৩ সিটিতেই চ্যালেঞ্জে আওয়ামী লীগ by লুৎফর রহমান ও মহিউদ্দীন জুয়েল

ঢাকার দুটি ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি আওয়ামী লীগ। এ তিন সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগ একক প্রার্থী দিলেও বিরোধী জোটের প্রার্থীকে নিয়ে চিন্তিত সংশ্লিষ্ট মেয়র প্রার্থী ও তাদের সমর্থকেরা। চট্টগ্রামে মনজুর আলমকে বিএনপি ও ২০ দলের পক্ষ থেকে সমর্থন দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত ঢাকায় কোন প্রার্থীকে সমর্থন দেয়নি ২০ দল। আগামী দু-এক দিনের মধ্যে প্রার্থীর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা জানিয়েছেন তারা। ঢাকার দুই সিটিতে একক প্রার্থী দেয়া হচ্ছে জোটের পক্ষ থেকে। এক্ষেত্রে জোট সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশনাও আসছে শিগগির। এখন পর্যন্ত ২০ দলের তরফে তেমন কোন তৎপরতা না থাকলেও প্রার্থী চূড়ান্ত হওয়ার পর আন্দোলনের অংশ হিসেবেই নির্বাচনী কাজে যোগ দেবেন জোটের নেতা-কর্মীরা। বরং আন্দোলনে গতি আনতে নেতা-কর্মীদের প্রকাশ্যে আসার এটি সুযোগ বলেও মনে করছেন অনেকে। অন্যদিকে দল সমর্থিত প্রার্থীকে বিজয়ী করে আনাকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে আওয়ামী লীগ। এ লক্ষ্যে তফসিল ঘোষণার পর থেকেই শুরু হয়েছে নানামুখী তৎপরতা। দলীয় সূত্র জানায়, বিরোধী জোটের চলমান আন্দোলনের কারণে সারা বিশ্বের নজর এখন বাংলাদেশের ওপর। এমন অবস্থায় সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ফল অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এতদিন দুই পক্ষের মধ্যে সংলাপ ও রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য যেসব কূটনীতিক দৌড়ঝাঁপ করছিলেন তাদেরও দৃষ্টি এখন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। সরকার ও আওয়ামী লীগ বিরোধী জোটের দাবি ও আন্দোলনে জনসমর্থন নেই বলে যে দাবি করে আসছে সিটি নির্বাচনের ফলে দাবির নেতিবাচক প্রতিফলন ঘটতে পারে বলেও মনে করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। এ কারণে যে কোন মূল্যে সিটি নির্বাচনের ফল ঘরে রাখতে চান তারা। যদিও শুরু থেকে বিরোধী জোট নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড করার দাবি জানিয়ে আসছে। শেষ পর্যন্ত এ দাবি পূরণের ওপরই নির্ভর করবে বিরোধী জোটের নির্বাচনে থাকা না থাকা। তিন সিটিতেই দল সমর্থিত প্রার্থীকে জয়ী করে আনতে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে থেকেই তৎপরতা শুরু হয়েছে। তফসিল ঘোষণার পর খোদ দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারি বাসভবন গণভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দল সমর্থিত প্রার্থীদের ডেকে নিয়ে নগর নেতাদের সামনে পরিচয় করিয়ে দেন। গত ২৭শে মার্চ অনুষ্ঠিত বৈঠকে তিনি দল সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার নির্দেশ দেন। দলের নির্দেশ না মানলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে দলের দুই নেতা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য শুরু থেকে মাঠে থাকায় অনেকটা অস্বস্তি ছিল দলীয় হাইকমান্ডে। সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফপুত্র সাঈদ খোকন ও সংসদ সদস্য হাজী সেলিম নির্বাচন করতে অনড় থাকায় দল সমর্থিত একক প্রার্থী নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। যদিও দল সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে আগেই নাম ঘোষণা করা হয়েছিল সাঈদ খোকনের। তবে দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশে শেষ পর্যন্ত হাজী সেলিম নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোয় অনেকটা স্বস্তি ফিরে নেতাকর্মীদের মাঝে। তবে ওই সিটি করপোরেশনে হাজী সেলিমের নিজস্ব ভোট ব্যাংক থাকায় এখনও শঙ্কা কাটেনি সাঈদ খোকনের। নির্বাচনে যাতে হাজী সেলিম পূর্ণ সহযোগিতা করেন সেজন্য দলের কেন্দ্রীয় নেতারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যেও বিভক্তি রয়েছে। এমন অবস্থায় দলীয় প্রার্থীর সাফল্য ঘরে তুলতে দলীয় কোন্দল মেটানো ও হাজী সেলিমের সমর্থকদের সাঈদ খোকনের পক্ষে নামানোর তৎপরতাও শুরু করেছেন নেতারা। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গতকাল চকবাজার মসজিদে সাঈদ খোকন ও হাজী সেলিম এক সঙ্গে নামাজ পড়ে এক সঙ্গে দুপুরের খাবার খান। আগের দিন ১৪ দলের সমন্বয়ক মোহাম্মদ নাসিমের বাসায় এক ঘরোয়া বৈঠকেও এ বিষয়ে আলোচনা হয়। ওই বৈঠকে দলের বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাসিম, উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এমএ আজিজ, সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, হাজী সেলিম ও সাংগঠনিক সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক সূত্র জানায়, দল সমর্থিত প্রার্থী সাঈদ খোকনকে বিজয়ী করতে সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আলোচনা করেন নেতারা। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোয় হাজী সেলিমের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে যে হতাশা তৈরি হয়েছে তা কাটাতে নির্বাচনী প্রচারণায় হাজী সেলিমকে অংশ নেয়ারও অনুরোধ করেন কেন্দ্রীয় নেতারা। এতে হাজী সেলিম সায়ও দেন। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সাঈদ খোকনকে নিয়ে এক সঙ্গে জুমার নামাজ পড়েন হাজী সেলিম। দলীয় সূত্র জানায়, দৃশ্যত দুই প্রার্থীর মধ্যে সমঝোতা হলেও এখনও দুই পক্ষের নেতাকর্মীরা একসঙ্গে কাজ করা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। এ কারণে নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা সমস্যা চিহ্নিত করে সামনে আরও চেষ্টা চালাবেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে ঢাকা উত্তরেও একই ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের সামনে। এ সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগের সমর্থন পাওয়া ব্যবসায়ী নেতা আনিসুল হক আগে দলের সঙ্গে তেমন সম্পৃক্ত ছিলেন না। এ কারণে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তার সেরকম ঘনিষ্ঠতা নেই। এ সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি সারাহ বেগম কবরী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এতেও দলীয় প্রার্থীর ভোটের ওপর প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা। এ সিটি করপোরেশনে এখন পর্যন্ত বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী চূড়ান্ত না হওয়ায় নিজেদের পরিকল্পনা এখনও চূড়ান্ত করেনি আওয়ামী লীগ ও ১৪ দল। এ সিটি করপোরেশনে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টু মনোনয়নপত্র দাখিল করলেও সামান্য ভুলের কারণে তা বাতিল হয়ে যায়। এ বিষয়ে তার করা আপিলের শুনানি আজ হওয়ার কথা রয়েছে। মিন্টুর মনোনয়নপত্র বাতিল বহাল থাকলে এখানে অন্য কোন প্রার্থীর প্রতি সমর্থন দিতে পারে ২০ দলীয় জোট। এক্ষেত্রে সাবেক প্রেসিডেন্ট বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ছেলে ও বিকল্প ধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহি বি চৌধুরী বা আবদুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে তাবিথ আউয়াল ২০ দলের সমর্থন পেতে পারেন। এক্ষেত্রে সরকারি দলের নির্বাচন পরিকল্পনায়ও পরিবর্তন আসবে। দলীয় নেতারা মনে করছেন, এখানে ২০ দল যাকেই সমর্থন দিক না কেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে নির্বাচনে। এদিকে আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচনে ১৪ দল এখন পর্যন্ত তাদের সমর্থনের বিষয়টি চূড়ান্ত করেনি। প্রার্থী সমর্থন দেয়ার বিষয়ে শুরুতে আলোচনা না করায় ১৪ দলের অন্য শরিকদের মধ্যে অন্তোষ রয়েছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বৈঠকে তাদের এ অসন্তোষের কথা জানিয়েছেন নেতারা।
এদিতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরিবেশ অনুকূলে থাকার পরও দলীয় প্রার্থীর জয় নিয়ে চিন্তিত আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানায়, মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সহসভাপতি আ জ ম নাছির উদ্দিনকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে ঘোষণার পর প্রথমে আলোচনায় আসে দলীয় কোন্দল। বিষয়টি স্বয়ং সভানেত্রী শেখ হাসিনা মিটমাট করার পর সাবেক মেয়র ও নগর সভাপতি মহিউদ্দিন চৌধুরী, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম ও সাবেক সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম বিএসসি দ্বন্দ্ব ভুলে নাছিরের পক্ষে কাজ করার ঘোষণা দেন। কিন্তু দ্বন্দ্বের চ্যালেঞ্জ কিছুটা কাটিয়ে উঠতে পারলেও জিতে আসার ব্যাপারে তাদের শঙ্কা কাজ করছে এখনও। যা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়েছে গত ৩১শে মার্চ দুপুরে মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেনের হোটেল পেনিনসুলায় আয়োজিত দলীয় প্রার্থীর পক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকে। সেখানে উপস্থিত অধিকাংশ নেতা যে কোন মূল্যে দলীয় প্রার্থী নাছিরকে জেতাতে কাজ করার ঘোষণা দেন। এই সময় মন্ত্রী মোশারফ সবার উদ্দেশ্যে বলেন, নাছিরকে যে কোন মূল্যে জিতিয়ে আনতে হবে। নইলে প্রেস্টিজ থাকবে না। মনে রাখবেন মাঠ আমাদের দখলে রয়েছে। কিন্তু তারপরও যদি জিততে না পারি তাহলে কারও রাজনীতি করার দরকার নেই। তিনি দ্বন্দ্বের বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, পত্রিকায় দেখি মহিউদ্দিনের সঙ্গে নাছিরের দ্বন্দ্ব। ছালামের মন খারাপ। অভিমান করে আছেন বিএসসি। এসব খবর আমাদের ভোট কমিয়ে দেবে। তাই এমন কোন কথা যেখানে সেখানে বলবেন না, যাতে বিরোধী দলের প্রার্থী সহজে জিতে যায়। বৈঠকে মোশরফ ছাড়াও    দলটির একাধিক প্রতিমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সভাপতি, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, সাবেক এমপিসহ অন্তত ২০ জন নেতা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে সরকারি দলের প্রার্থী আ জ ম নাছিরের পক্ষে পুলিশ কমিশনারের কথা বলায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে ভোটারদের মাঝে। আর এই নিয়ে শঙ্কা কাজ করছে দলের নেতাদের মাঝেও অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন প্রকাশ্যে সরকারি নেতাদের মিছিল-সমাবেশ করে ভোট চাওয়ার পরও নীরবতা পালন করায় তাদের দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এসব অভিযোগ ২৮শে এপ্রিল অনুষ্ঠেয়  নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে বলে অনেকের ধারণা।
আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আ জ ম নাছির উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, নির্বাচনে আমি বিপুল ভোটে জয়লাভ করবো। দীর্ঘদিন ধরে কাজ করার বাসনা পুষে রেখে সব ওয়ার্ডে কর্মী সাজিয়েছি। তাছাড়া সভানেত্রীর নির্দেশে আওয়ামী লীগের সব নেতা আমার পক্ষে কাজ করার ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। আমি ফেয়ার রাজনীতি করি। এই শহরকে মেগাসিটিতে পরিণত করবো। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই জয়লাভ করতে চাই।
অন্যদিকে বিএনপি নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান গতকাল সন্ধ্যায় মানবজমিনকে বলেন, আওয়ামী লীগ প্রার্থী নাছিরের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আছে। যা মনজুরের বিরুদ্ধে নেই। তিনি একজন নিষ্ঠাবান মানুষ। গত ৫ বছর সরকারের সহযোগিতা অনেক ক্ষেত্রে না পেয়েও করপোরেশনকে মডেল হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। সরকারি দলের লোকজন কেন্দ্র দখলের খবর ছড়াচ্ছে। এতে মানুষের মনে ভয় ঢুকে গেছে। চট্টগ্রাম নির্বাচন কমিশনের রিটার্নিং অফিসার আবদুল বাতেন বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা হতে দেবো না। পুলিশ প্রশাসন এখানে সহযোগিতা করবে। আমরা সব প্রার্থীর প্রতি সমান আচরণ করবো।

No comments

Powered by Blogger.