চট্টগ্রামে মনজুরের পরীক্ষা নাছিরের প্রেস্টিজ by শহীদুল্লাহ শাহরিয়ার

২০১০ সালের ১৭ জুন যখন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তখন ছিল ঘোর বর্ষা। নির্বাচনের একদিন আগেও ছিল মুষলধারার বৃষ্টি। পুরো নগরী রীতিমতো ভাসছিল পানিতে। ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সেই মোক্ষম অস্ত্রটি তখন কাজে লাগিয়েছিলেন বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী এম মনজুর আলম। বলা হয় নগরজুড়ে বর্ষার অথৈ পানি তিনবারের নির্বাচিত মেয়র আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর জয় ভাসিয়ে নিয়েছিল। জলাবদ্ধতা মুক্ত নগরীর প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রায় এক লাখ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন এম মনজুর আলম। এবারও তিনি বিএনপির সমর্থন নিয়ে প্রার্থী হয়েছেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই সেই প্রশ্নটি সামনে চলে এসেছে। গত ৫ বছরে মনজুর আলম জলাবদ্ধতা নিরসনে কতটুকু সফল হয়েছেন। কিংবা জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে আদৌ মুক্ত হয়েছে কী নগরবাসী? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেই এবার ভোট দেয়ার সিদ্ধান্ত নেবেন ১৮ লাখ ভোটার। এ কারণেই ২৮ এপ্রিলের নির্বাচন মনজুর আলমকে এক কঠিন ‘চ্যালেঞ্জের’ মুখোমুখি দাঁড় করাবে। এবার দৃশ্যপটে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী না থাকলেও তারই শিষ্য ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন হয়েছেন মনজুর আলমের প্রতিদ্বন্দ্বী। জলাবদ্ধতার সেই অস্ত্রটি এবার ব্যবহার করতে চান তিনি। নাগরিক কমিটির ব্যানারে নির্বাচনী কাতারে আসা এ প্রার্থী দলীয় সমর্থন পাওয়ার পর নিজেই ঘোষণা করেছেন নির্বাচিত হলে তিনি সবার আগে নগরীকে স্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করার কাজে হাত দেবেন। তা ছাড়া তিনবারের মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, সাবেক এমপি নুরুল ইসলাম বিএসসি এবং চউক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামের মতো মনোনয়নপ্রত্যাশী শীর্ষ নেতাদের রেখে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা আ জ ম নাছির উদ্দিনকে মনোনয়ন দিয়ে চমক সৃষ্টি করায় এ নির্বাচনে জিতে আসা তার জন্য ‘প্রেস্টিজ’ ইস্যু বলেই মনে করেন নাছির। এখন দেখার বিষয় কঠিন চ্যালেঞ্জে জিতবেন মনজুর না প্রেস্টিজ রক্ষায় সফল হবেন নাছির। তবে তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ২৮ এপ্রিল সন্ধ্যা পর্যন্ত।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাধারণ বাসিন্দা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু জলাবদ্ধতাই চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের একমাত্র বা প্রধান ইস্যু হবে না। এ নির্বাচনে ভোটারের সামনে চলে আসবে রাজনৈতিক-সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক আরও অনেক ইস্যু। নামে স্থানীয় নির্বাচন হলেও মূলত এ নির্বাচনেও লড়াই হবে আওয়ামী লীগ-বিএনপিতে। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে না পারার দুঃখ যেমন রয়েছে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে তেমনি আবার সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে পেট্রলবোমা মেরে মানুষ হত্যা ও আগুন সন্ত্রাসের বিষয়েও চিন্তা করবেন ভোটাররা। তাই অন্যবারের তুলনায় এবারের নির্বাচনী সমীকরণ হবে জটিল ও ব্যতিক্রম।
বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী এম মনজুর আলমের বিরুদ্ধে যেমন রয়েছে কর্পোরেশন পরিচালনায় দুর্বলতা, বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী হলেও দলীয় রাজনীতির সঙ্গে বা মাঠে-ময়দানে না থাকা, কর্পোরেশনে দলীয় নেতাকর্মীদের সুযোগ-সুবিধা না দেয়া, সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর পরামর্শে ‘কর্পোরেশন’ পরিচালনার অভিযোগ, তেমনি আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আ জ ম নাছিরের বিরুদ্ধেও রয়েছে অধিপত্য বিস্তার, অতীতে ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা করা, চট্টগ্রামের শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়া বা তৃণমূলে ভিত্তি নিয়ে সীমাবদ্ধতা থাকাসহ নানা অভিযোগ। জনপ্রতিনিধি হিসেবে প্রথম নির্বাচনে আসা এ প্রার্থী জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো কতটুকু অনুধাবন করতে পারবেন সে প্রশ্নও আসছে।
জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে জয়ী হলেও নগরীকে কতটুকু জলাবদ্ধতামুক্ত করতে পেরেছেন এমন প্রশ্নের কৌশলী জবাব দেন মনজুর আলম। শুক্রবার বিকালে তিনি যুগান্তর প্রতিবেদককে বলেন, ‘এটি কমন প্রশ্ন হলেও এ প্রশ্নের উত্তর হুট করে দেয়া যাবে না। ভেবেচিন্তে দিতে হবে।’ নতুন কোনো প্রতিশ্র“তি বা অন্য কোনো অভিযোগ সম্পর্কেও তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি।’ তবে এর আগে বিভিন্ন সময়ে তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা এখন নেই। আছে জলজট। আগে ২-৩ দিন এমনকি টানা কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা থাকলেও এখন সে ধরনের জলাবদ্ধতা নেই। পানি জমলেও কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তা পরিষ্কার হয়। তিনি জলাবদ্ধতার উৎস চিহ্নিত করেছেন।’ জলাবদ্ধতামুক্ত নগরীর প্রতিশ্র“তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় এবার জিতে আসাটা তার জন্য ‘চ্যালেঞ্জ’ হবে কিনা- এমন প্রশ্নেরও সরাসরি কোনো উত্তর দেননি মনজুর আলম। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানান, জলাবদ্ধতা ইস্যুটি এ নির্বাচনেও সামনে আসবে। ভোটাররা সে বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনায় নেবেন। এটিই তার জন্য হবে বড় চ্যালেঞ্জ।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আ জ ম নাছির উদ্দিন দলীয় সমর্থন পাওয়ার পর সুধী সমাবেশে বলেছেন, তিনি মেয়র হলে নগরীকে স্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতার হাত থেকে মুক্ত করতে উদ্যোগ নেবেন। এটিই হচ্ছে তার প্রথম কাজ। নগর আওয়ামী লীগের এক বৈঠকে আ জ ম নাছির বলেন, এই নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসাটা তার জন্য যেমন প্রেস্টিজের তেমনি দল এমনকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর জন্যও। তাই তিনি দলের সব নেতাকর্মীর সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করেন। নাছিরের জয়ী হওয়াটা আওয়ামী লীগ যে প্রেস্টিজ ইস্যু হিসেবে নিয়েছে সেটি গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনসহ বিভিন্ন স্তরের নেতাদের বক্তব্যেও স্পষ্ট। মঙ্গলবার নগরীর একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত রুদ্ধদ্বার বৈঠকে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ বলেন, যে কোনো প্রকারে আ জ ম নাছিরকে জিততে হবে। দলের প্রতিটি নেতাকর্মীকে এ জন্য ভোটারের দুয়ারে দুয়ারে যেতে হবে। ঘরে ঘরে যেতে হবে। সরকারের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরতে হবে। এতে করে ভোটারদের মন গলবে। সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীও নাছিরকে জেতাতে প্রয়োজনে জীবনবাজি রাখতে হবে বলে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন। স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা সৈয়দ নুরুল ইসলাম বুধবার মোহরায় অনুষ্ঠিত এক কর্মী সমাবেশে আ জ ম নাছিরকে জেতাতে প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন নেতাকর্মীদের।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র বলছে, সদ্য বিদায়ী মেয়র মনজুর আলমের সঙ্গে রয়েছে সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ঘনিষ্ঠতা। বিগত ৫ বছর কর্পোরেশন পরিচালনায় মহিউদ্দিন চৌধুরীর ‘পরামর্শে’ কাজ করেছেন এমন জনশ্রুতি আছে। তাই মহিউদ্দিন চৌধুরীর যে রিজার্ভ ভোট সেই ভোট নিয়েও আ জ ম নাছিরের অনুসারীসহ সাধারণ নেতাকর্মীদের মধ্যে আস্থার সংকট রয়েছে। এ অবস্থায় প্রেস্টিজ কতটুক রক্ষা হবে আ জ ম নাছিরের সেটাই দেখার বিষয়।
২৮ এপ্রিলের নির্বাচনকে প্রেস্টিজ ইস্যু হিসেবে নিচ্ছেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আ জ ম নাছির উদ্দিন শুক্রবার রাত ৯টায় যুগান্তরকে বলেন, এটি দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। যেহেতু গত নির্বাচনে জনপ্রিয় প্রার্থী হওয়া সত্ত্বেও এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনাকাক্সিক্ষত পরাজয় হয়েছিল তাই এবারের নির্বাচনে জয়টা অবশ্যই প্রেস্টিজের। তিনি বলেন, দুই বছরের মধ্যে জলাবদ্ধতামুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মেয়র নির্বাচিত হলেও বিএনপি সমর্থিত মেয়র মনজুর আলম পাঁচ বছরেও সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে পারেননি। বরং এই পাঁচ বছরে নগরীর জলাবদ্ধতা আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। উপরন্তু সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সেক্টরে যেসব অর্জন রেখে এসেছিলেন গত পাঁচ বছরে সেসব অর্জনও ম্লান হয়ে গেছে। নগর উন্নয়ন করার নতুন প্রতিশ্র“তি এলেও বিদায়ী মেয়র গত পাঁচ বছরে নগর ভবন নির্মাণে একটি খুঁটিও স্থাপন করতে পারেননি। বিদ্যমান নগর ভবনের এখন জীর্ণদশা। আ জ ম নাছির বলেন, ভোটাররা অবশ্যই এসব বিষয় বিবেচনা করবেন।
চট্টগ্রামে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে পরিচিত সচেতন নাগরিক কমিটি সনাক-টিআইবি চট্টগ্রামের প্রেসিডেন্ট প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার শুক্রবার সন্ধ্যায় যুগান্তরকে বলেন, চট্টগ্রাম শহরের প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা। কিন্তু এ সমস্যাই একমাত্র নয়। এটি বড় সমস্যা হওয়ায় অন্য সমস্যাগুলো আড়ালে চলে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমরা সব সময় দেখেছি জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হওয়ার আগে আশ্বাস দেন। জনগণ কিংবা আমরা সেই আশ্বাসে বিশ্বাস করি। কিন্তু জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হওয়ার পর তাদের সেই প্রতিশ্রুতি বা আশ্বাসের কথা ভুলে যান।’ তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহরের সমস্যা গভীরভাবে অনুধাবন করেন এখন পর্যন্ত তেমন নেতৃত্ব দেখিনি। তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা সমস্যা বড় সমস্যা হলেও আরও অনেক সমস্যা ঢাকা পড়ে গেছে। এ শহরে যখন-তখন যানবাহন উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু পার্কিং ব্যবস্থা নেই। এ শহরে নেই ফুটপাত। মানুষ রাস্তা দিয়ে হাঁটে। এতে যানজট যেমন বাড়ে তেমনি দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে। রয়েছে শিক্ষা স্বাস্থ্য সাংস্কৃতিক বিনোদন সংকট। এসব কারণে নগরীর মানুষ অনেকটা যান্ত্রিক, মমত্বহীন হয়ে উঠছে। এ কারণে বাড়ছে সামাজিক অসহিষ্ণুতা, হানাহানি।’ কেমন মেয়র চান এমন প্রশ্নের জবাবে এ প্রকৌশলী বলেন, ‘শহরের সংকট অনুধাবন করা বা বোঝার যোগ্যতা যার থাকবে, সংকট নিরসনে উদ্যোগ গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের যোগ্যতা যার থাকবে এবং যিনি এ আস্তা অর্জন করতে পারবেন তিনিই হবেন নগর পিতা।’
এদিকে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দর খান আসন্ন নির্বাচনে প্রধান ইস্যু কি বা ভোটারদের মধ্যে কোন বিষয়টি প্রভাব ফেলবে এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, প্রধান ইস্যু অবশ্যই জলাবদ্ধতা। বিগত মেয়র জলাবদ্ধতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচিত হলেও তিনি যে জলাবদ্ধতামুক্ত নগরী গড়তে পারেননি সেটা অনেকাংশে সত্য। তবে এটাও সত্য যে বিরোধী দলের মেয়র হওয়ার কারণে তার ফান্ড প্রাপ্তি বা অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতাসহ অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। যে ব্যক্তি মেয়র হবেন তার দল যদি ক্ষমতায় থাকে এবং সেই মেয়র যদি ক্যারিশম্যাটিক হন সে ক্ষেত্রে হয় তো জলাবদ্ধতার নতুন যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হচ্ছে সে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। জলাবদ্ধতার নেপথ্যে প্রধান কারণ হচ্ছে খাল-নালা দখল হয়ে যাওয়া। অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে যিনি ভূমিকা পালন করবেন তার পক্ষে হয় তো এ সমস্যা নিরসন করা সম্ভব হবে। তবে তিনি বলেন এবারের ভোটে জলাবদ্ধতা ছাড়াও দেশের বর্তমান আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করবেন ভোটাররা। পেট্রলবোমা সন্ত্রাস, আগুন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেও জনমত রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.