আসহাবউদ্দীন আহমদ : স্বপ্নের ফেরিওয়ালা by ময়ুখ চৌধুরী

আসহাবউদ্দীন আহমদ একজন ব্যক্তি মানুষের নাম কেবল নয়, তার চেয়েও বেশি- একটি ব্যক্তিত্বের নাম। নিজের সত্তা, নিজের উপলব্ধিকে সাহসের সঙ্গে ব্যক্ত করতে পেরেছেন বলেই তিনি ব্যক্তিত্ব। এই নিরিখে, তথাকথিত অনেক ব্যক্তিত্বই ভাসমান বরফখণ্ডের মতো, যাদের স্বরূপ তলানির বরফের মতোই অগোচর এবং অন্ধকার। মনে মনে তাকে অন্যের পাশে দাঁড় করিয়ে দেখেছি- দেখেছি, তিনি কেবল অনন্য নন, নিঃসঙ্গ ব্যতিক্রমও বটে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ভোগবাসনাকে উপেক্ষা করে ত্যাগের পথে তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। অতএব, তিনি যে স্বপ্ন দেখতেন, তার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল আবহমানকাল ধরে প্রতারিত আমজনতা। নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেয়া আসহাবউদ্দীন তাই আদর্শ হিসেবে যতই স্মরণযোগ্য হোন না কেন, তাকে অনুসরণ করার সাহস কিংবা যোগ্যতা আমাদের নেই (আত্মীয়তার সুবাদে তার ও তার পরিবারের ভোগান্তি আমি দেখেছি)।
২.
স্কুলজীবন থেকেই মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি মনোযোগ্য হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। সেই সুবাদে স্কুল পরিদর্শনকারী কর্তাব্যক্তি জানতে চেয়েছিলেন- বড় হয়ে তুমি কী হতে চাও? উত্তরে তিনি জবাব দিয়েছিলেন- শিক্ষক হতে চাই। কেন তিনি ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার কথা বললেন না- এ কারণে খোদ শিক্ষকরাই তাকে বকাবকি করেছিলেন। কিন্তু, অনতি-তরুণ বয়সে উচ্চারিত অভিপ্রায়টুকু যে কথার কথা নয়, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে যোগদান (১৯৩৯) করে তা প্রমাণ করেছেন তিনি।
আমরা যারা শিক্ষকতার পেশায় জড়িত, তাদের অনেকেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বা ক্ষমতাবলয়ের প্রতি আনুগত্য নিবেদন করে ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষা করে থাকি। অথচ তিনি বিবেকের টানে তদানীন্তন (১৯৪১) কলেজ অধ্যক্ষের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। পরিণামে তাকে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে নির্বাসন দেয়া হয়েছিল। তিনিও মাথা উঁচু করে সেই ক্ষতিটুকু মেনে নিয়েছিলেন।
চারপাশে তাকালেই দেখা যায়, এক শ্রেণীর শিক্ষক শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার্থীদের বসিয়ে রেখে কর্তাব্যক্তির সঙ্গে মুরগির ছানার মতো ঘুরঘুর করেন। কেউ কেউ জনসেবার নামে জনসভা করে বেড়ান; বিনিময়ে খুদকুঁড়া সংগ্রহ করেন। তাদের সঙ্গে আসহাবউদ্দীনের ব্যবধান সুস্পষ্ট। ১৯৫৩ সালে জীবিকার নিশ্চিত অবলম্বন- অধ্যাপনার পেশা ছেড়ে স্পষ্টভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। পরবর্তীকালে এ রকম আরেকটি নজির সৃষ্টি করেন আপসবিরোধী বদরুদ্দীন উমর।
৩.
একথা সত্য যে, সাধারণ মানুষের স্বার্থে সারা জীবন তিনি নানানভাবে লড়ে গেছেন। স্বীয় দলের (কমিউনিস্ট পার্টি) সিদ্ধান্ত মোতাবেক উদীয়মান পুঁজির পৃষ্ঠপোষণকারী দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছিলেন- শুধু এই কারণে যে, পশ্চিম পাকিস্তানি শোষণতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন একসঙ্গে এবং একই উদ্দেশ্যে- অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে। সে অনুযায়ী, নির্বাচিত সদস্যরূপে তিনি পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে (৩.৪.১৯৫৭) পূর্ব-বাংলার পূর্ণাঙ্গ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানিয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করেন। আজ যারা দেশপ্রেমের ডিলারশিপ নিয়ন্ত্রণ করেন, তাদের পূর্বসূরিদের ভূমিকা সেদিন কী ছিল- নথিপত্র ঘাঁটলেই তা বেরিয়ে পড়বে।
৪.
ষাটের মধ্যভাগে জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম প্রবল হয়ে ওঠে। এর লক্ষ্য উদীয়মান পুঁজির দ্বারা প্রভাবিত হওয়ায়, কৃষক-শ্রমিকের স্বার্থ উচিত গুরুত্বটুকু পায়নি। সন্নিহিতকালে, একাধিক কারণে ন্যাপেও ভাঙন ধরে। সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আসহাবউদ্দীন তখন পিকিংপন্থায় আস্থা পোষণ করেন। সেহেতু, তিনি মস্কোপন্থীদের সমালোচনা করতেন। তা সত্ত্বেও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনে তিনি কষ্টই পেয়েছিলেন। নেতৃত্বের উচ্চাভিলাষ, অর্থলিপ্সা, বিদেশী চক্রান্ত ইত্যাদির কারণে বাংলাদেশের বাম সংগঠনগুলো ক্রমাগত ভাঙতে থাকে এবং নগদপ্রাপ্তির মোহে শীর্ষস্থানীয় বামনেতারা পুঁজিবাদী দলগুলোর পকেটে ঢুকে পড়েন। বলা বাহুল্য, এটা কৌশলগত কোনো ব্যাপার নয়- নেহায়েত ব্যক্তি-স্বার্থসিদ্ধি। ব্যাপারটুকু আসহাবউদ্দীন আহমদ স্পষ্টতই টের পাচ্ছিলেন এবং ভেতরে ভেতরে হয়তো ভেঙেও পড়ছিলেন তিনি। একপর্যায়ে (১৯৮৬) তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন। তা সত্ত্বেও অন্তর্গতভাবে লালন করতে থাকেন সমাজ পুনর্গঠনের স্বপ্ন। তাকে কি সফল রাজনীতিক বলা যায়? অবস্থাদৃষ্টে তো তা মনে হয় না। সফল হলে তো বাড়ি থাকত, গাড়ি থাকত, মানুষ-কেনার টাকা থাকত, ক্ষমতালিপ্সু উত্তরাধিকারী থাকত, হিসাবের অগোচরে আরও অনেক কিছু থাকত, যা তার নেই।
আসহাবউদ্দীনের ছিল শুধু ঐকান্তিক আরাধনা। তার আরাধ্যসূচির শীর্ষে ছিল সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি। যেসব রাজনীতিক বাণিজ্যসফল সিনেমার মতো যরঃ, তাদের জীবনে প্রচুর অর্থ- যার মানে হল সড়হবু. পক্ষান্তরে, আসহাবউদ্দীনের জীবনও অর্থময়- যার মানে হল সবধহরহম. মৌলিক তফাৎটা ঠিক এখানেই। আর এজন্যই, মানুষের ভাগ্য বদলানোর কথা বলে নিজের ভাগ্য বদলাতে পারেননি তিনি। মাইলের পর মাইল হেঁটেছেন, কৃষক-মজুরদের সংগঠিত করতে চেয়েছেন; শোষণমুক্ত মনুষ্যসমাজের স্বপ্ন এঁকে দেখাতে চেয়েছেন। স্বপ্ন আর সাধনাকে নিজের মধ্যে একীভূত করতে চেয়েছেন- এসব ব্যাপার সাফল্যের মাপকাঠিতে বিচার্য নয়।
৫.
তাকে বুদ্ধিজীবীও বলা যায় না। সেটা এই কারণে নয় যে, তিনি বিষয়বুদ্ধিহীন কিংবা আত্মস্বীকৃত বোকা মিয়া। আমাদের চারপাশে বুদ্ধিজীবীর যে নমুনাগুলো আছে, তাদের অধিকাংশই যতখানি বুদ্ধিজীবী, তার চেয়েও বেশি বুদ্ধিমান। এদের অর্জনের তালিকা হাতির শুঁড়ের মতো দীর্ঘ, আর বিসর্জনের তালিকা ভেড়ার লেজের মতো দুর্নিরীক্ষ। এদের অনেকেই স্রোতের তালে তালে তবলা বাজান। কখনও কখনও ভিন্ন রকমের কথাও বলেন, তবে সেগুলো নিরাপদ ভালো কথা। ক্ষমতাশালীরা রুষ্ট হতে পারেন, তেমন কোনো কথা সচরাচর বলেন না। যা-ও একটু বলেন, তাও মিডিয়া ভববফনধপশ-এর স্বার্থে। আসহাবউদ্দীনের মডেল ছিল চীনের বোকা বুড়ো, যে কিনা পাহাড় সরাতে গিয়ে কোদাল তুলে নিয়েছিল। আসহাবউদ্দীনও শোষণের অচলায়তন সরাতে গিয়ে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম। ইতিহাস বলে- রাজার হাতে তরবারি, মধ্যবিত্তের হাতে কলম, গরিবের হাতে লাঙ্গল। লাঙ্গল আর কলমের গতিবিধি প্রায় একই রকম- অন্তত আসহাবউদ্দীনের ক্ষেত্রে তা সত্য।
৬.
লেখক হিসেবে তিনি কেমন- এই জিজ্ঞাসার জবাব প্রথাগতভাবে পাওয়া মুশকিল। কেননা, তিনি লেখক হওয়ার উদ্দেশ্যে লেখেননি। শিক্ষাবঞ্চিত মানুষের সংস্পর্শে থাকার জন্য একদা অধ্যাপনা ছেড়ে সাংগঠনিক রাজনীতি করেছেন। নগদপ্রাপ্তিতাড়িত রাজনীতির প্রতি বিমুখ হয়ে একপর্যায়ে লেখালেখিকে সংগ্রামের হাতিয়ার করেন। এই পর্যায়ে, শিক্ষাধন্য মানুষের লুম্পেন-মনোবৃত্তি সংশোধনই ছিল তার লক্ষ্য। অতএব, তার রচনাকর্ম তার সংগ্রামশীল জীবনবোধেরই ইতিহাস। এই ইতিহাসকে রূপতাত্ত্বিক বা রসতাত্ত্বিক মানদণ্ডে বিচার করতে গেলে তার চেতনাভূমির নাগাল পাওয়া যাবে না। যারা তাকে ব্যঙ্গরসাত্মক রচনাকর্মী হিসেবে একদিকে ফেলে রাখতে চাইবেন, তাদের মূল্যায়নকর্মও পড়ে থাকবে আরেক দিকে। কোনো রকম তর্কে না গিয়ে তার রচনাকর্মকে চিন্তাশিল্প হিসেবে গ্রহণ করতে অসুবিধা কোথায়? অভিজ্ঞান আর অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি তো আর্থ-সামাজিক অসঙ্গতিগুলো বিশ্লেষণ করে দেখিয়ে দিয়েছেন। এছাড়াও, তার সাহিত্যে রসের সন্ধানও পাওয়া যাবে। তবে, সেই রস চিরতার রস; যা তিক্ত বটে, তবে দূষিত রক্তের জন্য উপকারী। রক্তের দোষ বলতে আমরা যা ইশারা করি, ঠিক ওই জায়গাটাই আসহাবউদ্দীনের রচনার লক্ষ্যবস্তু। অতএব, তার লেখায় ভোটসর্বস্ব লাড্ডুর মজা খুঁজতে যাওয়া বৃথা।
৭.
আয়নায় তাকালে ডান হাতকে বাম হাত বলে মনে হয়। স্বপ্নের পরিবর্তে এ রকম একটা আয়না আমাদের চোখের সামনে টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে। ধন্য আমাদের রাজনীতি, ধন্য আমাদের শ্রেণিস্বার্থ। প্রগতিশীলতার মৌলিক তাৎপর্য থেকে অনেক দূরে আমাদের সরিয়ে নেয়া হয়েছে। সেখানে পুঁজিবাদী মাকড়সার জাল। আর, আমরা ক্রমাগত আটকা পড়ছি ভুল মৌমাছির মতো।
৮.
দুঃখের বিষয়, আজ পর্যন্ত আমাদের রাজনীতি স্বস্তিদায়ক কোনো দিকনির্দেশনা দিতে পারেনি। অগ্রতার পরিবর্তে উগ্রতার পথে আমাদের ঠেলে দেয়া হয়েছে। উত্তেজনা আর উদ্দীপনাকে আমরা গুলিয়ে ফেলেছি। এই বিভ্রম যাতে না কাটে, তার জন্য ষাট দশকের সুয়োরাণী-দুয়োরাণী সিনেমাটা ভিন্ন আঙ্গিকে লাগাতার প্রদর্শিত হচ্ছে। গরম মশলাযুক্ত দৃশ্যাবলী দেখতে দেখতে আমাদের অন্তর্দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। মহৎ স্বপ্ন দেখার সাহস আমরা হারিয়ে ফেলছি। স্বপ্নের ফেরিওয়ালা আসহাবউদ্দীনও আর নেই- যিনি আমাদের কিছু দিতে চেয়েছিলেন এবং যাকে আমরা কিছুই দিতে পারিনি।
১.১.২০১৫
ময়ুখ চৌধুরী : কবি, অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.