‘ড্রাগন ফল’ প্রসারে দুর্নীতি- প্রকল্প পরিচালক নিজেই যখন চারা ব্যবসায়ী by দীন ইসলাম

দেশে বাণিজ্যিকভাবে ড্রাগন ফল প্রসারের প্রকল্পে যেন দুর্নীতির আছর লেগেছে। এ ফল চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও এ নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের শীর্ষ ব্যক্তিরা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ায় তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ড্রাগন ফল চারা ব্যবসায় জড়িয়ে গেছেন সমন্বিত মানসম্পন্ন উদ্যান উন্নয়ন বা ড্রাগন ফল সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিচালক এস এম কামরুজ্জামান। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে থাইল্যান্ডের এ জনপ্রিয় ফল চাষের কার্যক্রম শুরু হয় ২০১০ সালে। তখন থেকে নাটোর ও রাজবাড়ীর দুটি হর্টিকালচার সেন্টারে শুরু হয় এর পরীক্ষামূলক চাষ। পরে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েও এ দেশে ফলটি চাষের উপযোগিতা পরীক্ষা করে দেখা হয়। এতে বাংলাদেশের আবহাওয়ায় ড্রাগন ফল চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দেয়ায় সরকার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে এর চারা বা কাটিং বিতরণের উদ্যোগ নেয়। সরকারের এ সিদ্ধান্তে মওকা পেয়ে যায় অধিদপ্তরের এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা। তারা নিজেদের মালিকানাধীন হর্টিকালচার সেন্টারে ফলটির চারা বা কাটিং উৎপাদন করে তা সরকারের কাছে অধিক মূল্যে বিক্রি করার ব্যবসা খুলে বসে। এস এম কামরুজ্জামান মানসম্পন্ন উদ্যান উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে বিনামূল্যে সরকার নির্ধারিত উন্নতজাতের ড্রাগন ফলের চারা বা কাটিংয়ের পরিবর্তে কৃষকদের কাছে গছিয়ে দিতে শুরু করেন নিম্নমানের ব্যক্তি মালিকাধীন হর্টিকালচার সেন্টারের চারা। সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় বীজ বোর্ডের অনুমোদনক্রমে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই) এবং বাংলাদেশ কৃষি বিদ্যালয় কর্তৃক অবমুক্ত চারটি জাত থাকা সত্ত্বেও ড্রাগন ফল সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিচালক এস এম কামরুজ্জামান নিজের নার্সারির ড্রাগন ফলের কাটিংয়ের ভিন্ন ভিন্ন ৬টি নাম দিয়ে তা সরকারের কাছে বিক্রি করে কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করে আসছেন। এখানেই শেষ নয়, এর বাইরে ডিএইর ৪৩টি হর্টিকালচার সেন্টারের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়ার নাম করে স্থানীয়ভাবে ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে অর্থ তুলে তা লোপাট করার ঘটনাও ঘটিয়েছেন। ডিএই সূত্রে জানা গেছে, লাভবান হতে প্রকল্প পরিচালক নিজের নার্সারি থেকে গত এক বছরে প্রায় ১ লাখ ড্রাগন ফলের কাটিং দেড় কোটি টাকায় বিক্রি করেছেন। প্রদর্শনী ক্ষেতে প্রয়োজনীয় উপকরণ না দিয়ে কৃষকদের বাধ্য করা হয়েছে কেবল কাটিং নিতে। সব ক্ষেত্রেই লঙ্ঘন করা হয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা। ফলে অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ড্রাগন ফলের জাত সম্প্রসারণে আসছে না কাঙ্ক্ষিত গতি। ২০১২ সালের ৫ই ডিসেম্বর কৃষি মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত প্রকল্প সমন্বয় কমিটির সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রকল্পের প্রদর্শনী বাস্তবায়নে বিএআরআইয়ের অনুমোদিত জাত ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়া হয়। তবে ওই নির্দেশনা থোড়াই কেয়ার করে প্রকল্প পরিচালক বিএআরআই থেকে একটিও ড্রাগন ফলের চারা বা কাটিং না কিনে সরকারি মূল্যের তিন গুণ বেশি মূল্যে (সরকারি মূল্য প্রতি কাটিং ৫০ টাকা, প্রকল্প পরিচালক সরবরাহ করেন ১৫০ টাকায়) নিজের নার্সারি (মর্ডান হর্টিকালচার সেন্টার, নাটোর) ও বেনামে চালিত নার্সারি থেকে প্রায় ১ লাখ কাটিং বিক্রির মাধ্যমে হাতিয়ে নেন দেড় কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা জানান, দেখতে ক্যাকটাসের মতো ড্রাগন ফলের গাছগুলোতে ফল আসতে রোপণের পর এক থেকে দেড় বছর সময় লাগে। এরপর গাছগুলো একাধারে ২০ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত ফল দিয়ে যায়। এ কারণে ড্রাগন ফল চাষের ব্যয় যথেষ্ট কম। টক মিষ্টি স্বাদের এ ফলটি এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপে ব্যাপক জনপ্রিয়। ওই সব দেশে উচ্চমূল্যে ড্রাগন ফল বিক্রি হয়। প্রতি কেজি ড্রাগন ফল ২০০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। ফলটিতে উচ্চমাত্রায় পুষ্টিগুণ থাকায় এটি উচ্চরক্তচাপ এবং ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। এ কারণে ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়ার উন্নত দেশগুলোতে ড্রাগন ফলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ড্রাগন ফল চাষের সঙ্গে জড়িত এক কৃষক জানান, ড্রাগন ফল চাষপদ্ধতি মোটেও কঠিন নয়। প্রথমে মাটি কুপিয়ে গর্ত করে নিতে হয়। এরপর পরিমিত টিএসপি ও জিপসাম অথবা গোবর সার ব্যবহার করে গর্তে ড্রাগন ফলের চারা রোপণ করতে হয়। চারা রোপণের পর গাছটি বেড়ে ওঠার জন্য অবশ্যই খুঁটি ব্যবহার করতে হবে। তিনি জানান, ড্রাগন ফলের জন্য নির্দিষ্ট কোন মাঠের প্রয়োজন নেই। রাস্তার ধারে, বাড়ির আঙিনায় অথবা যে কোন শুষ্ক স্থানে ড্রাগন ফলের বাগান করা যায়। ক্যাকটাস প্রজাতির ড্রাগন গাছগুলো ৫০ ভাগ খাবার সংগ্রহ করে বাতাস থেকে। বাকি ৫০ ভাগ মাটি থেকে। এ কারণে ড্রাগন ফল চাষে সারের ব্যবহার তেমন একটা প্রয়োজন হয় না। সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, কেবল ড্রাগন ফলের উন্নত জাত সরবরাহেই অনিয়মের আশ্রয় নেননি প্রকল্প পরিচালক। পাশাপাশি প্রকল্পের টাকায় নিয়মিতভাবে বিদেশ ভ্রমণেও যান তিনি। এরই মধ্যে তিনি ভিয়েতনামে তিনবার, ভারত, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে একাধিকবার ভ্রমণে গিয়ে নিজের নার্সারির জন্য ড্রাগন ফলের উন্নত জাত সংগ্রহ করেছেন। সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয় কর্মকর্তাদের আসন্ন ভিয়েতনাম সফরেও ডিএই কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ প্রকল্প পরিচালক নিজের নাম ভ্রমণ দলে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন। প্রশিক্ষণের নামে ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগও রয়েছে তার নামে। জানা যায়, ২০১২ সালের ২ থেকে ৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি ঢাকায় সদর দপ্তরে অবস্থান করলেও কাগজে-কলমে তিনি ছিলেন যশোরের খয়েরতলার হর্টিকালচার সেন্টারে। সেখানে ২ ও ৩রা ডিসেম্বরে তিনি অংশ নেন প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে। আর ভাউচার বানিয়ে তুলে নেন ৩ হাজার টাকা। একইভাবে ৪ ও ৫ই ডিসেম্বর তার অবস্থান দেখানো হয় রাজবাড়ী হর্টিকালচার সেন্টারে। এখানেও প্রশিক্ষণ দিয়েছেন মর্মে ভাউচার বানিয়ে তুলে নেন ৩ হাজার টাকা। ৯ ও ১০ই ডিসেম্বর আবার ঢাকার সদর দপ্তরে অবস্থান করেও ভাউচারের যশোরের খয়েরতলায় অবস্থান দেখিয়ে তুলে নেন আরও ৩ হাজার টাকা। এভাবে নানা সময়ে ভুয়া ভাউচারের লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের প্রমাণপত্র রয়েছে সংশ্লিষ্ট অনেক কর্মকর্তার কাছে। ড্রাগন ফলের সম্প্রসারণ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক এক উদ্যানতত্ত্ববিদ জানান, হর্টিকালচার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সব ব্যবসায়ীই জানেন পদে থেকে কামরুজ্জামান কিভাবে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। নিজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে প্রকল্প পরিচালক এস এম কামরুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হচ্ছে তার সব মিথ্যা। আমার সামনে লোক আছে তাই এসব অভিযোগের বিপরীতে কথা বলতে একটু লজ্জা পাচ্ছি। আপনি সামনা সামনি আসুন দুজনে মিলে চা খাওয়া যাবে। ওই সময় সব প্রশ্নের জবাব দেয়া যাবে।

No comments

Powered by Blogger.