‘টাকার জন্য গলা টিপে খুন করি’ by ওয়েছ খছরু

‘টাকার জন্য অপহরণ করি শিশু আবু সাঈদকে। এরপর প্রথমে আমার বাসায় ও পরে কনস্টেবল এবাদুরের বাসায় বন্দি রাখি। কিন্তু সাঈদ চিনে ফেলে সবাইকে। এ কারণে তাকে গলা টিপে খুন করি। খুনের সময় এবাদুর সাঈদের পা ও মাছুম শরীর ধরে রাখে।’ সিলেটের স্কুলছাত্র আবু সাঈদ হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছে অপহরণ ও খুনের ঘটনার নেতৃত্বদানকারী র‌্যাবের কথিত সোর্স আতাউর রহমান গেদা মিয়া। গতকাল সিলেটের মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট-১ সাহেদুল করিমের আদালতে টানা আড়াই ঘণ্টার জবানবন্দিতে সে এ তথ্য জানায়। গেদা মিয়া আলোচিত এ অপহরণ ও খুনের ঘটনার অন্যতম হোতা। সে পুলিশ ও র‌্যাবের সোর্স হওয়ায় নগরীর বৃহত্তর কুমারপাড়া ও বন্দরবাজার এলাকায় দাপট খাটাতো। ১৪ই মার্চ স্কুলছাত্র আবু সাঈদের লাশ উদ্ধারের দিনই পুলিশ গেদাকে গ্রেপ্তার করেছিল। লাশ উদ্ধারের পর দিনই গ্রেপ্তারকৃত পুলিশ কনস্টেবল এবাদুর রহমান খুনের দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেয়। তার পরদিনই এ ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাকিবও জবানবন্দি দেয়। কিন্তু গেদা সহজেই খুনের ঘটনা স্বীকার না করায় পুলিশ ১৬ই মার্চ আদালত থেকে তাকে ৩ দিনের রিমান্ডে নেয়। প্রথম দফা রিমান্ডে গেদা খুনের ঘটনার দায় স্বীকার না করলেও ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল বলে জানায়। কিন্তু সে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এ কারনে ১৯শে মার্চ পুলিশ ফের আদালতে হাজির করে গেদার ৭ দিনের রিমান্ড জানায়। আদালত তার ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সিলেটের কোতোয়ালি থানার এসআই ফয়েজ আহমদ জানিয়েছেন, দ্বিতীয় দফা রিমান্ডে সোর্স গেদা মিয়া খুনের ঘটনা স্বীকার করেছে। এবং সে সত্য কথা বলায় এবাদুর ও রাকিবের জবানবন্দির সঙ্গে তার বক্তব্যের মিল পাওয়া যায়। তিন দিনের রিমান্ড শেষে গতকাল বেলা ২টার দিকে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে গেদাকে সিলেটের সিএমএম-১ এর আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় গেদার মাথায় ছিল হেলমেট ও পরনে ছিল বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট। আদালতে হাজির করার পর বেলা আড়াইটা থেকে আদালতে তার জবানবন্দি শুরু হয়। আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিতে গেদা জানায়, ‘টাকার জন্য সে ও বাকি চারজন মিলে স্কুলছাত্র আবু সাঈদকে অপহরণের পরিকল্পনা করে। নগরীর জিন্দাবাজারে একটি রেস্টুরেন্টে বসে তারা অপহরণের পরিকল্পনা করে। রেস্টুরেন্টের ওই বৈঠকে সে ছাড়াও ওলামা লীগ নেতা রাকিব, মাছুম ও এক সিকিউরিটি কর্মচারী ছিল। ১০ই মার্চ সন্ধ্যায় তারা পরিকল্পনা করে চলে যায়। কথামতো পরদিন ১১ই মার্চ তারা রায়নগর, দর্জিবন্দ এলাকায় অবস্থান নেয়। বেলা ১১টার দিকে সে ও মাছুম মিলে অপহরণ করে আবু সাঈদকে। অপহরণের সময় সাঈদের মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরা হয়। প্রথমে তার বাসায় এবং পরে সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে পুলিশ কনস্টেবল এবাদুরের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয় আবু সাঈদকে।’ গেদা আদালতে আরও জানায়, ‘অপহরণের পর দিন বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তারা খুন করে আবু সাঈদকে। আবু সাঈদকে আগের রাতে মুখ বেঁধে রাখা হয়েছিল।’ খুনের ঘটনার বিবরণ দিয়ে গেদা মিয়া জানায়, ‘খুনের সময় কেউ আসছে কি না সেজন্য পাহারা দেয় রাকিব। আর এবাদুর স্কুলছাত্র সাঈদের পা ও মুহিবুল ইসলাম মাছুম শরীর ধরে রাখে। এরপর আমি গলা টিপে আবু সাঈদকে খুন করি। খুনের পর লাশ গুম করে রাখার পরিকল্পনা করি। সেজন্য ৭টি বস্তার ভেতরে লাশ বন্দি করে চিলেকোটা রেখে দিই।’ গেদা জানায়, খুনের পর সে মোবাইল ফোনে সাঈদের পরিবারের কাছে টাকা দাবি করে। এরপর সে আবু সাঈদের বাসায় যায়। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথাও বলে। আবু সাঈদকে খুঁজে বের করতে সেও পুলিশের সঙ্গে কাজ করবে বলে জানায়। পরিবারের কেউ যাতে তাকে সন্দেহ করতে না পারে সেজন্য সাঈদের বাসায় গিয়েছিল বলে জানায় গেদা। এছাড়া, রাস্তায় সাঈদের মামাদের সঙ্গে দেখা হলেও সে এ ব্যাপারে কথা বলেছে। সর্বাত্মক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। আদালতে গেদা অজ্ঞাত এক ব্যক্তির পরিচয় বলেছে। ওই অজ্ঞাত ব্যক্তি একটি সিকিউরিটি কোম্পানির কর্মচারী। গেদার পরিচিত। এ কারণে খুনের ঘটনার শুরু থেকে ওই সিকিউরিটি কর্মচারী তার সঙ্গে ছিল। খুনের পর আর সিকিউরিটি কর্মচারীর সঙ্গে তার দেখা হয়নি। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গতকাল আদালতপাড়ায় সাংবাদিকদের কাছে জানিয়েছেন, পুলিশের কাছে ওই সিকিউরিটি কর্মচারীর পরিচয় বলেছে গেদা। কিন্তু গোপনীয়তা স্বার্থে তারা তার পরিচয় প্রকাশ করছেন না। তবে, তাকে গ্রেপ্তারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এদিকে, আদালতে টানা আড়াই ঘণ্টা জবানবন্দি গ্রহণের পর বিকাল ৫টার দিকে গেদাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এদিকে, আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত ৩ জনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিল। আর বাকি দুজন এখনও গ্রেপ্তার হয়নি। তাদের গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ ইতিমধ্যে বেশ কয়েক জায়গায় অভিযান চালিয়েছে। কিন্তু তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। কোতোয়ালি থানা পুলিশ জানিয়েছে, পলাতক দুজনের পরিচয় শুরুতেই পাওয়া গেলে তাদের গ্রেপ্তার সহজ হতো। এরপরও পুলিশ তাদের গ্রেপ্তারে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে বলে জানায়। সিলেটের শাহমীর (রহ.) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্র আবু সাঈদ। ১১ই মার্চ তাকে অপহরণের পর ১৪ই মার্চ পুলিশ লাশ উদ্ধার করে। লাশ উদ্ধারের দিন থেকেই উত্তপ্ত রয়েছে সিলেটে। আবু সাঈদের খুনের প্রতিবাদে প্রতিদিনই সিলেটে হচ্ছে বিক্ষোভ। ঘাতকদের ফাঁসির দাবি করছে সর্বস্তরের মানুষ। গতকালও রায়নগর এলাকায় ৫ এলাকার মানুষ গণমছিল ও সমাবেশ করে। সমাবেশ থেকে ঘাতকদের ফঁসির দাবি করা হয়। এ সময় বক্তারা বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, তাদের সোর্স এবং ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠনের নেতারা মিলে অপরাধ সিন্ডিকেট গড়েছিল। আর তাদের অপরাধের কাছে হার মানলো বিবেক। বক্তারা এ ঘটনার দৃষ্টান্দমূলক শাস্তির দাবি তুলে বলেন, অপহরণ ও খুনের ঘটনাকারীদের ফাঁসি না হলে কেউ নিরাপদ থাকবে না। ভবিষ্যতে এরকম আরও অনেক ঘটনা ঘটতেই থাকবে। স্থানীয় লোকজনের গণমিছিলটি রায়নগর পয়েন্ট থেকে শুরু হয়ে শহরের বিভিন্ন প্রদক্ষিণ করে কুমারপাড়া পয়েন্টে পথসভায় মিলিত হয়। মো. মতিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও মো. ইউনুছ আহমদের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, নাহেদ আহমদ, মাসুক গাজী, শিপলু আহমদ, সোলেমান মিয়া, জামাল উদ্দিন, সারোয়ার, নাচু, সুমন মিয়া, রোমন মিয়া, আউয়াল, লুকু, আশরাফুজ্জামান আজম, ছালামিন মিয়া, ফরহাদ, রিপন, আনোয়ার, রিয়াদ, অর্ঘ, নূর মিয়া, পাপ্পু, রাজু মিয়া, নাছিম, কবির প্রমুখ।

No comments

Powered by Blogger.