চট্টগ্রামে হামলা হুমকি, ভাঙচুর by কাজী সুমন ও জাহিদ হাসান

দুদিন পরেই প্রতীক্ষিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন। নির্বাচিত হবেন দেশের অন্যতম বাণিজ্যিক এই শহরের নগরপিতা। কিন্তু শহরের সর্বত্রই বিরাজ করছে আতঙ্ক। প্রতিদিনই হামলা হচ্ছে বিরোধী প্রার্থীদের প্রচারণায়। ভাঙচুর করা হচ্ছে গণসংযোগের গাড়ি। ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে প্রচারণার মাইক। গত কয়েক দিনে নির্বাচনী সহিংসতায় নিহত হয়েছেন দুজন। আহত হয়েছেন অনেকে। এছাড়া বহিরাগত ক্যাডারদের আনাগোনাও দেখা যাচ্ছে নগরীতে। এতে নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে পৌঁছা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে সাধারণ ভোটারদের মাঝে। সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয়ার ২৪ ঘণ্টা পরই নির্বাচন কমিশনের ইউটার্নে তাদের এই শঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। জানা গেছে, গত কয়েকদিন ধরে অব্যাহতভাবে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের গণসংযোগে হামলা চালানো হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার নগরীর বায়েজিদ এলাকায় মনজুর আলমের গণসংযোগে ব্যবহৃত ট্রাকে এক ছাত্রলীগ নেতার নেতৃত্বে ৩০ থেকে ৪০ জন হাতিমার্কার সমর্থক হামলা চালায়। এ সময় তারা ট্রাক ভাঙচুর ও ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে। বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে চালক, মাইকম্যানসহ কর্মীদের মারধর করা হয়। পরে তারা মাইক ব্যাটারিসহ অন্যান্য মালামাল নিয়ে যায়। এছাড়া ওই রাতেই বাকলিয়া ডিসি রোড এলাকায় মনজুর আলমের নির্বাচনী গণসংযোগের পর সন্ত্রাসী ফরিদ বাহিনীর প্রধান ফরিদের নেতৃত্বে ১৫ থেকে ২০ জন সন্ত্রাসী অস্ত্র নিয়ে কালাম কলোনিসহ বিভিন্ন এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করে। তারা এলাকার শান্তিপ্রিয় লোকদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে। এর আগে ১১ই এপ্রিল শেরশাহ এলাকার ব্রিকফিল্ড রোডে সৈয়দ ওয়াহিদুল আলমের ওপর হামলা চালিয়ে নির্বাচনী কার্যালয় ভাঙচুর করে। ওই ঘটনায় আহত হন ১০ থেকে ১২ জন। ২১শে এপ্রিল পলিটেকনিক এলাকায় গণসংযোগকালে তার ওপর হামলা চালানো হয়। এতে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে অন্তত ১০ জন আহত হন। এ সময় গাড়ি, হ্যান্ডমাইক, লিফলেট ও ব্যানার ছিনিয়ে নিয়ে যায় তারা। ওদিকে ১৬ই এপ্রিল রাতে টাইগার পাস এলাকার মালিপাড়ায় আওয়ামী লীগের দুই কাউন্সিলর প্রার্থী শহীদুল ইসলাম শামীম ও এসআই কবির দ্বন্দ্বে খুন হন ছাত্রলীগ কর্মী মো. সাদ্দাম। দুই পক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার এক পর্যায়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। এর ২৪ ঘণ্টা না পেরুতেই নগরীর বাকলিয়ার মিয়াখান নগর এলাকায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় যুবদল কর্মী নাছির উদ্দিনকে। দক্ষিণ বাকলিয়ার ১৯নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. হুমায়ুন কবির বলেন, আমরা নির্বাচনের দিন আমাদের ভোট দিতে পারব কি নাÑ এই নিয়ে শঙ্কিত। কারণ স্থানীয় প্রভাবশালী প্রার্থীরা কেন্দ্র দখলের নানা কৌশল করছেন। বস্তিগুলোর ভোটাররা যাতে কেন্দ্রে যেতে না পারে সেজন্য পথেই বাধা দেয়া হবে শোনা যাচ্ছে। তবে সেনাবাহিনী দায়িত্ব পালন করলে আমরা নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারতাম।  নগরীর হালিশহর এলাকার ২৫নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা ভোটার নজরুল ইসলাম বলেন, এখন এলাকার পরিস্থিতি শান্ত হলেও ভোটের দিন গ-গোলের আশঙ্কা রয়েছে। তাই  ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিয়ে কিছুটা শঙ্কিত।  চকবাজার এলাকার ১৬ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমরা সাধারণ মানুষ। ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার নিরাপত্তা চাই। শোনা যাচ্ছেÑ যারা সিদুর-শাঁখা পরে আসবেন তাদের জামাই আদরে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়া হবে। আর যারা বোরকা পরে আসবেন তাদের জামায়াত-শিবির বলে তাড়িয়ে দেয়া হবে। দক্ষিণ বাকলিয়া এলাকার ১৯ নং ওয়ার্ডের  বাসিন্দা মো. ইউনূস মিয়া বলেন, যারা সাধারণ ভোটার তাদের সবার মধ্যে একটা ভয়ভীতি ও আতঙ্ক বিরাজ করছে। কিন্তু সুষ্ঠু ভোট হলে আসল চিত্র দেখা যাবে। একটি উদাহরণ দিয়ে ক্ষুদ্র এই ব্যবসায়ী বলেন, গ্রামে বৃষ্টি হলে ক্ষেতের আলু যেমন বেরিয়ে আসে, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তেমন প্রকৃত জনপ্রতিনিধি বিজয়ী হয়ে আসবেন। পাহাড়তলী এলাকার ১৩ নং ওয়ার্ডের খাদিজা বেগম বলেন, আমরা নিরাপদে ভোট দিতেই চাই। নির্বাচন কমিশনের কাছে আমরা এই দাবি জানাচ্ছি। তবে যেভাবে চারদিকে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে তাতে সুষ্ঠু পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছি। এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম সিটির ২০ দলীয় জোটের মেয়র প্রার্থী মনজুর আলম বলেন, গত বৃহস্পতিবার আমার গণসংযোগে ব্যবহৃত গাড়িটি হাতি মার্কার সমর্থকরা ভাঙচুর করেছে। প্রচারণার মাইক ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। প্রতিনিয়ত পাড়া-মহল্লায় আমার কর্মী-সমর্থকদের হুমকি-ধামকি দেয়া হচ্ছে। তার ওপর সরকারের চাপে নির্বাচন কমিশন সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। এতে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে। তাই অবিলম্বে বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে সেনা মোতায়েনের দাবি জানাচ্ছি। সাধারণ ভোটারদের ভোটদানে নিরাপত্তা প্রদানের দাবি জানিয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আ জ ম নাছির উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, আমার বিরোধী প্রার্থী মনজু সাহেব (মনজুর আলম) ভোটারদের নানা উসকানিমূলক কথাবার্তা বলে তাদের বিভ্রান্ত করছেন। আমি আশা করবোÑ এই ব্যাপারে কমিশন ব্যবস্থা নেবে। এবার নির্বাচনে প্রবীণ, বৃদ্ধদের পাশাপাশি নতুন ভোটারদের দেখা যাবে বলে আশা করছি। তিনি আরও বলেন, এই মুহূর্তে পরিবেশ আমার অনুকূলে রয়েছে। ৪১টি ওয়ার্ডে আমার সব নেতাকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চাইছেন। মানুষ পরিবর্তনের পক্ষে। তবে কেন্দ্র দখলের কোন ধরনের ষড়যন্ত্র হলে তা সাধারণ ভোটাররা তা প্রতিহত করবে। এই ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতা জরুরি। সুষ্ঠু ভোট হলে বিপুল ভোটে জয়লাভ করবো। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক প্রধান নির্বাচন কর্মকর্তা আবদুল বাতেন মানবজমিনকে বলেন,  ঢাকার চেয়ে চট্টগ্রামের নির্বাচনের পরিবেশ ভাল। তুলনামূলক সহিংসতার ঘটনাও কম ঘটছে। প্রার্থীদের আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনাও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে।  এই পর্যন্ত ৭০টি আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ নির্বাচন কমিশনে এসেছে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে সবগুলো ঘটনার বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিয়েছি এবং আমাদের নির্দেশনা প্রশাসনও বাস্তবায়ন করেছে। ভোটের দিন প্রভাবশালী প্রার্থীদের প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে তিনি বলেন, চট্টগ্রামের ৪১টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতেই একাধিক কাউন্সিলর প্রার্থী রয়েছেন। এছাড়া সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলরও রয়েছেন। তারা কেউ কাউকে ছাড় দেবেন না। তবে আমাদের পর্যাপ্ত সংখ্যক র‌্যাব, পুলিশ মোতায়েন থাকবে। স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে সেনাবাহিনী প্রস্তুত থাকবে। তিনি বলেন, আমরা ৫৯১টি  ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের তালিকা করেছি। এই কেন্দ্রগুলোতে আলাদা নজর দেয়া হবে। সাধারণ কেন্দ্রগুলোর চেয়ে ওই কেন্দ্রগুলোতে অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করা হবে। এছাড়া ভোটারদের আসা-যাওয়ার পথে ও স্পর্শকাতর জায়গায় নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.