গুড বাই বুম বুম আফ্রিদি by আহমেদ বায়েজীদ

ভিভ রিচার্ডস যখন প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ডের কাউন্টি ক্রিকেটে খেলতে গেলেন সেই সময়ের কথা। বিখ্যাত কাউন্টি দল সমারসেটের নেটে ব্যাটিং করতে নামলেন ভিভ। প্রথম বলেই সজোরে ব্যাট চালালেন। সাথে সাথে ভিভকে ধমকে উঠলেন তার কোচ- কিভাবে খেললে তুমি, দেখ তোমার পা কোথায়? ভিভ নির্বিকারভাবে কোচকে বললেন- পা দেখতে হবে না, তুমি দেখ বলটা কোথায় গেল? এই গল্পটা নিছকই গল্প নাকি বাস্তব তা প্রশ্নাতীত নয়। তবে প্রথাগত কেতাবি ক্রিকেটের বাইরেও যে আরেকটা ‘ক্রিকেট’ রয়েছে সেটা বোঝাতে এই গল্পটা ব্যবহৃত হয় প্রায়শই। আর সেই ক্রিকেটের শুরুটা যদি ক্যারিবিয়ান লিজেন্ডের হাতে হয় তাহলে এটাকে পরিপূর্ণতা দিয়েছেন শহীদ আফ্রিদি। ভিভ রিচার্ডস কিংবদন্তি ক্রিকেটার। আফ্রিদি সাথে তার যোজন যোজনের দূরত্ব। তবে তার শেখানো মারকুটে ক্রিকেটকেই যেন ‘ক্রিকেট’ জ্ঞান করে বেড়ে উঠেছেন পাকিস্তানের খাইবার প্রদেশে জন্মনেয়া এই তরুণ। প্রথাগত ক্রিকেটের সাথে তার আজীবনের শক্রুতা। পরিস্থিতি, আবহাওয়া, পিচের ধরন, প্রতিপক্ষ সব কিছুকে থোড়াই কেয়ার করে খেলেছেন পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে। মহা তারকা হয়তো হতে পারেননি, তবে একটা জায়গায় তিনি অনেক মহাতারকার চেয়ে এগিয়ে আছেন। সেটা দর্শক প্রিয়তা আর ক্রিকেট বিনোদন।
ক্রিকেটকে বিনোদনে পরিণত করতে শহিদ আফ্রিদির ভূমিকা সবার আগেই লিখতে হবে। তার মাঠে নামা মানে দর্শকের নড়েচড়ে বসা। আফ্রিদির হাতে ব্যাট থাকলে স্বপক্ষ আর প্রতিপক্ষ সবার হার্ট বিট বেড়ে যেতে বাধ্য। তিনি নিজেও হয়তো জানতেন না কখন কি করবেন। যতক্ষণ মাঠে থাকতেন প্রতিপক্ষ থেকে দর্শক সবাইকে নাচিয়ে ছাড়তেন।
১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর কেনিয়ায় অনুষ্ঠিত চারজাতি টুর্মামেন্টে পাকিস্তানের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক আফ্রিদির। ধূমকেতুর মত এই আঙিনায় আগমন তার। টুর্নামেন্টের মাঝামাঝি সে সময়ের বিশ্বসেরা লেগ স্পিনার মুশতাক আহমেদ দেশে ফিরে যান অসুস্থ বাবাকে দেখতে। মুশতাকের শূন্য স্থান পূরণ করতে ডেকে আনা হয় পাকিস্তান এ দলের হয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে থাকা ১৬ বছরের এক তরুণ লেগস্পিনারকে। কেনিয়ার বিরুদ্ধে নাইরোবিতে অভিষেক হয় তার। সে ম্যাচে কেনিয়া অল্পরানে অল আউট হয়ে যাওয়ায় ব্যাট করার সুযোগ হয়নি। দ্বিতীয় ম্যাচের আগের দিন নেটে তার ব্যাটিং স্টাইল নজর কাড়ে অধিানায়ক সাইদ আনোয়ারের। শ্রীলংকার বিপক্ষে তাই এই লেগ স্পিনারকে তিন নম্বরে ব্যাট করতে নামিয়ে দেয়া হয়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথমবার ব্যাট হাতে নিয়ে গড়েন ইতিহাস। শ্রীলংকার বোলারদের ছাতু বানিয়ে করেন ৩৭ বলে সেঞ্চুরির রেকর্ড। দীর্ঘ ১৭ বছরেরও বেশি সময় তার দখলে ছিল সেই রেকর্ড। লেগস্পিনার থেকে এরপর হয়ে যান পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান। কিছুদিন পর দেখা যায় সাঈদ আনোয়ারের ওপেনিং পার্টনার হিসেবে।
কিন্তু উল্টো পথে হাঁটার জন্যই যার জন্ম তিনি কেন এক জায়গায় থিতু হবে? পড়তি ফর্মের কারনে স্থায়ী হতে পারেননি ওপেনিং পজিশনে। দল থেকে বাদ পড়ার শঙ্কা যখন তৈরি হলো, তখনই যেন জেগে ওঠে তার লেগ স্পিনার সত্তা। ধীরে ধীরে ভালো বোলিং করতে শুরু করেন। ১৯৯৯ বিশ্বকাপের ওপেনার আফ্রিদি ২০০৩ বিশ্বকাপে পুরোদস্তুর স্পিনার হিসেবে খেলতে শুরু করেন। তবে তার ব্যাটিং একেবারে হারিয়ে যায়নি কখনও। ধীরে ধীরে নিজেকে পরিচিত করেন অলরাউন্ডার হিসেবে। তবে পরিচয় যাই হোক শহীদ আফ্রিদির নাম শুনলে সবার আগেই মনে পড়বে তার ধুমধারাক্কা ব্যাটিং এর চিত্র। যার কারণে তার নামই হয়ে গেছে বুমবুম আফ্রিদি। নামের স্বার্থকতা রাখতে ওয়ানডে ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ছক্কা মারার রেকর্ডটি দির্ঘদিন ধরেই তার দখলে(৩৫১)।
যখন যে পরিচয়েই খেলেছেন কখনই আলোচনার বাইরে যেতে দেননি নিজেকে। আইসিসির অলরাউন্ডার র‌্যাঙ্কিং চালু হওয়ার পর সব সময়ই সেরা পাঁচে ছিলেন। পুরো ক্যারিয়ারে ৩৯৮ টি ম্যাচ খেলে ব্যাট হাতে ৮ হাজার রানের পাশাপাশি নিয়েছেন ৩৯৫টি উইকেট। এখনও পর্যন্ত ওয়ানডে ক্রিকেট যে কোন অলরাউন্ডারের সেরা নৈপুণ্য এটি। ৬টি সেঞ্চুরির সাথে আছে ও ৩৯টি হাফ সেঞ্চুরি। স্ট্রাইক রেট ১১৭ যা এখন পর্যন্ত বিশ্বসেরা। ১০৪ স্ট্রাইক রেট নিয়ে তার কাছাকাছি আছেন কেবল ভারতের বিরেন্দ্র শেবাগ।
ম্যাচ সেরা হয়েছেন ৩২ বার, যা শচিন টেন্ডুলকার, জয়সুরিয়ার পর যৌথভাবে(রিকিট পন্টিং ও জ্যাক ক্যালিসের সাথে) তৃতীয় অবস্থান। বল হাতে ইনিংসে ৫ বা তার বেশি উইকেট নিয়েছেন ৯ বার সেটিও ওয়ানডে ইতিহাসে ওয়াকার ইউনুস ও মুরালিধরনের পরে তৃতীয় অবস্থান। অধিানয়ক হিসেবে ৩৮ টি ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছেন যেখানে জয়ের হার শতকরা ৫২ ভাগ। ২০১১ বিশ্বকাপে তার নেতৃত্বে সেমিফাইনালে উঠেছিল পাকিস্তান। ২৭টি টেস্ট ম্যাচ খেলে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছেন টেস্ট ক্রিকেট থেকে। টেস্টে সেঞ্চুরি আছে পাঁচটি। ২০০৯ সালে বলতে গেলে একাই টি টুয়েন্টি ওয়ার্ল্ডকাপ জিতিয়েছেন পাকিস্তানকে। হয়েছেন টুর্নামেন্ট সেরা।
বলা হয়ে থাকে পরিসংখ্যান দিয়ে আফ্রিদিকে মেলানো যায় না। কিন্তু তার পরিসংখ্যানও যেকোনো খেলোয়াড়ের জন্য ঈর্ষণীয়। তবে ওয়ানডে ক্রিকেটর সবচেয়ে বড় আসর বিশ্বকাপে নিজেকে খুব বেশি মেলে ধরতে পারেননি এই পাঠান। ৯৯ থেকে ২০১৫ টানা পাঁচটি বিশ্বকাপে খেলেছেন। উল্লেখযোগ্য সাফল্য বলতে ২০১১ বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ উইকেট শিকার(২১টি)। চলতি বিশ্বকাপের আগেই জানিয়েছেন এই আসরের পর আর থাকবেন না ওয়ানডে ক্রিকেটে। তাই শেষ বেলায় রাঙিয়ে দেয়ার প্রত্যয় ছিল কন্ঠে। যদিও পারেননি দল, সমর্থক ও নিজের প্রত্যাশা পূরণ করতে। কোয়ার্টার ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে খেলা ম্যাচটিই তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ। যদিও আরো কিছুদিন টিটোয়েন্টি ক্রিকেট খেলবেন বলে জানিয়েছেন।
নিজের স্টাইলের কারণেই ক্রিকেটের সকল হিসেব নিকেশের উর্ধ্বে উঠে আফ্রিদিকে বিবেচনা করা হয়। শচিন টেন্ডুলকারের পর উপমাহাদেশ তো বটেই বিশ্ব ক্রিকেটই তার জনপ্রিয়তা সবার উপরে। পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের প্রথাগত বিশৃঙ্খলা আর কেলেঙ্কারি থেকে নিজেকে মুক্ত রেখেছেন সব সময়। পরিচ্ছন্ন ক্রিকেট খেলেছেন পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে। প্রায় ১৯ বছরের ক্যারিয়ারে দর্শক সমর্থক তো বটেই বড় বড় তারকা ক্রিকেটারদেরও মন জয় করে নিয়েছন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংবদন্তি বোলার মাইকেল হোল্ডিং বলেছেন, ‘ক্রিকেট ক্রিকেটই না, যেখানে আফ্রিদি নেই।’ ক্রিকইনফো তাদের ওয়েবসাইটে বলেছ- ক্রিকেটে তার মত প্লোয়ার আগেও ছিলনা, ভবিষ্যতেও আসবে না।’
শেষ ম্যাচ শেষে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্ক বলেছেন, ‘ক্রিকেট তার কারনেই বিনোদনে পরিণত হয়েছে। তাকে হারালে ক্রিকেট বড় কিছু হারাবে।’
দ্য ওয়াল খ্যাত রাহুল দ্রাবির একবার তার ব্যাটিং দেখে বলেছিলেন, ‘প্রকৃত একজন ম্যাচ উইনার, যে কিন এভারেস্টেও চুড়ায়ও ব্যাটিং করতে পারে।’
আফ্রিদির বিদায়ে পাকিস্তান তথা বিশ্ব ক্রিকেটে একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি হলো। দীর্ঘ দেড় যুগেরও বেশি সময় দর্শক সমর্থকদের ক্রিকেটের নেশায় বুদ করে রেখেছিলেন তিনি। ক্রিকেট খেলা চলবে যুগ যুগ ধরে, শতশত তারকা খেলোয়ার আসবে যাবে। কিন্তু একজন শহীদ আফ্রিদি পেতে ক্রিকেটকে আরও কত বছর অপেক্ষা করতে হবে তা বিধাতাই ভালো জানেন।

No comments

Powered by Blogger.