জাতীয় মেলোড্রামা ও মাশরাফির লাগান by ফারুক ওয়াসিফ

ক্ষুধার্ত সিংহের মুখে ঠেলে দেওয়ার সময়ও গ্ল্যাডিয়েটরের হাতে অন্তত তলোয়ারটা দিতেন রোমান সম্রাটরা। জীবন বাঁচানোর যুদ্ধটা তাদের বিনা অস্ত্রে লড়তে হতো না। কিন্তু ওয়েলিংটনে বাংলাদেশের হাতে ছিল শুধুই ব্যাট আর বল। আম্পায়ার বিমাতা মানে বিধি বাম। যে খেলার ফলাফল মাঠের বাইরে থেকে নির্ধারিত বলে মনে হয়েছে, তার জয় কী হারই বা কী! সেদিন জয়ের চেয়েও বড় কিছু আমাদের প্রাপ্য ছিল। সেটা হলো সম্মান আর সমীহ। এই ভারত আর ইংল্যান্ড বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট খেলার যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ তুলেছিল।এরাই বিশ্বকাপে খেলার আগে আমাদের যোগ্যতার পরীক্ষা নেওয়ার ধুয়া তুলেছিল। নিজেদের আভিজাত্য নিয়ে তারা এতই উন্নাসিক হয়ে গেছে যে, বাংলাদেশ িটমের সঙ্গে খেলায় অনীহা দেখাতে কসুর করে না। এমন সব অপমানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সেদিন নিজেদের প্রমাণ করতে চেয়েছিল, যেমনটা প্রমাণ করেছিল ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে। ভারতের বিরুদ্ধে বোলিংয়ের প্রথম ৩০ ওভারেও সেই প্রমাণ আছে। তার পরই এল রোহিত শর্মা ও রায়নাকে ধরাশায়ী করেও মাঠের বাইরে পাঠাতে না পারার হতাশা। আম্পায়ার দিলেন তাঁদের নতুন জীবন। এ যেন মানুষের দ্বারা নিহতকে দৈব উপায়ে জীবনদান করার পৌরাণিক কাহিনি।
মহাভারতের যুদ্ধে দেবতাদের আশীর্বাদ পেয়েছিলেন উচ্চকুলজাত অর্জুন। তাঁদেরই মায়ের পেটের আরেক ভাই কর্ণ তো সূতপুত্র! দেবকুলের নয় বলে তাঁকে বারবার অপমানিত হতে হয়েছে। অর্জুনের সঙ্গে দ্বৈরথের যোগ্যতা নেই বলে তুচ্ছ করা হয়েছে। তার পরও কর্ণ বলেছিলেন, ‘জয় নয়, অভীষ্ট চাহিয়াছি।’ মহাভারতের অনেক কথাকারই স্বীকার করেন, কর্ণ অবিচার আর প্রবঞ্চনার শিকার।
দুর্ধর্ষ বীরও পরাজিত হন কখনো কখনো। কিন্তু যেখানে যুদ্ধের নিয়মই মানা হয়নি, সেখানে হারে গ্লানি নেই। সেখানে থাকে শুধু অপমান। ঐতিহাসিককাল থেকেই বাঙালিরা পেটের মার সইলেও মানের মার সইতে নারাজ।
সেটাই আমাদের অভীষ্ট, যার নাম সম্মান ও স্বীকৃতি। নিম্নবর্গীয় মানুষের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উত্থান ভূরাজনৈতিক ওলটপালট। নিম্নবর্গীয় জনমানুষের কলিজাপোড়ানো জেদের পরিণতি এই দেশ। এমন উত্থান এখনো ট্র্যাজিকই, জয়ের অভিষেক খুবই বিরল। আমাদের সংগ্রামের সোনা বারবার বেহাত হয়, আশার সমাধিক্ষেত্রে তামার বালা হাতে বসে থাকতে হয় আমাদের। আমরা লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারি না, পৌঁছাতে দেওয়াও হয় না। আমাদের দোষ: আমরা সবখানেই সমান সমান হয়ে খেলতে চাই।
অপমানে তাই ক্ষিপ্ত হয়েছি আমরা। প্রতিবাদ করেছি, আবেগে উদ্বেলিত হয়েছি এবং চালিয়ে গিয়েছি জাতীয় মেলোড্রামা। সিনেমা–নাটকে মেলোড্রামা থাকে উত্তেজনায় ভরপুর, মাঝেমধ্যেই আবেগের তুমুল বিস্ফোরণ, নায়কোচিত ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা ইত্যাদি। কিন্তু তার শেষে যে মিলনানন্দ থাকে, তা যেন আমাদের নয়। আমরা পেয়েছি ফাঁদে পড়া বাঘের দশা।
অধিনায়ক মাশরাফির পর আর কিছু বলার থাকতে পারে না। তিনি তাঁর সংযমের পর্দার ভেতর থেকেই বলেছেন, ‘যা হয়েছে তা সবাই দেখেছে।’ হ্যাঁ, সবাই নিজের চোখে দেখেছে বলেই সহ্য করতে পারেনি। শুধু বাংলাদেশিরাই নয়, ক্রিকেট বিশ্বের বাঘা বাঘা তারকা এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের অধিকাংশই এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন। এই সহমর্মিতায় আমাদের খুশিই হওয়া উচিত।
কিন্তু দিনের শেষে নিজেদের ঘাটতির দিকেও ফিরে তাকানোর দরকার আছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এখনো এমন দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠেনি যে চক্রান্ত ও দুর্ভাগ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জিতে আসবে। যোগ্যতার ভিত এত গভীর নয় যে ঝড় সামলাতে পারব। বাংলাদেশ সামর্থ্যের চেয়ে বেশি এগিয়ে যাওয়া দল। আমরা কি আমাদের ক্রিকেটারদের সেরা পরিচর্যা ও পরিবেশ দিতে পেরেছি? আইসিসির সমালোচনা আলবত করব, পাশাপাশি মনে কি পড়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের অনিয়মের কথা? রাজনৈতিক কোটায় ক্ষমতায়িত হওয়া অযোগ্য কর্তারা কীভাবে খেলোয়াড়দের ‘নিয়ন্ত্রণ’ করেন, তার অনেক নমুনাই তো আমরা জানি! প্রলোভন, ষড়যন্ত্র এবং রাজনৈতিক চাপের কাছ থেকেও কি আমরা আমাদের ছেলেদের সুরক্ষা দিতে পারি? আমরা কি পারি সারা দেশ থেকে সেরা খেলোয়াড়দের ছেঁকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে?
এই দেশে খেলার মাঠ দখল হয়ে যায় বাণিজ্যের জন্য। নবীনদের খেলতে হয় শিখতে হয় ছোট ছোট চত্বরে কি রাস্তায়। অধিকাংশ বিদ্যালয়ে খেলার মাঠই নেই। পাড়ার ক্লাবগুলো মাস্তানদের আখড়া। ক্রিকেট-সহায়ক মোটামুটি অবকাঠামো পর্যন্ত নেই। অথচ আমাদের নেতা-নেত্রীরা বক্তৃতায় বিশ্বকাপ জয় করে ফেলেন। ভক্ত হিসেবে দেশপ্রেমের দোলায় চড়ে আমরাও আশা করি ছেলেরা ‘অদ্ভুত উপায়ে’ সেরাদের সেরা হবে! তখনই চাপ পড়ে সাকিব-মাশরাফিদের ওপর। প্রচণ্ড মনের জোর আর সর্বংসহা জেদে তখন হয়তো একজন মাশরাফি ‘রক্তের শেষ বিন্দু দিয়ে চেষ্টা করার’ জেদ ধরেন, একজন রুবেল হোসেন ঘুরে দাঁড়ান, একজন মাহমুদউল্লাহ অবিচল হয়ে যান। তবে এভাবে ধারাবাহিক সাফল্য আসে না। এটা জাতীয় সক্ষমতার বিষয় এবং সেটা যেমন মানসিক বা সাংস্কৃতিক, তেমনি বৈষয়িক বা অবকাঠামোগত। কেবল মেলোড্রামাটিক আবেগ ও ভালোবাসা দিয়ে এই ঘাটতি পূরণ হওয়ার নয়।
আমরা অতি আবেগপ্রবণ। বাংলা সিনেমার মেলোড্রামা আমাদের স্বভাবে। আমরা কঠিন কষ্ট করি, কিন্তু শেষ মাইল দৌড়ানোর আগেই দম ফুরিয়ে ফেলি। আমরা অল্পে খুশি, অল্পে দুঃখী এবং অল্পে খেপি। আমরা ভালোবাসি অকাতরে কিন্তু যাকে ঘৃণা করি তাকে মানুষ ভাবি না। আমরা একা হলে দুর্বল বোধ করি, কিন্তু দলবদ্ধভাবে পালোয়ান হয়ে যাই। আমাদের উচ্ছ্বাস ও আশাবাদ যত, সংকল্প ততই কম। আমরা গণপিটুনি দিই কিন্তু গণদাবি কমই করি। শিকারির লক্ষ্য নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন আমাদের ধাতে নেই। আমাদের আবেগের পালে হাওয়া যত, যুক্তির হাল তত শক্ত না।
এর সবই উন্মোচিত হয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বিশ্বকাপ অভিযানের চূড়ান্ত মেলোড্রামায়। ব্যতিক্রম মাশরাফির বুদ্ধিমত্তা, মাহমুদউল্লাহর স্থিরতা আর রুবেলের সংকল্প। এই তিন গুণ বাঙালির কম, এ জন্যই এই তিন নায়ক ব্যতিক্রম।
ইংল্যান্ডকে হারিয়ে আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম আমরা অজেয়। এরই মধ্যে ভারতীয় কোনো কোনো সাংবাদিক, ভাষ্যকারের বিদ্রূপের ফাঁদে পা দিয়ে তাঁদের মওকা করে দিলাম। দুই দেশের ক্রিকেট-ভক্তরা পরস্পরকে তুলোধুনা করতে নামল। ঝগড়াবিবাদে দুই পক্ষই প্রচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িকতার ধুলো ওড়াল। এমনকি ভারতের যেসব কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের বিপক্ষে, খেলার মাঠে তার প্রতিশোধ নেওয়ার খায়েশও জাগল অনেকের মধ্যে। এ অবস্থায় ম্যাচ না জিতলে যেন আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে, এমন বার্তা তৈরি হলো সাকিব-মাশরাফিদের জন্য। ভক্তদের প্রত্যাশার চাপ, ভারতপক্ষের বিষোদগার আর আম্পায়ারদের বিতর্কিত রায়ে তাঁরাও স্বাভাবিক ছন্দ হারালেন। বোলিং ভালো হলেও ব্যাটসম্যানরা নিজেদের যোগ্যতার সমান হতে পারলেন না। দুটি মারাত্মক উইকেট-জয় আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে বেহাত হলে মনোবলও যেন পড়ে গেল। ম্যাচ-জয়ের নায়ক মাহমুদউল্লাহকেও সন্দেহজনকভাবে সরিয়ে দেওয়া হলো।
কে সরাল? দি ইকোনমিস্ট লিখেছে, ভারতের পরাজয় মানে ভারতকেন্দ্রিক ক্রিকেট সাম্রাজ্যের পতন এবং ব্যবসার ধস। ভারতের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী সরকার যেনতেন প্রকারে ভারতের অজেয় ছবি দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। বাংলাদেশকে তারা পথের কাঁটা মনে করেছিল। নিউইয়র্ক টাইমসও লিখেছে, আইসিসি ধাক্কা খেয়েছিল ২০০৭-এর বিশ্বকাপে যখন নবাগত আয়ারল্যান্ড পাকিস্তানকে আর বাংলাদেশ ভারতকে পরাস্ত করেছিল। তার পরই আইিসসি এমনভাবে ক্রিকেটকে সাজাচ্ছে যাতে ভারত বিশ্বকাপে সর্বাধিক ম্যাচে খেলতে পারে। (সূত্র: http://goo.gl/H40cgV)
খেলতে হলে তো জিততে হবে। আর ভারতের জয় মানে শতকোটি মানুষের বাজারে বিজ্ঞাপন, পণ্য, বাণিজ্যের মুনাফা নিশ্চিত হওয়া। ভারতে ক্রিকেটকেন্দ্রিক জুয়াও রমরমা। গত শুক্রবারই সে দেশে পাঁচ হাজার কোটি টাকার জুয়াচক্র ধরা পড়েছে। ২০০৭ থেকেই ক্রমেই ছোট হচ্ছে বিশ্বকাপে প্রতিযোগী দেশের সংখ্যা। আগে ছিল ১৯, এবারে ১৪, ২০১৯ সালে হবে ১০। এদিকে বাড়ছে ক্রিকেট নিয়ে বাণিজ্য ও জুয়া। ক্রিকেটের প্রাণভোমরা ক্রমেই যে দৈত্যের কৌটার মধ্যে বন্দী হয়ে পড়ছে, তার নাম ফাটকা পুঁজি। ক্রিকেটের প্রাণভোমরাকে খেলার মাঠে ফিরিয়ে আনতে হলে বাণিজ্যের হাতকে আর লম্বা হতে দেওয়া যাবে না। বিখ্যাত লাগান ছবির গল্পের জন্ম বাংলার ঢাকায়। ঢাকা থেকেই শুরু হোক নতুন আরেক লাগান–এর সংকল্প।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.