বিএনপিতে আলোচনায় ৬ ইস্যু by কাফি কামাল

ঘোষিত তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে এখনও নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেনি বিএনপি। তবে নির্বাচনের ব্যাপারে ইতিবাচক ইঙ্গিত এসেছে বিরোধী জোটের তরফে। সুষ্ঠু পরিবেশ পেলে নির্বাচনী প্রস্তুতির ও জয়ের ব্যাপারেও আত্মবিশ্বাসী তারা। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন পেশাজীবীদের দুটি প্রতিনিধি দল। সাক্ষাৎ শেষে দুটি প্রতিনিধি দলই নির্বাচনের ব্যাপারে শীর্ষ নেতৃত্বের ভূমিকা ইতিবাচক সে ইঙ্গিতের কথা বলেছেন। বিষয়টিকে উড়িয়ে দেননি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে কার্যালয়ে অবস্থানকারী দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল। তারা বলেন, বিএনপি নির্বাচনের বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। দলের ও জোটের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে শিগগিরই অবস্থান পরিষ্কার করা হবে। যদিও দলের বিভিন্ন পর্যায়ে সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে রয়েছে নানামুখী মতামত। জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে চলমান অনির্দিষ্টকালের আন্দোলনের মধ্যে নির্বাচনের পক্ষে-বিপক্ষে ও লাভ-ক্ষতি নিয়ে যুক্তি-তর্ক এবং চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। বিবেচনা করা হচ্ছে ওয়ান-ইলেভেনের সময় সিটি নির্বাচন ও ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বর্জনের অভিজ্ঞতা। এমন পরিস্থিতিতে সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে গুরুত্ব পাচ্ছে ৬টি ইস্যু। বিএনপি স্থায়ী কমিটি, কেন্দ্রীয় ও তৃণমূলের একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপে এসব বিষয় উঠে এসেছে। তারা বলছেন, সরকার পরিবেশ তৈরি না করলে ইতিবাচক মনোভাব থাকলেও বিএনপির পক্ষে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা কঠিন হবে। ইস্যুগুলো হচ্ছে- ১. বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার ও তার কার্যালয়ে নেতাকর্মীদের যাতায়াতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বাধা তুলে নেয়া, ২. নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ নেতাকর্মীদের মুক্তি দেয়া, ৩. বিরোধী দলকে প্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন ও জনসম্পৃক্ততামূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে বাধা না দেয়া এবং কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের তালা খুলে দেয়া, ৪. অব্যাহতভাবে মামলা দায়ের ও গণগ্রেপ্তার বন্ধ, ৫. দলের যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদসহ বিএনপি, অঙ্গদল ও জোটের নিখোঁজ নেতাদের সন্ধান বা তাদের উদ্ধারে আন্তরিকতার সঙ্গে সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ এবং ৬. নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও প্রশাসনের নিরপেক্ষ আচরণ নিশ্চিত করা। এসব ইস্যুতে বিবেচনায় রেখেই সিদ্ধান্ত গ্রহণে দল ও জোটের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের কথা বলেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তবে বৈঠকটি কখন হতে পারে এব্যাপারে এখনও কিছু জানানো হয়নি দলীয় ফোরামে।  নেতারা জানান, দীর্ঘদিন থেকেই বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলের গণতান্ত্রিক কর্মসূচি পালনে বাধা দিচ্ছে সরকার। সরকারি দলের নেতাকর্মী ও প্রশাসনের প্রতিবন্ধকতার কারণে একাধিক ঘোষিত কর্মসূচি পালন করতে পারেনি বিএনপি। এমন পরিস্থিতিতে প্রকাশ্যে কর্মসূচি পালন ও জনসংযোগের সুযোগ না পেলে নির্বাচনে উৎসাহী হবে না নেতাকর্মীরা। বিশেষ করে গ্রেপ্তারের ঝুঁকি নিয়ে নির্বাচনী জনসংযোগে তারা সক্রিয় হতে পারবেন না। ফলে জনমত অনুকূলে থাকলেও ফলাফল পক্ষে আনা কঠিন হবে। তারা বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া পৌনে তিন মাস ধরে তার রাজনৈতিক কার্যালয়ে অবস্থান করছেন। আন্দোলন কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে প্রথমে তাকে অবরুদ্ধ করা হলেও পরবর্তীতে আন্দোলনে সক্রিয় থাকার কৌশল হিসেবে তিনি নিজেই কার্যালয়ে অবস্থান করছেন। তবে খাবার সরবরাহ ও যোগাযোগ সমস্যা চলছে দুই মাস ধরে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। নেতারা বলেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে প্রার্থী, প্রার্থীর নির্বাচন সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ও দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের নানা প্রয়োজনে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হবে। তৃণমূল নেতা-কর্মীদের যোগাযোগ ও যাতায়াতের সুযোগও দরকার। অন্যদিকে তার বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার না হলে একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যেই থাকতে হবে বিরোধী নেতাকর্মীদের। ওদিকে চলমান আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিএনপি নেতাদের বড় একটি অংশ বর্তমানে কারাবন্দি। অন্যরা কৌশলগত নিরাপদ অবস্থানে থেকে আন্দোলন করছেন। দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের কারাগারে রেখে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া যেমন বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের জন্য কঠিন তেমনি কঠিন তাদের সহযোগিতা ছাড়া বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের নির্বাচনী লড়াই। এছাড়া আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে দায়ের হয়েছে বিপুল সংখ্যক মামলা। এখন নতুন মামলা দায়ের ও গণগ্রেপ্তার বন্ধ না হলে তাদের পক্ষে নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে না। আর এটাই হবে বিএনপির নির্বাচনে যাবার সিদ্ধান্তগ্রহণে বড় বাধা। নেতারা জানান, চলমান আন্দোলনে দলের যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদসহ অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী নিখোঁজ রয়েছেন। তাদের সন্ধান ও উদ্ধারের কার্যকর উদ্যোগ না থাকলে নির্বাচনে উৎসাহী হবেন না নেতাকর্মীরা। এছাড়া আন্দোলনে একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তৃণমূল থেকে প্রশ্ন আসতে পারে, কিসের আশা ও ভরসায় এ অংশগ্রহণ। এদিকে সিটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ব্যাপারে পরস্পরের মতামত জানার চেষ্টা করছেন। সেখানেও প্রধান্য পাচ্ছে এসব ইস্যু। এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন বিএনপি একটি দীর্ঘমেয়াদি এবং আপাতত গন্তব্যহীন আন্দোলনের পথে চলছে। এ আন্দোলনের যৌক্তিক ভিত্তিকে দৃঢ় করতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ একটি সুযোগ হতে পারে। এছাড়া বিএনপিকে এখন জঙ্গিবাদের যে তকমা সেঁটে দেয়া হচ্ছে তা থেকে উত্তরণেরও একটি পথ হতে পারে। তারা বলেন, বিএনপি নির্বাচনে যাবার ঘোষণা দিয়ে সরকারের প্রতি কিছু শর্ত দিতে পারে। তারা বলতে পারে এতদিন সরকার পতন আন্দোলনে ছিলাম, আন্দোলন এবং নির্বাচন আলাদা বিষয়। ফলে নির্বাচনের প্রয়োজনে এসব শর্ত পূরণ জরুরি। তখন বল চলে যাবে সরকারের কোর্টে। সেসব শর্ত পূরণে সরকার আন্তরিক না হলে দেশের মানুষ ও আন্তর্জাতিক মহলে বিএনপির দাবি জোরদার হবে। দেশের জনগণ ও আন্তর্জাতিক মহলকে বোঝানো যাবে, সরকারই বিএনপিকে নির্বাচনের পথে আসতে দিতে চায় না। উল্লেখ্য, ২০০২ সালের এপ্রিলে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ ডিসিসি নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকাসহ কাউন্সিলর পদে ৯০ ভাগ বিএনপি দলীয় প্রার্থীরা বিজয়ী হন। ওয়ান ইলেভেন ও মহাজোট সরকারের সময় দুইবার নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা ভেস্তে যায়। ২০১১ সালের ৩০ই নভেম্বরে ৫৬টি ওয়ার্ড নিয়ে ‘দক্ষিণ’ ও ৩৬টি ওয়ার্ড নিয়ে ‘উত্তর’ নামে দুই ভাগ হয় ডিসিসি। এরপর পঞ্চম দফা অনির্বাচিত প্রশাসক দিয়ে চলছে ডিসিসি।

No comments

Powered by Blogger.