বই, এস ডি বর্মন ও অবরোধের খোঁজে কুমিল্লায় by সোহরাব হাসান

শচীন দেববর্মনের বাড়ি পরিদর্শন করছেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর
জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র আয়োজিত বইমেলা উপলক্ষে গত শনিবার কুমিল্লায় গিয়েছিলাম। সেখানে যাওয়ার আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল বিএনপি জোট আহূত পৃথিবীর সম্ভবত দীর্ঘতম অবরোধের চালচিত্র দেখে আসা। অবরোধ কার্যকর না থাকলেও তার যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে, সেটি উপলব্ধি করলাম কুমিল্লায় যাওয়া-আসার পথে।
সকাল পৌনে আটটায় মহানগর ট্রেন ছাড়ার কথা ছিল কমলাপুর থেকে। সাড়ে সাতটায় স্টেশনে গিয়ে শুনলাম, ‘দেরি হবে।’ ট্রেনের সময়সূচি নিয়ে চালু কথাটি হলো, ‘নয়টার ট্রেন কটায় ছাড়বে?’ কিন্তু এখন নয়টার ট্রেন কটায় গন্তব্যে পৌঁছাবে, সেটাই বড় চিন্তার বিষয়। ট্রেনটি কুমিল্লায় পৌঁছানোর কথা ছিল ১২টায়, পৌঁছাল পৌনে তিনটায়। পথে বিপত্তি নেই, অবরোধ আহ্বানকারীদের কেউ এসে রেললাইনের ফিশপ্লেটও খুলে নেয়নি। তার পরও এই বিলম্বের জবাব কী?
কমলাপুর স্টেশনে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের ডিজিটাল ছবিগুলো যত্ন করে টাঙিয়ে রাখা হলেও যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা। কোচগুলো অপরিচ্ছন্ন, চেয়ারগুলো ধুলায় ধূসরিত, কোনোটির হাতল ভাঙা, কোনোটির রেকসিন ওঠা। দুর্গন্ধের কারণে বাথরুমে যাওয়া যায় না। কিন্তু রেল বিভাগে এসব দেখার কেউ আছেন বলে মনে হলো না। পেট্রলবোমার ভয়ে ভীত যাত্রীরা অনেকটা নিরুপায় হয়ে ট্রেনে চড়ে। যেখানে যাত্রীদের জীবনই বিপন্ন, সেখানে ট্রেনের সময়সূচি নিয়ে ভাবার সময় কোথায়? স্টেশনে দেখলাম, নারী যাত্রীর সংখ্যা খুবই কম। হরতাল-অবরোধের রাজনীতি নারীকেই বেশি ‘গৃহবন্দী’ করে রাখে।
কুমিল্লা শহরে ঢুকেই ধন্দে পড়ে গেলাম, এখানেও কি নির্বাচন হচ্ছে? না, কুমিল্লায় কোনো নির্বাচন নেই। তা সত্ত্বেও শহরজুড়ে পথেঘাটে, দোকানে-ভবনে রংবেরঙের পোস্টারে, ফেস্টুনে স্থানীয় সাংসদ আ ক ম বাহাউদ্দিনের ছবি। কোথাও তিনি প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। কোথাও স্থানীয় নেতা-কর্মীরা তাঁকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। বিভিন্ন ভবনের সামনেও তাঁর ছবিসংবলিত বিশাল বিশাল ব্যানার। নামসংবলিত ফলক। কিন্তু শহরের শ্রীছাদ বলতে কিছু নেই।
কুমিল্লায় হরতাল-অবরোধের তেমন প্রভাব নেই। ফলে সেখানে বিরোধী দলের নেতা–কর্মীদের ওপর দমন–পীড়নও কম। চলমান কর্মসূচিতে দেশের অন্যান্য স্থানে বিএনপি-সমর্থক মেয়ররা দৌড়ের ওপর থাকলেও কুমিল্লা সিটি মেয়র মনিরুল হক সাক্কু নিরাপদে আছেন। নিয়মিত অফিস করছেন। রাজনৈতিক অঙ্গনের গুঞ্জন হলো, আওয়ামী লীগের সাংসদ বাহাউদ্দিন এবং বিএনপির মেয়র মনিরুল হক সাক্কুর মধ্যে একটি অলিখিত সমঝোতা আছে। সিটি করপোরেশনের উন্নয়নের কাজটাও তাঁদের সমর্থকেরা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। মেয়রের সমর্থকেরা ৩০ শতাংশ, সাংসদের সমর্থকেরা ৩৫ শতাংশ। বাকি ৩৫ শতাংশ পান কাউন্সিলররা। জাইকা ও বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সিটি করপোরেশন প্রায় ১০০ কোটি টাকার কাজ করছে। কিন্তু সিটি করপোরেশনের মূল যে কাজ শহরের রাস্তাগুলো প্রশস্ত করা, সেদিকে মেয়রের আগ্রহ নেই। শহরে মানুষ বেড়েছে, কিন্তু রাস্তাগুলো রয়ে গেছে আগের মতোই। ফলে যানজট বাড়ছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেল শহরের অন্তত দুটি এলাকায় মেয়রের মালিকানাধীন ভবনগুলো গড়ে উঠেছে ফুটপাত দখল করে। এ ছাড়া শহরের ময়লা-আবর্জনা অপসারণ, সুয়ারেজ লাইন ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনাও অত্যন্ত নাজুক। নগরবাসী কার কাছে প্রতিকার চাইবে? সবখানেই অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা।
কুমিল্লায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে একটি অদ্ভুত মিল লক্ষ করলাম। বছরের পর বছর সম্মেলন না করে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে দলীয় কার্যক্রম চালানো। ২০০৬ সালে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটি হওয়ার পর থেকে পূর্ণাঙ্গ কমিটি বা সম্মেলন হয়নি। বর্তমানে পরিকল্পনামন্ত্রী অ হ ম মুস্তফা কামাল এই কমিটির আহ্বায়ক এবং রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক, সফিকুল ইসলাম শিকদার ও আফজাল খান যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু সাংসদ বাহাউদ্দিন কোনো কমিটিতে নেই। যদিও ২০১৩ সালে বিরোধী দলের ‘আন্দোলন’ মোকাবিলায় তিনিই মাঠে সক্রিয় ছিলেন। কেবল আওয়ামী লীগ নয়, ছাত্রলীগ–স্বেচ্ছাসেবক লীগও চলছে মেয়াদোত্তীর্ণ আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে। আর যুবলীগের কোনো কমিটিই নেই। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে দলীয় সভানেত্রী দুই প্রতিদ্বন্দ্বী আফজাল খান ও বাহাউদ্দিনকে এক মঞ্চে নিয়ে এলেও সেই ঐক্য টেকেনি। ২০১২ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আফজাল খান বিএনপির নেতা মনিরুল হক সাক্কুর কাছে হেরে যান এবং এর জন্য তিনি বাহাউদ্দিনকে দায়ী করেন।
কুমিল্লায় বিএনপির অবস্থাও ভালো নয়। কর্নেল (অব.) আকবর হোসেন যত দিন কুমিল্লা বিএনপির নেতৃত্বে ছিলেন, তত দিন দলীয় কোন্দল ছিল না। তিনি বলতেন, ‘আমি প্রতিদিন ভোরে উঠে আফজাল খান ও বাহাউদ্দিনকে সালাম দিই। কেননা, তাঁদের মধ্যকার বিরোধ যত দিন থাকবে, তত দিন আমার কিছু করতে হবে না।’ কিন্তু সেই বিএনপি এখন দ্বিধাবিভক্ত। জেলা সভাপতি রাবেয়া চৌধুরীর সঙ্গে আছেন আমিনুর রশীদ ইয়াসিন, ফাজলুর হক ও মোস্তাক মিয়া। এর বিরোধী গ্রুপে আছেন মেয়র মনিরুল হক সাক্কু ও সাবেক সাংসদ মনিরুল হক চৌধুরী। নিষ্ক্রিয়তার জন্য এক পক্ষ অপর পক্ষকে দায়ী করে।
এবার বইমেলার আয়োজন করা হয় কুমিল্লা টাউন হল (বীরচন্দ্র নগর মিলনায়তন) মাঠে। মেলায় ঢাকা থেকে ৬১টি প্রকাশনা সংস্থা অংশ নিয়েছে। কুমিল্লার লেখকদের বই নিয়ে আছে আলাদা স্টল। মেলায় প্রতিদিনই আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থাকছে। শনিবারের আলোচনার বিষয় ছিল ‘দারিদ্র্য বিমোচনে তথ্যপ্রযুক্তির ভূমিকা’। আলোচনাকারীদের মধ্যে মোস্তফা জব্বার, শান্তনু কায়সার, আসলাম সানী ও সানাউল হকের সঙ্গে আমিও ছিলাম। বললাম, অর্থনীতি ও তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাদেশ এগোলেও রাজনীতিতে পিছিয়ে আছে।
কুমিল্লার এত হতাশাজনক খবরের মধ্যেও একটি সুখবর আছে। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ২৪ মার্চ বইমেলা উদ্বোধন করতে গিয়ে কুমিল্লাবাসীর বহুদিনের বকেয়া কটি দাবি পূরণ করেছেন। তিনি প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী শচীন দেববর্মনের (এস ডি বর্মন) বাড়িটিকে সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে রূপান্তরের ঘোষণা দেন। এ জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এক কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগরতলা সফরকালে শচীন দেববর্মনের বাড়িটি সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সংস্কৃতিমন্ত্রীর ঘোষণার মধ্য দিয়ে সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হলো। তবে ৬০ বিঘা জমির ওপর নির্মিত পুরো বাড়ি নিয়ে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হচ্ছে না। একাংশ মুরগির খামার হিসেবেই থাকছে। কুমিল্লাবাসীর দাবি, মুরগির খামারটি অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে পুরো বাড়িটিতেই সাংস্কৃতিক কেন্দ্র করা হোক।
শনিবার বিকেলে যখন শচীন দেববর্মনের বাড়িতে যাই, লাল পতাকা দিয়ে তৈরি সীমানা চিহ্নগুলো দেখতে পাই। সবুজ গাছপালা ও পুকুরের পাশে পুরোনো ভবনগুলো তাঁর স্মৃতির কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। একটি ভবনের দেয়ালে লেখা আছে, ‘মহারাজ কুমার নবদ্বীপ চন্দ্র দেববর্মন বাহাদুরের রাজবাড়ি। ১৯২২ সালে কবি নজরুল শচীনের সঙ্গে এই বাড়িতে সংগীত গাইতেন।’
উল্লেখ্য, ত্রিপুরার রাজবংশের সন্তান শচীন দেব কৈশোর ও যৌবনের একটি বড় সময় বাবা নবদ্বীপ চন্দ্র দেববর্মন নির্মিত এই বাড়িতে কাটিয়েছেন। তিনি পড়াশোনাও করেছেন কুমিল্লা জিলা স্কুল ও ভিক্টোরিয়া কলেজে। ১৯৫৬ সালে রাজপরিবারের সদস্যরা ত্রিপুরায় চলে গেলে পাকিস্তান সরকার বাড়িটি দখল করে মুরগির খামার প্রতিষ্ঠা করে। পাকিস্তান ভেঙে গেলেও মুরগির খামার বহাল আছে।
অনুষ্ঠান শেষে ওই দিন রাতেই ফিরে আসি ট্রেনে নয়, বাসে। অবরোধের কারণে বাসের তুলনায় যাত্রী কম। তাই যাত্রী ওঠানো নিয়ে দুই কোম্পানির মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে। কিন্তু যাত্রী ওঠার পর বাস ছাড়ার নাম নেই। যাত্রীরা মেজাজ গরম করেন, কেউ কেউ ভাড়া ফেরত চান। চালকও কম বুদ্ধিমান নন। বাস ছাড়ার ভান করতে করতে আধা ঘণ্টা পার করে দেন। বিলম্বের কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, স্বাভাবিক অবস্থায় যে সংখ্যক বাস-ট্রাক চলত, এখন অস্বাভাবিক সময়ে চলে তার চার ভাগের এক ভাগ। এর পরও সিট খালি থাকলে পোষাবে কীভাবে?
রাত সাড়ে আটটায়ও শহরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ে মোটামুটি যানজট ছিল। কিন্তু শহর ছাড়িয়ে মহাসড়কে উঠতেই অবরোধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া টের পাই। রাস্তা প্রায় খালি, সুনসান। মাঝেমধ্যে দু-চারটি বাস-ট্রাক চলছে, দ্রুতগতিতে। চালক, হেলপার, যাত্রী সবার মধ্যে একধরনের ভয়, শঙ্কা। সড়কের পাশে মোড়ে মোড়ে পুলিশ-র্যাবের টহল। মেঘনার ওপারে এ রকম একটি টহল দলের সদস্যরা বাস থামালেন। ভেতরে উঠে কী কী আছে দেখলেন। তাঁদের একজন সামনের আসনে বসা এক যাত্রীর শরীর, ব্যাগ, এমনকি মানিব্যাগও তল্লাশি করলেন। অন্য কাউকে কিছু বললেন না। বোঝা গেল না এটি দৈবচয়ন না সন্দেহবশত।
পথের বাকি সময়টি মোটামুটি নির্বিঘ্নই ছিল। আমরা যখন গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ডে নামলাম, তখন রাত ১১টা। আড়াই ঘণ্টায় ঢাকায় পৌঁছালাম। আর ট্রেনে লাগল প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। তাহলে মানুষ কেন ট্রেনে যাবে?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab০3@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.