ধারণা পাল্টে দিলেন বাংলাদেশী এক হিজড়া -নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার একটি সরু গলি। মাংস আর মুরগির একাধিক দোকানের সমাহার এখানে। একটু ভেতরে সিমেন্টের একগুচ্ছ খাড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠলে আপনি খুঁজে পাবেন বাংলাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি করা অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াকু এক হিজড়াকে। সংবাদপত্র আর টিভি চ্যানেলগুলোর প্রতিবেদকরা ঢাকা শহরের অলিগলি তন্ন তন্ন করে তাকে খুঁজে বেড়িয়েছেন। তাকে খুঁজছেন পুলিশ কর্মকর্তারাও। তারা তাকে সাহসিকতার জন্য পুরস্কৃত করতে চান। লাবণ্য হিজড়া (২১) নামের ওই ব্যক্তি সোমবার ব্লগার ওয়াসিকুর রহমানের হত্যাকারী দুই সন্দেহভাজনকে হাতে-নাতে ধরার পর থেকে লাপাত্তা। আবারও তিনি হারিয়ে যান শহরের গোলোকধাঁধায়। দীর্ঘ সময় ধরে এভাবেই রাজধানীতে তার অবস্থান। কদাচিৎ কারও দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়। অনেকটা অদৃশ্য হয়েই থাকেন যেন। তিন দিন খোঁজার পর এক রিপোর্টার বৃহস্পতিবার তাকে খুঁজে পান। প্রথমবারের মতো তিনি তার গল্প প্রকাশ করতে সম্মত হয়েছেন। তবে তিনি তার অভিভাবকতুল্য অপর হিজড়া স্বপ্নার অনুমতি পাওয়ার পরই কথা বলতে রাজি হন। ব্লগার ওয়াসিকুর রহমানের (২৭) ওপর হামলা চালায় অল্পবয়সী তিন ব্যক্তি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসলাম নিয়ে সমালোচনামূলক মন্তব্য করার কারণে তাদের ওয়াসিকুরকে হত্যার হুকুম দেয়া হয় বলে খবরে বলা হয়। হামলার পর পালিয়ে যাওয়া দুই তরুণের গেঞ্জি টেনে ধরেন লাবণ্য। তার শক্ত হাতের পাকড়াও থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করতে থাকে হামলাকারীরা। এমন সময় তাদের দুজনের একজনের ব্যাগ থেকে মাটিতে পড়ে যায় এক চাপাতি। একজন লাবণ্যের হাতে সজোরে বাড়ি মারে। ছেড়ে দেয়ার জন্য চিৎকার করতে থাকে। লাবণ্য পাল্টা চিৎকার করে তাদের ধমক দিয়ে চুপ করতে বলে। লাবণ্যের মন্তব্য, ‘হিজড়া সম্প্রদায়ে আমাদের কেউ সমাজে কোন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চাই না। আমরা এমন একটি পরিবেশ চাই যেখানে হিজড়াসহ প্রতিটি ব্যক্তি শহরে নিরাপদে চলে ফিরে বেড়াতে পারে।’ সোমবার নৃশংস ওই হামলায় কেউ যে হস্তক্ষেপ করেছে সেটাই বিস্ময়কর। আর সমাজের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোন সদস্য এমনটা করবে সেটা তো দূরের কথা। কয়েক মাসের সহিংস রাজনৈতিক প্রতিবাদ এবং অবনতি হতে থাকা নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে ঢাকা এমন একটি স্থানে পরিণত হয়েছে যে স্থানটিকে প্রত্যক্ষদর্শীরা ভুলে যাওয়াই শ্রেয় বলে মনে করবেন। ২৬শে ফেব্রুয়ারি একদল যুবক বাংলাদেশী-মার্কিনি নাস্তিক ব্লগার অভিজিত রায়কে হত্যা করে। বইমেলা থেকে বের হওয়ার পর জনাকীর্ণ এক রাস্তায় সংঘটিত হয় ওই হত্যাকাণ্ড। অভিজিতের পিতা অজয় রায় বলেন, কমপক্ষে ১০-১২ জন লোক ওই হামলা হতে দেখেছেন। কিন্তু পুলিশ প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে যথার্থ কোন বর্ণনা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা হয় অনাগ্রহী বা তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। মঙ্গলবার ঢাকার স্থানীয় এক দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ওয়াসিকুর রহমানের হত্যাকারীদের পেছনে ধাওয়া করতে স্থানীয়রা অনাগ্রহী ছিলেন। লাবণ্য হিজড়া বলেন, পুলিশ কর্মকর্তা আর সাধারণ মানুষ ওই দুজনকে ধাওয়া করছিলেন। তার পাশ দিয়ে দৌড়ে যাওয়ার সময় তাদের ধরে ফেলেন তিনি। পুলিশ তার কাছে পৌঁছানোর পর ওই দুজনকে গ্রেপ্তার করে। এরপর ঘটনাস্থল থেকে চলে যান লাবণ্য। তৃতীয় সন্দেহভাজন ব্যক্তি পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। লাবণ্য বলেন, সামনে আসতে ইতস্তত করেছিলেন তিনি। তার ভয় ছিল হত্যাকারীদের সহযোগীরা তার চেহারা মনে রাখবে। যে গ্রামে বড় হয়েছেন সেখানে পালিয়ে যাওয়ার কথাও ভেবেছিলেন তিনি। কিন্তু ঘটনার পরবর্তী কয়েক দিনে তিনি লক্ষ্য করতে শুরু করেন, নিজের পরিচয় প্রকাশ করা ছাড়াই লক্ষণীয় মাত্রায় সম্মান পাচ্ছেন। লাবণ্য বলেন, ‘অনেক মানুষ আমাকে দেখে বলেছেন, তুমি একটা দারুণ কাজ করেছো, তুমি সন্ত্রাসীদের ধরেছো। আমাদের হিজড়া সম্প্রদায়ে এখন নতুন এক ধরনের প্রশংসা ও মূল্যায়ন দেখা যাচ্ছে।’ দক্ষিণ এশিয়ায় সমাজের প্রথাবিরুদ্ধ এক স্তরে হিজড়া সম্প্রদায়ের বসবাস। এখানে রক্ষণশীল সমাজগুলো সমলিঙ্গের শারীরিক সম্পর্ককে অপরাধ বলে বিবেচনা করে আবার একই সঙ্গে তৃতীয় লিঙ্গের অবস্থানকে স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান ও ভারত আইনগতভাবে তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি দিয়েছে। পাসপোর্ট আর অন্যান্য আনুষ্ঠানিক কাগজপত্রেও এ স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। লাবণ্য ছেলেবেলাতেই নিজেকে হিজড়া হিসেবে বুঝতে পারেন। মাত্র নয় বছর বয়সে বয়স্ক এক হিজড়ার সঙ্গে বাসা ছাড়েন। ঢাকায় স্বপ্না হিজড়ার নেতৃত্বে কঠোর এক নিয়মতান্ত্রিক সম্প্রদায়ে যোগ দেন তিনি। স্বপ্নাকে গুরুমা বলে ডাকেন লাবণ্য। এ সম্প্রদায় জীবনযাপন করে ঐতিহ্যবাহী এক পদ্ধতিতে। প্রতিটি দোকানে গিয়ে তারা কিছু অঙ্কের টাকা চায়। কেউ টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে দোকানের বাইরে হট্টোগোল সৃষ্টি করে। হিজড়াদের অভিশাপ লেগে যায় এমন একটি পুরনো বিশ্বাস রয়েছে। আর এ বিশ্বাসই হলো তাদের ব্যবসার এ রীতির অন্যতম ভিত্তি। লাবণ্য ছোট্ট একটি টিনের চালাঘরে থাকেন। ভিক্ষা করে তার দৈনিক আয় ৪ ডলারের মতো। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, আমাদের স্বাভাবিক কোন জীবন নেই। আমরা স্বাভাবিক মানুষ নই। কখনও কখনও যখন আমি ভাবি যে আমি একজন হিজড়া তখন নিজের প্রতি ঘৃণা আসে। কিন্তু অনেকে আবার আমাদের ভালবাসে কেননা আমরা অসহায় আর বঞ্চিত। বৃহস্পতিবার তার গুরু স্বপ্না হিজড়ার উপস্থিতিতে প্রশ্ন করা হয়েছিল পুলিশের তরফ থেকে অভিনন্দন গ্রহণ করতে উপস্থিত হবেন কিনা। প্রত্যাশা নিয়ে স্বপ্না হিজড়ার দিকে তাকান লাবণ্য। স্বপ্না উত্তর দেয়, কেন নয়? লাবণ্য তখন খুশি হয়ে বলেন, হ্যাঁ আমি একটা পুরস্কার নেয়ার প্রত্যাশা করতেই পারি, আমি দুই সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দিয়েছি।

No comments

Powered by Blogger.