২৫ বছর ধরে মানসিক রোগের সাথে বসবাস by মোশাররফ করিম

মোশাররফ করিম
মেয়েটির নাম ইসমাত আরা। বনশ্রীতে অবস্থিত নারী উন্নয়ন শক্তি, এনজিওর কার্যালয়ে যখন তাকে প্রথম দেখি মনটা আমার খারাপ হয়ে যায়। পেটটা ফুলে নিচের দিকে ঠলকে গেছে। কথাবার্তায় অসামঞ্জস্য, এলোমেলো। ওর ঘটনা শুনলাম ওর বড় বোনের কাছ থেকে। ইসমাত আরার বয়স ৪৩ বছর। যখন এইচএসসি পড়ে তখন হয়তো রোমেল নামে কাউকে সে ভালোবেসেছিল। বাবা-মা চাকরি করেন। বিকেল হলে আয়াকে সাথে করে পাশের মাঠে ঘুরতে যায়। সেখানে হয়তো রোমেল নামে কারো সাথে দেখা হয়েছিল। রোমেল হয়তো দুটো ভালোবাসার কথা শুনিয়েছিল। দু’দিন তার সাথে দেখা হয়। আর কিছু কথা হয়। হঠাৎ একদিন রোমেল উধাও হয়ে গেল। ভালোবাসার আশ্বাস জীবনভর রয়ে গেল ইসমাতের জীবনে। এরপর ইসমাতের মনের মধ্যে উথাল পাতাল তরঙ্গ বইছে। সে বলে রোমেলকে এনে দাও। কেউ কখনো রোমেলকে দেখেনি। কেউ রোমেলকে তার কাছে এনে দেয়নি। ইসমাত ধীরে ধীরে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ল। চিৎকার করে বলে, রোমেলকে এনে দাও। কেউ রোমেলকে চিনে না। সে দেখতে কেমনÑ জানে না, তার ঠিকানাও কেউ জানে না। তার চিৎকার চেঁচামেচি একসময় চরমপর্যায়ে চলে গেল। খাওয়া দাওয়া বন্ধ, বাড়ির সবাইকে মারধর করতে শুরু করল, ঘর থেকে ছুটে বের হয়ে গিয়ে রোমেলকে আনতে চায়। বলে রোমেল আমাকে ডাকছে। আমি তার কাছে যাবো। দরজা খোলা পেলে দৌড়ে ছুটে চলে যায়। বাড়ির লোকে তাকে খুঁজে খুঁজে নিয়ে আসে। জোর করে ধরে ঘরে আটকে রাখে। খাওয়া নেই, ঘুম নেই, মুখে শুধু রোমেল আর রোমেল। বাড়ির লোকজন কেউ রোমেলকে খুঁজে পায়নি। একপর্যায়ে ইসমাতকে নিতে হয়েছিল পাবনা মানসিক হাসপাতালে।
আউটডোর চিকিৎসা দিয়ে আনার পর তাকে ঘরে আটকে রাখা যায়নি। সে জোর করে দরজা খুলে যেদিকে সেদিকে ছুটে চলে যায় রোমেলের খোঁজে। একদিন সকালে জোর করে ছুটে বের হয়ে গেছে। আত্মীয়স্বজন দিন-রাত খুঁজে শেষে মধ্যরাতে তাকে রাস্তায় হাঁটতে দেখে। তিন-চারজন মিলে জোর করে তাকে বাসায় নিয়ে আসে। এরপর তাকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার রোগের নাম সিজোফ্রেনিয়া। মহিলা ওয়ার্ডের গরাদ ধরে চিৎকার করে সে রোমেলকে ডাকে। রোমেল নামে কেউ কোনো দিন তার ডাকে সাড়া দেয়নি। মাসে মাসে তার পরিবার ভালো ভালো কিছু খাবার নিয়ে দেখতে যেত। একজন আয়া রাখা হয়েছিল প্রাইভেটভাবে তার গোসল করানো ও শরীরের যতেœর জন্য। বেতন ছাড়াও আয়াকে অতিরিক্ত কিছু টাকা দেয়া হতো। বাসা থেকে কিছু রান্না করে এনে খাওয়ানোর জন্য। রোমেলকে চিৎকার করে ডাকতে ডাকতে যখন সে ক্লান্ত হয়ে যেত তখন হাসপাতালের লোকেরা তাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিত। যখন রোমেলের জন্য চিৎকার চেঁচামেচি করত তখন অন্য পাগলেরা এমনকি হাসপাতালের আয়ারাও তাকে মারধর করত। তাকে প্রচণ্ড আঘাত করায় সে রক্তাক্ত হয়ে যেত। তার পরও সে রোমেল রোমেল বলে চিৎকার করা থামায় না। হাসপাতালের গরাদ ধরে বছরের পর বছর রোমেল রোমেল বলে কান্নাকাটি করেছে কিন্তু রোমেল নামে কেউ তার ডাকে সাড়া দেয়নি। রাগে দুঃখে নিজের চুল নিজে ছিঁড়ে ফেলেছে। এসব দেখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একসময় তার চুল কেটে ন্যাড়া করে দিয়েছে। কী করুণ তার জীবন কাহিনী, নিষ্ঠুর, কত অসহায়! ইসমাতের জীবনে হঠাৎ করে ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। হাসপাতাল থেকে তাকে বের করে দেয়া হয়। যেহেতু সে মারমুখী ধরনের এবং যেকোনো সময় ঘর থেকে বের হয়ে যেতে পারে। যার কারণে তার বোন একটি বাসা ভাড়া করে দু’টি শক্তসমর্থ কাজের লোক রেখে দেয় এবং গুলশান মুক্তি ক্লিনিকে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা: আবদুস সোবহানের অধীনে তার চিকিৎসা করাতে থাকে।
প্রায় বছরখানেক আলাদা বাসায় রেখে চিকিৎসা করার পর তার মারমুখী স্বভাব কিছুটা কমে গেল। তাকে বাসায় নিয়ে আসা হলো। মেয়েটি কিছুটা ভালো হওয়ার পর সারাক্ষণ শুধু মহান আল্লাহ তায়ালাকে ডাকে, আর শুধু তসবিহ যপে। তার আর অন্য কোনো কাজে মন বসে না। হঠাৎ রোমেলের কথা মনে পড়লে কান্না করে। আবার হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই হেসে ওঠে। নারী উন্নয়ন শক্তি, এনজিওতে তাকে পুনর্বাসনের জন্য আসা-যাওয়া করতে বলা হয়। বিনিময়ে তার চিকিৎসা ও খাবার খরচ দেয়া হয়। হঠাৎ করে কয়েক দিন অফিসে না আসায় সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ড.আফরোজা পারভীন ইসমাতের বাসায় তাকে দেখতে যান। শমরিতা হাসপাতালে ইসমাতের চিকিৎসা দেয়া হয়। পপুলার ও পদ্মা ডায়াগনস্টিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর অনেক রোগ ধরা পড়ে। রিপোর্টে জানা যায়, তার শরীরে রক্ত উৎপাদন একেবারেই কম হচ্ছে, যকৃত ও প্লীহা ফুলে গেছে। গলব্লাডারে পাথর হয়েছে। ডায়াবেটিস ১৭-এর চেয়ে বেশি। উচ্চ রক্তচাপ ১৫৫/৯৫। তাকে বহুবার রক্ত দেয়া হয়। শরীরে রক্ত উৎপাদনের জন্য তাকে ইনজেকশন দেয়া হয়। ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালেও কয়েকবার তার চিকিৎসা করানো হয়। সর্বশেষ তাকে সিরাজুল ইসলাম মেডিক্যাল হাসপাতাল থেকে ভারতে চিকিৎসার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়। তার পরিবার যতটা অর্থ দিতে পারে তার চেয়ে বেশি অর্থ তার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন। ভারতে নেয়ার জন্য তার ভিসা করানো হয়েছে। অর্থের জোগাড় হলে ভারতে যাওয়া সম্ভব। এখনো নতুন কাউকে দেখলে ইসমাত জিজ্ঞেস করেÑ তোমরা কি রোমেলকে চেনো? তাকে দেখেছ কি?
আমি ইসমাত আরার দ্রুত আরোগ্য লাভ ও তার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল কামনা করছি। মানবিক কারণে আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে সাহায্য করেছি। যথাসম্ভব আপনারাও করুন। হৃদয়বান বিত্তশালী ব্যক্তিদের কাছে আমার মানবিক আবেদন ৪৩ বছর বয়সী অবিবাহিত নিঃসঙ্গ ইসমাত আরার চিকিৎসার জন্য তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থসহায়তা দিয়ে সাহায্য করুন। অথবা +৮৮ ০১৭১১৫৪১৫২৯ বিকাশ নম্বরে অর্থ সাহায্য পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হলো। ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নাম : ISMAT ARA, অ্যাকাউন্ট নম্বর : ৪০৩০১০১০০৮৪২০ পূবালী ব্যাংক লিমিটেড, বনশ্রী শাখা, ঢাকা।
বর্তমান ঠিকানা : ২০১/১ ভূইয়াপাড়া
খিলগাঁও, ঢাকা-১২১৯। ফোন: ০১৭১১৫৪১৫২৯
লেখক : টেলিভিশন নাট্য ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.