর থানায় একটি অভিযোগ করেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের জনৈক এমপির কারণে পুলিশ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি বলে অভিযোগ করেন তিনি। আতঙ্কে তিনি প্রচারণা চালাতে পারছেন না। বিষয়টি নির্বাচন কমিশনকেও অবগত করা হয়েছে। একইভাবে ওই দিন দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী খাজা হাবিবের বাসা সংলগ্ন পরিবাগের নির্বাচনী ক্যাম্পে একদল যুবক হামলা করে। হামলাকারীরা তার বাসার সামনে থাকা একটি প্রাইভেটকারে অগ্নিসংযোগ ও নির্বাচনী প্রচারণার ব্যবহৃত আরও ১০টি গাড়ি ভাঙচুর করে। এ বিষয়ে পুলিশ ও নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করেলও কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি বলে জানান খাজা হাবিবুল্লাহ হাবিব। পুরান ঢাকার বেশ কয়েকজন প্রার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এমনিতেই তারা সরকার দলীয় প্রার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকির সম্মুখীন হচ্ছেন। এর ওপর এ ধরনের সংবাদে স্বাভাবিক কারণেই আতঙ্কে আছেন তারা ও তাদের পরিবার। এসব এলাকার প্রার্থীরা ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলো নিয়েও আছেন আতঙ্কে। অনেকে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের তালিকা জমা দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনেও। গত সপ্তাহে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও কোতোয়ালি থানা এলাকা থেকে অস্ত্র ও গুলিসহ পাঁচজনকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। এর মধ্যে দুইজন ছিল ভাড়াটিয়া খুনি। তারা পুলিশকে জানায়, দুই কাউন্সিলর প্রার্থীকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল তাদের। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে কারও নাম উল্লেখ না করায় এবং পরদিন গণমাধ্যমে সংবাদটি প্রচারিত হওয়ার পর থেকে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন পুরান ঢাকার কাউন্সিলর প্রার্থীরা। বিশেষ করে বিএনপি ও বিরোধী দল সমর্থিত প্রার্থীরা। যাত্রাবাড়ী এলাকার ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী দেলোয়ার হোসেন দেলু জানান, প্রচারণার শুরু থেকেই তার পোস্টার-স্টিকার ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে। রাতের আঁধারে এগুলো ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে। নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা হুমকি দিচ্ছেন। এ বিষয়ে তিনি নির্বাচন কমিশনে লিখিতভাবে জানিয়েছেন বলেও জানান। পূর্ব জুরাইন এলাকার ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মির হোসেন মিরু জানান, এমনিতেই মামলার কারণে তিনি নিজে নির্বাচনী প্রচারণায় নামতে পারছেন না। তার ওপর বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হচ্ছে কর্মীদের। এদিকে ঢাকা দক্ষিণের ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের স্বতন্ত্র কাউন্সিলর প্রার্থী জাকির হোসেন অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আবু আহমেদ মান্নাফের লোকজন তার নির্বাচনী কার্যালয়ে হামলা চালিয়েছে। ক্রমাগত হুমকি দিয়ে যাচ্ছে তাকে। তিনিও তার জীবন নিয়ে শঙ্কিত বলে মন্তব্য করেন। ২০শে এপ্রিল ঢাকা দক্ষিণের ১৩নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী আঞ্জুমান আরা বেগম অভিযোগ করেন, সরকার সমর্থিত প্রার্থীর লোকেরা তার পোস্টার-লিফলেট ছিঁড়ে ফেলছে এবং সমর্থকদের পুলিশ দিয়ে হয়রানিসহ নানা হুমকি দিচ্ছে। ঢাকা সিটি উত্তরের ৪নং ওয়ার্ডে ২০ দল সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী লস্কর মো. তসলিম অভিযোগ করেন, বৃহস্পতিবার রাত ১২টার দিকে কয়েক গাড়ি পুলিশ তার বাসা ঘেরাও করে বাসায় তল্লাশির নামে পরিবারের লোকজনকে হয়রানি করেছে। এর আগেও আরও দুই দিন পুলিশ এসে বাসা তল্লাশি করেছে। এতে করে পরিবারসহ আশেপাশের লোকজন এখন সার্বক্ষণিক ভয়-আতঙ্কে দিন কাটায়। হামলা ও হুমকির ঘটনায় অধিকাংশ সময় মুখ খুলছেন না ভুক্তভোগীরা। যারা সাহস করে রিটার্নিং অফিসারের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন তারা প্রতিকার পাননি।
গত ১৬ই এপ্রিল নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করেছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী বিএনপি সমর্থিত মাসুদ খান। সাত দিন পেরিয়ে গেলেও এর কোন প্রতিকার পাননি তিনি। এমনকি প্রতিপক্ষের হুমকি-ধমকি ও পুলিশি হয়রানির কারণে প্রচারণা চালাতে পারেননি মাসুদ খান। তার পক্ষে মাইকে প্রচারণা চালানোর সময় এক কর্মীকে আটক করে নিযে যায় দারুস সালাম থানার এসআই মনির। যে কারণে মাসুদ খান গতকাল পর্যন্ত প্রকাশ্যে ভোট চাইতে পারছেন না। একইভাবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী নবী সোলায়মানও নির্বাচনী কার্যক্রম চালাতে পারছেন না। পুলিশ দিয়ে তাকে হয়রানি করছেন ক্ষমতাসীন দলের সমর্থিত প্রার্থী ও তাদের লোকজন। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পাননি তিনি। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি-না এ নিয়ে সংশয়ে আছেন প্রার্থীরা। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান জানান, আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা ফরিদুর রহমান খান ইরানের লোকজন তাদের হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। বিভিন্নস্থানে পোস্টার পর্যন্ত সাঁটাতে দেয়া হচ্ছে না তাদেরকে। এমনকি বহিরাগত সন্ত্রাসী দিয়ে মহড়া দিচ্ছেন ইরান। ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী ইকবাল হোসেন জানান, নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করে কোন প্রতিকার পাননি। হামলার সঙ্গে গ্রেপ্তার আতঙ্কে প্রচারণায় নামতে পারছেন না বিএনপি ও জামায়াত সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীরা। গত ১৩ই এপ্রিল ঢাকা উত্তর সিটির ১১ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী এএলএম কাওছার আহম্মেদকে গ্রেপ্তার করে মিরপুর থানা পুলিশ। বিএনপি দাবি করেছে, প্রচারণা চালানোর সময় অন্যায়ভাবে তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। ১৮ই এপ্রিল রাজধানীর চামেলীবাগে নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী কাজী হাসিবুর রহমান ওরফে শাকিলকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ২০শে এপ্রিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী ও হাজারীবাগ থানার ৪৭ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি ওসমান গণি শাহজাহানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। শাহজাহানের স্ত্রী নাসিমা ওসমান দাবি করেন, তার স্বামী আদালত থেকে জামিন নিয়েই মনোনয়নপত্র দাখিল ও নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছিলেন। কিন্তু ভোটের প্রচারণায় নামলে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়। গতকাল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৫নং ওয়ার্ডের বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী আবুল খায়ের বাবলুকে আটক করেছে পুলিশ। উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৩৬নং ওয়ার্ডে বিরোধীজোটের কাউন্সিলর প্রার্থী মাওলানা সালেহ সিদ্দিকীর লাটিম প্রতীকের সমর্থনে বিকাল ৫টায় মধুবাগ এলাকায় মাইকিং করতে গেলে স্থানীয় যুবলীগ নেতার নেতৃত্বে কতিপয় নেতাকর্মী বাধা প্রদান করে এবং রিকশাচালককে আটকে রেখে মারধর করে ও মাইকম্যানের কাছ থেকে ৩ হাজার টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। শুক্রবার বাদ জুমা নয়াটোলা মাদরাসা এলাকায় গণসংযোগকালে লাটিম প্রতীকের ২জন কর্মীকে পুলিশ আটক করে নিয়ে যায়। এ পর্যন্ত তার নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় ২০জন কর্মীকে আটক করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ।

No comments

Powered by Blogger.