সালাহ উদ্দিনের নিখোঁজ হওয়া: কিছু সতর্কবাণী by আসিফ নজরুল

বিএনপির নেতা সালাহ উদ্দিন আহমদ নিখোঁজ হয়েছেন প্রায় দুই সপ্তাহ হলো। তাঁর নিখোঁজ হওয়ার পেছনে সরকারের কোনো বাহিনীর লোকজন জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি এমনকি বেঁচে আছেন কি না, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কারণ রয়েছে। চৌধুরী আলম ও ইলিয়াস আলীর মতো পরিণতি যদি সালাহ উদ্দিন আহমদেরও হয়ে থাকে, তাহলে এই ঘটনা দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ভয়াবহ চিত্র আবারও জোরালোভাবে তুলে ধরেছে। আতঙ্কজনক বিষয় হচ্ছে, নিখোঁজ বা গুমের এসব ঘটনা একের পর এক ঘটে চললেও সরকারকে এতে আদৌ বিচলিত মনে হচ্ছে না, এমনকি সরকারের কাউকে এর কোনো দায় নিতে হচ্ছে না। গুমের মতো রক্ত হিম করা অপরাধ যেন সমাজের অপরাধ সংস্কৃতিতে গ্রহণযোগ্য বিষয় হয়েও দাঁড়িয়েছে। মাহমুদুর রহমান মান্না ২১ ঘণ্টা এবং সালাহ উদ্দিনের অনেক দিন ধরে নিখোঁজ থাকার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশের দায়িত্বটুকু পালন করেনি দেশের বহু গণতান্ত্রিক দল ও মানবাধিকার সংগঠন। এখতিয়ারবহির্ভূত বিভিন্ন বিষয়ে বিবৃতি দানে সদা তৎপর মানবাধিকার কমিশনকেও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা গুম হলে এ জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি।
এই সুযোগে সালাহ উদ্দিনের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা আড়াল করার জন্য নানা হাস্যকর এবং খেলো কথাবার্তা বলা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। সরকারের দাবিমতে, সালাহ উদ্দিন যদি অবিশ্বাস্যভাবে লুকিয়ে থাকেন বা তাঁকে যদি বিএনপিও গুম করে থাকে (!), তাঁকে খুঁজে বের করার সম্পূর্ণ দায়িত্ব সরকারের। সালাহ উদ্দিনের স্ত্রী ও পরিবার তাঁর সন্ধানের আকুতি ব্যক্ত করেছেন, হাইকোর্ট তাঁকে খুঁজে বের করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তার পরও সরকার এই দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। সরকারের কর্মকাণ্ডে তাঁকে খুঁজে বের করার কোনো বিশ্বাসযোগ্য আগ্রহ বা তৎপরতাও লক্ষ করা যায়নি; বরং বিভিন্ন আলামত ও তথ্য অনুসারে সালাহ উদ্দিনকে সরকারের বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে বলে বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে।
প্রথমত, সালাহ উদ্দিন নিখোঁজ হওয়ার মাত্র তিন দিন আগে পুলিশ তাঁর দুজন গাড়িচালক ও একজন কর্মচারীকে আটক করে। এই আটক যে সালাহ উদ্দিনের আত্মগোপনে থাকা বিভিন্ন আশ্রয়স্থলের খোঁজ বের করার জন্য, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আটক ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্য অনুসারে পুলিশ দু-এক জায়গায় অভিযান চালিয়েছিল, সে তথ্যও পরে জানা গেছে। এসব তথ্য প্রমাণ করে, সরকার খুব জোর দিয়ে সালাহ উদ্দিনের খোঁজ করছিল।
দ্বিতীয়ত, সালাহ উদ্দিন যে বাড়িতে ছিলেন, তার দারোয়ানের বক্তব্য অনুসারে, সরকারি বাহিনীর লোকজন সালাহ উদ্দিনকে হাতকড়া পরিয়ে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। পত্রপত্রিকার প্রতিবেদন অনুসারে এলাকার লোকজনও একই রকম ভাষ্য দিয়েছেন এবং তাঁদের কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি গাড়ি ঘটনাস্থলের কাছে ছিল বলেও জানিয়েছেন। তাদের উপস্থিতিতে সাদা মাইক্রোবাস নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দিয়ে প্রকাশ্যে সালাহ উদ্দিনকে তুলে নেওয়া লোকজন সরকারের বাহিনীর লোক না হলে অন্য কে হবেন?
তৃতীয়ত, এই সরকারের ট্র্যাক রেকর্ডের কারণেও তার বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। অতীতে সরকারের বিরুদ্ধে নানা সময়ে গুমের অভিযোগ করেছে গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারগুলো। সরকার এসব অভিযোগের জবাব দিতে পারেনি, নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তির কোনো হদিস করতে পারেনি এবং সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ, একটি গুমের ঘটনায়ও সরকার কোনো বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করেনি। ফলে জনগণের একটি বিরাট অংশের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে উঠছে যে এই সরকার, বিশেষ করে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গুম করার ক্ষেত্রে একটি অভ্যস্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সালাহ উদ্দিন নিখোঁজ হওয়ার পর বিভিন্ন উপহাসমূলক মন্তব্য এবং ইলিয়াস আলীর ঘটনার মতো হাস্যকর উদ্ধার অভিযান এ ধারণাকে আরও জোরালো করতে পারে।
----২.
সালাহ উদ্দিন আহমদ কোনো সন্ত্রাসী ছিলেন না। আমার জানামতে, তিনি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা করেছেন সারা জীবন। বিএনপির সাম্প্রতিক আন্দোলনে নেতা-কর্মীদের নির্বিচার গ্রেপ্তারকালে তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। রুহুল কবির রিজভীর গ্রেপ্তারের পর তিনি দলের পক্ষে হরতাল-অবরোধ পালনের ঘোষণাসহ বিভিন্ন বিবৃতি দিয়েছেন। এসব কর্মসূচি পালনকালে পেট্রলবোমা, ককটেল নিক্ষেপসহ নানা নাশকতাপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে, বহু নিরীহ মানুষ এতে প্রাণ দিয়েছেন। সরকারি বাহিনীগুলোও নাশকতা প্রতিরোধের নামে বিরোধী দলের বহু নেতা-কর্মীকে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে, আরও বহু মানুষ নানা নির্যাতন ও জেল–জুলুমের শিকার হয়েছেন।
এই সার্বিক ঘটনায় সালাহ উদ্দিনের ব্যক্তিগত দায় খুঁজে পাওয়া কঠিন। অতীতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ আরও বহু দলের ডাকা কর্মসূচি পালনকালে গানপাউডার, বোমা, এমনকি লগি-বইঠার আঘাতে রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ মানুষের হৃদয়বিদারক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এসব নাশকতার জন্য হরতাল-অবরোধ বা অন্য কোনো উত্তপ্ত কর্মসূচি আহ্বানকারী কোনো রাজনৈতিক নেতার কখনোই বিচার হয়নি। বর্তমান সরকার যদি মনে করে, তারা শুধু তাদের আমলের বিরোধী দলের নেতাদের নাশকতার জন্য বিচার করবে, তাহলে তা একচোখা নীতি হতে পারে, তবে বিশ্বাসযোগ্যভাবে এসব বিচার করার অধিকার সরকারের অবশ্যই রয়েছে।
সালাহ উদ্দিনকে তাই গ্রেপ্তার করে বিচারের সম্মুখীন করলে তা নিয়ে তেমন প্রশ্ন উঠত না। কিন্তু তাঁকে যদি বিনা বিচারে গুম করা হয়, তাহলে এই অধিকার কারও নেই। আর তাঁকে যদি সরকার গুম না করে থাকে, তবু তাঁকে জীবিত বা মৃত খুঁজে বের করার দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের। কিন্তু অতীতের ঘটনাগুলোর মতো সালাহ উদ্দিনের ক্ষেত্রেও সরকারকে এ কাজে আন্তরিক মনে হচ্ছে না। যে অপরাধের জন্য অভিযোগের তর্জনী সরকারের দিকে, সেই ঘটনার তদন্ত না করে এটি নিয়ে নির্মম হাস্য-রসিকতা করলে অভিযোগের তর্জনী আরও জোরালো হয়ে ওঠারই কথা।
পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, সরকার এসব অভিযোগকে কোনো পাত্তাই দিতে চাইছে না। অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাউকে ধরে নিয়ে তা স্বীকার করলেই মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। মাহমুদুর রহমান মান্নার মতো একজন নেতৃস্থানীয় রাজনীতিককে সরকারি বাহিনীর পরিচয় দিয়ে মধ্যরাতে বাসা থেকে তুলে নিয়ে ২১ ঘণ্টা নিখোঁজ রাখা হয়। তাঁকে পুলিশে সোপর্দ করায় তাঁর সংগঠনের নেতারা এই বলে আনন্দ প্রকাশ করেছেন যে তাঁকে অন্তত গুম করে ফেলা হয়নি। আরও যা শোচনীয়, গুমের শিকার কিছু পরিবার এখন গুমের বিচার পর্যন্ত চাইছে না। গত বছর ৩০ আগস্ট মৌলিক অধিকার রক্ষা কমিটির অনুষ্ঠানটিতে দেখেছি, পরিবারের সদস্যরা শুধু জানতে চাইছেন, মেরে ফেলা হলে কোথায় পুঁতে রাখা হয়েছে তাঁদের বাবা বা সন্তানকে! পাশে দাঁড়িয়ে প্রাণভরে শুধু দোয়া পড়তে চান তাঁরা! শুধু এটুকুর জন্য হৃদয়ছোঁয়া আর্তি জানিয়েছিলেন তাঁরা দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে।
গুম তার পরও থেমে থাকেনি। আবু বকর সিদ্দিক বা মাহমুদুর রহমান মান্নার মতো ভাগ্যবান কারও কারও ক্ষেত্রে দু-এক দিনের মধ্যে ফিরে আসার ঘটনা ঘটেছে। বোঝা গেছে, ফিরে যাঁরা আসবেন, তাঁরা আসলে দ্রুতই আসবেন। যত সময় যাবে, ততই তাঁরা আর কোনো দিন ফিরে আসবেন না—এই ভীতিকর আশঙ্কা আরও জোরদার হবে।
----৩.
আমি আগেও লিখেছি, গুম সবচেয়ে গুরুতর অপরাধগুলোর একটি। গুম যেকোনো ধরনের হত্যাকাণ্ড থেকেও ভয়াবহ এ কারণে যে এতে হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তির সৎকার করার ন্যূনতম মানবিক কর্তব্য পর্যন্ত পালন করা যায় না, গুমের শিকার ব্যক্তির পরিবার তার রেখে যাওয়া সহায়-সম্পত্তি পর্যন্ত ভোগ করতে গিয়ে নানা বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ে। গুম প্রতিরোধের জন্য ২০০৭ সালে সম্পাদিত আন্তর্জাতিক চুক্তিতে গুমকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। বলা হয় যুদ্ধ, জরুরি অবস্থা, চরম রাজনৈতিক বিপর্যয়—কোনো অবস্থাতেই কাউকে গুম করার বৈধতা নেই। ২০১০ সালের ২৩ ডিসেম্বর কার্যকর হওয়ার পর এ পর্যন্ত ৪২টি রাষ্ট্র এর পক্ষ হয়েছে, ৯৩টি রাষ্ট্র এটি স্বাক্ষর করেছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, এই আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুসমর্থন দূরের কথা, এটি স্বাক্ষরই করেনি বাংলাদেশ (দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারত ও মালদ্বীপ এটি স্বাক্ষর করেছে)। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে এই সরকার আগের নির্বাচনের সময় নির্বাচনী ইশতেহারে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এবার ৫ জানুয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের আগে সেই প্রতিশ্রুতি পর্যন্ত দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেনি সরকার। এটি হয়তো তাই আশ্চর্যজনক নয় যে ৫ জানুয়ারি-পরবর্তী সরকারের আমলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বেড়েছে, বেড়েছে গুম আর অপহরণের ঘটনাও।
এসব ঘটনা প্রতিরোধে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে কোনো জোরালো বা অর্থবহ ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়নি। রাজনৈতিক সুবিধাবাদের ভাগীদার হয়ে বা নৈতিক মনোবল হারিয়ে নাগরিক সমাজের একটি বড় অংশও গুম প্রতিরোধে বা গুম সংঘটনে সরকারের ভূমিকা নিয়ে সোচ্চার হয়নি। অথচ এটি হওয়া খুবই জরুরি ছিল, এখনো আছে।
এ দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাঁচাতে চাইলে রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজকে গুম, অপহরণ আর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে সোচ্চার হতে হবে। এই সরকারের আমলে নিরাপত্তার আশঙ্কা নেই বলে যাঁরা ভাবেন, তাঁদের মনে রাখতে হবে, এই ধারা বন্ধ না হলে ভবিষ্যতেও ঝুঁকিটা থাকবে। বাঁচতে চাইলে তাই গুম-উধাও আর বিচারবহির্ভূত হত্যার বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।
স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা নেই এ দেশে। স্বাভাবিক সৎকারের নিশ্চয়তা আছে কি? এটিও হারিয়ে যাওয়ার আগে আমাদের সবার চৈতন্যোদয় হওয়া প্রয়োজন। কারণ, এরপর সর্বনাশের আর কিছু বাকি থাকে না।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.