সাক্ষাৎকার- শিক্ষার ক্ষতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে বেড়াতে হবে : রাশেদা কে. চৌধূরী

(বেসরকারি সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযান-এর নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধূরী শিক্ষা ও গবেষণা সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। যুগান্তরের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি চলমান এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ছন্দপতনের নেতিবাচক প্রভাব ছাড়াও প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে খোলামেলা কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- মোকাম্মেল হোসেন)
যুগান্তর : ২০ দলীয় জোটের রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার শুরুতেই ছন্দপতন ঘটেছে, যা অব্যাহত রয়েছে। এর ফলে পরীক্ষার্থীদের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়বে?
রাশেদা কে. চৌধূরী : এসএসসি পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের বড় একটা সোপান। বর্তমানে তারা যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত। একটা তো একদম চোখেই দেখা যাচ্ছে- পরীক্ষার সিডিউল বিপর্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয় ক্ষতিটা হচ্ছে, এটা তো শুধু সিডিউল বিপর্যয় নয়, দেরিতে পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়া এবং পরবর্তী পর্যায়ে গিয়ে ভর্তি হওয়া- এসব অভিঘাত তাদের বিপর্যস্ত করে রাখবে। আমরা যদি এখনই এগুলো সামাল দিতে না পারি, তাহলে ভবিষ্যতে গিয়ে তাদের চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রেও সমস্যা হতে পারে। সবমিলিয়ে এর সুদূরপ্রসারী একটা প্রভাব, অসম্ভব নেতিবাচক একটা প্রভাব আমরা দেখতে পাচ্ছি।
যুগান্তর : তার মানে ক্ষতিটা মোটেই সামান্য নয়?
রাশেদা কে. চৌধূরী : এ ক্ষতিকে ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। দেশের পরিশ্রমী কৃষক, শ্রমজীবী মানুষ, পরবর্তীকালে অতিরিক্ত পরিশ্রম করে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন। পারেনও তারা। বাংলাদেশের মানুষের অসম্ভব রকমের একটা ক্ষমতা আছে দুর্যোগ মোকাবেলার। আমাদের ব্যবসায়ীরাও হয়তো একটা সময় তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নেবেন। বিভিন্ন বিপর্যয়ের পর এ দৃষ্টান্ত তারা রেখেছেন। কিন্তু শিক্ষার যে ক্ষতিটা হল- এ ক্ষতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে বেড়াতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থা কতগুলো ফ্রেমের মধ্যে থাকে। সেটা সময়মতো শেষ করা, সময়মতো কর্মজীবনে প্রবেশ করা- সবকিছুই কিন্তু একটা হোঁচট খাওয়ার জায়গায় চলে গেল। আরেকটা বড় ক্ষতি আছে- সেটা আমরা কীভাবে পুষিয়ে নিতে পারব, জানি না। পরীক্ষার্থীরা এক ধরনের মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড তাদের শিক্ষাজীবন বিপর্যস্ত করে ফেলবে- এটা তারা ভাবেনি। এ জায়গাটা থেকে আমরা তাদের মধ্যে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখতে পাচ্ছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় রাজনীতিকদের প্রতি তারা তাদের বিদ্বেষ ও ঘৃণা ব্যক্ত করছে। পাশাপাশি অস্থিরতা ব্যক্ত করে বলেছে- আমি কবে বের হব! এরকমও দেখেছি- দেশের বাইরে সন্তানকে পড়ালেখা করানোর ক্ষমতা রাখেন, এমন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা বাবা-মাকে প্রশ্ন করছে- ‘এরপরও তোমরা আমাকে এ দেশে লেখাপড়া করতে বল?’ দেশের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মে যাচ্ছে আমাদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে। এবং সেটা শুধু রাজনৈতিক কারণে। এই যে বিষয়গুলো- এর তো একটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব অবশ্যই রয়েছে।
যুগান্তর : পরীক্ষা বিঘ্নিত হওয়ার ঘটনা এবারই প্রথম নয়। আগেও বহুবার রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে বিভিন্ন পর্যায়ের পরীক্ষার ধারাবাহিকতা বিনষ্ট হয়েছে। পরীক্ষা, বিশেষ করে পাবলিক পরীক্ষাগুলো রাজনৈতিক কর্মসূচির বাইরে রাখা উচিত নয় কি?
রাশেদা কে. চৌধূরী : আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমন একটা জায়গায় চলে গেছে- উচিত-অনুচিত, নৈতিকতা, মানবাধিকার- অনেক কিছুই পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সবমিলিয়ে হতাশাজনক অবস্থা- তারপরও একটা প্রত্যাশা থাকে। একটা দাবি থাকে। রাজনৈতিক দলগুলোর অধিকার আছে প্রতিবাদ করার, কর্মসূচি দেয়ার। কিন্তু অন্যের অধিকার খর্ব করে নয়। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার অধিকারকে। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পরিবেশ-নারীর ক্ষমতায়ন- এ চারটি জায়গা সব ধরনের রাজনৈতিক মতানৈক্যের ঊর্ধ্বে থাকা উচিত। এগুলো তো দেশের জন্য। আগামী প্রজন্মের জন্য। ভবিষ্যতের জন্য। সুন্দর একটা আগামীর যে স্বপ্ন আমরা দেখি- যা স্বাধীনতার সূর্য সন্তানরা দেখেছিলেন, সেটা ধূলিসাৎ করে দেয়া হচ্ছে।
যুগান্তর : হরতাল-অবরোধের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচি বন্ধ হোক- এ দাবি দেশের সাধারণ মানুষের। এ দাবি পূরণ না হলেও অন্তত পাবলিক পরীক্ষাগুলো হরতাল-অবরোধসহ সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচির বাইরে রাখতে একটি আইন করা কি জরুরি?
রাশেদা কে. চৌধূরী : ভুক্তভোগীরা নিশ্চয়ই একবাক্যে বলবেন- আইন করা দরকার। আমি মনে করি, রাজনৈতিক কর্মসূচি যাতে পরীক্ষা কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করতে না পারে, সে জন্য আইন করে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। হরতালের ব্যাপারে মহামান্য আদালতের একটা নির্দেশনা রয়েছে- এটা রাজনৈতিক অধিকার, বন্ধ করা যাবে না। কিন্তু জনজীবনে বিপাক-ভোগান্তি তৈরি করে- এমন যে কোনো কিছুর ব্যাপারেই সাংবিধানিক অধিকারের জায়গা থেকে একটা নিষেধাজ্ঞা, একটা আইন থাকা উচিত। ঠিক আছে, আপনারা যে দলেরই হোন- কর্মসূচি দেবেন। কিন্তু আমি রাস্তায় বের হব, আমার কর্মস্থলে যাব, মাঠে কাজ করব- সেটা বন্ধ করতে পারবেন না আপনি।
যুগান্তর : অন্তত ৩০ ভাগ শিক্ষার্থী ৫ম শ্রেণী সমাপ্ত করার আগেই ঝরে পড়ছে। স্কুল থেকে শিশুদের ঝরে পড়া রোধে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন?
রাশেদা কে. চৌধূরী : বর্তমান হিসাব অনুযায়ী ঝরে পড়ার হার ৩০ শতাংশ নয়, এটা ২০ থেকে ২২ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে ২০-২২ শতাংশও অনেক। কয়েক লাখ শিক্ষার্থী। কাজেই এটাকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। ঝরে পড়ার কারণগুলো অনেক জটিল। ঝরে পড়ার একটা বড় কারণ হচ্ছে শ্রেণিকক্ষের মধ্যে পাঠদান পদ্ধতি। পাঠদান পদ্ধতি যদি আকর্ষণীয় না হয়, শিক্ষার্থীরা ঝরে যাবেই। দ্বিতীয় হল, পেটে ক্ষুধা নিয়ে যখন কোনো শিক্ষার্থী ক্লাসে আসে, তখন পড়ালেখা তার মাথায় ঢোকে না। অবশ্য দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারিভাবে স্কুল ফিডিং কর্মসূচি চালু হয়েছে। তবে তা খুবই স্বল্পপরিসরে করা হচ্ছে। তাছাড়া উপবৃত্তিসহ অন্যান্য প্রণোদনামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে ঝরে পড়ার হার কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তারপরও ঝরে পড়া কেন রোধ হচ্ছে না, এর কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে- ক্লাসরুমে শিক্ষক হয়তো ঠিকভাবে পড়াতে পারছেন না বা পড়ানোর সুযোগ পাচ্ছেন না। একজন শিক্ষককে যদি ৬০ থেকে ৭০ জন শিক্ষার্থীর দিকে নজর দিতে হয়, তাহলে মনোযোগ দিয়ে পড়ানো কি সম্ভব? এর ফলে শিক্ষার্থীরা একসময় ঝরে পড়ে। ঝরে পড়ছে যারা, তাদের মোটামুটি চার শ্রেণীতে ফেলা যায়। একটা হচ্ছে, অতি দরিদ্র। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, আদিবাসী জনগোষ্ঠী- যারা তাদের মাতৃভাষায় কথা বলার শিক্ষক পায় না। তৃতীয়টি প্রত্যন্ত চরাঞ্চল, হাওর ইত্যাদি স্থানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী। চতুর্থ হচ্ছে, ভাসমান জনগোষ্ঠী- যেমন বস্তি এলাকা। ওখানে দেখবেন- স্কুলে যাওয়ার হার ঠিক আছে। কিন্তু ঝরে পড়ার হার অনেক বেশি। ঝরে পড়া রোধে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির একটা দায়-দায়িত্ব থাকে। তবে এগুলোর অধিকাংশই রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ায় বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে ইতিবাচক কোনো প্রভাব পড়ে না। কমিটির লোকজন ভর্তি বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা করছে কিনা, ঝরে পড়ছে কিনা, সেদিকে তারা ঠিকমতো নজর দিতে পারেন না। তবে কোনো বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি যখন সচল থাকে, কমিটিতে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান কেউ থাকেন, তখন কিন্তু সেখানে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে।
যুগান্তর : আপনি স্কুল ফিডিংয়ের সীমাবদ্ধতার কথা বললেন। এটি সফলভাবে বাস্তবায়নে সমস্যা কোথায়?
রাশেদা কে. চৌধূরী : স্কুল ফিডিং কর্মসূচির একটা বড় সমস্যা হচ্ছে ম্যানেজমেন্ট। ব্যবস্থাপনায় গোলমাল থাকলে কোনো কর্মসূচি সফল হয় না। ভারতের উদাহরণটা প্রায়ই দেয়া হয়। ভারত শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের বিনিয়োগের লাভজনক ফসল তুলে আনতে পেরেছে। সেখানে স্কুল ফিডিং কর্মসূচির মাধ্যমে ঝরে পড়ার হার কমে গেছে। আমাদের এখানে স্কুল ফিডিং কার্যক্রম কেন্দ্রীয়ভাবে নির্ধারিত, নির্বাচিত এবং অনেকখানি আমলতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রিত। ভারতে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি স্থানীয় সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে লটারির মাধ্যমে ‘মা’ নির্বাচনের কাজটি সম্পন্ন করে। আমি তামিলনাড়ুর একটা স্কুলে দেখেছি, সেখানে মায়েদের ১৫ জনের একটা তালিকা করে দেয়া হয়েছে। প্রতিদিন দু’জন মা রান্না করেন। কোনো মা তার সন্তানকে খারাপ খাবার খাওয়াবেন না- এটা হচ্ছে একটা বড় জাস্টিফিকেশন। রান্নার কাজটা বিনা পয়সায়ও করানো হয় না। যে বাজেট থাকে, সেখান থেকেই তাদের পারিশ্রমিক দেয়া হয়। স্বচ্ছতার জায়গা থেকে যদি দেখি- ভারতে প্রতিদিনের মেন্যু স্কুলের সামনে টাঙানো থাকে। এসব করেই কিন্তু তারা সাফল্য অর্জন করেছে। আমি মনে করি, আমাদের এখানেও স্কুল ফিডিং কার্যক্রমে মায়েদের সম্পৃক্ত করা উচিত। আমরা চাই না- শিক্ষকরা এসবের সঙ্গে জড়িত থাকুক। এতে শিক্ষা কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমরা অনেকদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছি- বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সঙ্গে স্থানীয় সরকারের সম্পৃক্ততা ঘটুক। আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের মহিলা সদস্যদের স্কুল ফিডিং কর্মসূচির সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেয়া যায়। তাদের সঙ্গে থেকে মূল কাজটা মায়েরা করবেন। এভাবে কিন্তু অনেক ভালো ফসল আমরা তুলতে পারতাম। দ্বিতীয় হল- হটকুক মিল। বিস্কুট দিয়ে হবে না। বিস্কুট দিয়ে পুষ্টি হবে, ক্ষুধা মিটবে না। গরম খাবার স্থানীয়ভাবেই দেয়া সম্ভব। যেদিন গরম খাবার দেয়া যাবে না, সেদিন কলা বা অন্যকিছু দেয়া যেতে পারে। এগুলো তো স্থানীয়ভাবেই আহরণ করা সম্ভব। ভারতের সাফল্যের কারণ হচ্ছে- এ প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের পুষ্টির চাহিদা তো মিটছেই, পাশাপাশি স্কুলের প্রতি মা-বাবার আগ্রহও বেড়ে যাচ্ছে। কেননা, যখন কেউ নিজের বাচ্চার খাবার-দাবার তৈরি করে, তখন সে কিন্তু ব্যবস্থাপনার মধ্যেও ঢুকে যায়। ফলে ব্যবস্থাপনাটা উন্নত হতে বাধ্য।
যুগান্তর : আপনি ক্লাসরুমের কথা বলেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে- যোগ্য শিক্ষক তৈরি না করে শিক্ষার গুণগত মান পরিবর্তন করা সম্ভব কি?
রাশেদা কে. চৌধূরী : এককথায় বলা যায়, সম্ভব নয়। শিক্ষক হচ্ছেন শ্রেণিকক্ষের চালিকাশক্তি। আমরা বিশাল বিশাল ভবন করতে পারি। স্কুলঘর, ভৌত অবকাঠামো, প্রশিক্ষিত শিক্ষক- সবই আমরা দিলাম। কিন্তু দেখা গেল- শ্রেণিকক্ষে বাচ্চারা ঝিমাচ্ছে বা পড়তে আগ্রহী নয় অথবা ধারণ করতে পারছে না। আমি তথাকথিত শহরের ভালো স্কুলের কথা বলব না। টপ টেন, শীর্ষ বিশ- এসবের কথাও বলব না। আমাদের গ্রামগঞ্জে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তালিকায় অনেক ভালো স্কুলের নাম আছে। সেখানে হয় প্রধান শিক্ষক না হয় অন্য একজন শিক্ষক চালিকাশক্তি। শিবরাম স্কুলের উদাহরণ সামনে রেখে বলা যায়, এ রকম অসংখ্য স্কুল আছে বাংলাদেশে। দুঃখজনক হল, দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক তৈরির জন্য আমরা বিনিয়োগ করি না। তাদের বেতন-ভাতা এখন তবুও কিছুটা সম্মানজনক পর্যায়ে আছে। আগে সচিবালয়ের একজন পিয়নের চেয়েও কম বেতন ছিল তাদের। শিক্ষকদের আমরা মানুষ গড়ার কারিগর বলব অথচ সেই কারিগরদের পেছনে বিনিয়োগ করব না- এটা তো হয় না। ভারত কিন্তু এটা করেছে। এমনভাবে করেছে, একেবারে প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকদের জন্য সেখানে আলাদা বেতন কাঠামো রয়েছে। আমাদের ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে একটা প্রস্তাবনা আছে শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কমিশন করার। এটা করা সম্ভব না হলে অন্তত শিক্ষা কমিশন করা যায়, তার আওতায় প্রস্তাবনাগুলো আসতে পারে। মনে রাখতে হবে, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা, মর্যাদা যতক্ষণ আমরা নিশ্চিত করতে না পারব, শ্রেণিকক্ষের উন্নতি ঘটানো যাবে না। এর একটা জাজ্বল্যমান উদাহরণ তো চোখের সামনেই আছে। ক্যাডেট কলেজগুলো প্রতিবছর কেন ভালো করছে? ক্যাডেট কলেজের শিক্ষার্থী প্রতি বিনিয়োগ আর সমমানের মূলধারার বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রতি বিনিয়োগে আকাশ-পাতাল তফাৎ। ক্যাডেট কলেজগুলোর দক্ষ-যোগ্য শিক্ষক, উন্নত ভৌত অবকাঠামো, ভালো ল্যাবরেটরি, ভালো লাইব্রেরি- এ সবকিছুর বিনিময়েই তো ভালো ফলটা পাওয়া যাচ্ছে। একটা ডিসিপ্লিনড, ভালো রেজাল্ট করা শিক্ষার্থী আমরা পেয়ে যাচ্ছি। রাষ্ট্রীয়ভাবে অর্থায়নের এ সুফল একটা জায়গায় যদি পাওয়া যায়, আরেক জায়গায় কেন পাওয়া যাবে না? আসলে আমাদের বিনিয়োগটা যথাযথ স্থানে, যথাযোগ্যভাবে ব্যবহৃত হতে হবে।
যুগান্তর : অভিযোগ রয়েছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অন্তত ৭৫ ভাগ শিক্ষার্থী সবকিছু ভালোভাবে শিখছে না। ঝরে পড়ার ক্ষেত্রে এটাও কি একটা কারণ?
রাশেদা কে. চৌধূরী : এটা একটা কারণ বটে। তবে কারণ আরও অনেক। বাচ্চারা যখন ক্লাসরুমে ঢুকে দেখে সে পারছে না- এটা তো তার অক্ষমতা নয়। ব্যবস্থার অক্ষমতা। সিস্টেমের দুর্বলতা। এ দুর্বলতার জন্য তারা ঝরে পড়ে। শিক্ষক যদি শিশুবান্ধব না হন, তাহলে ঝরে পড়ার হার বাড়তে থাকে। শ্রেণিকক্ষ শিশুবান্ধব হওয়াটা খুব জরুরি। ইদানীংকালে একটা কাজ ভালো হচ্ছে। এনসিটিবি বইপত্র শুধু বিনামূল্যেই দিচ্ছে না, ভালো বই, সুন্দর বই দিচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীরা আকৃষ্ট হয়। আমাদের দাবি হচ্ছে- প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে, বিশেষ করে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক পর্যায়ে বাড়তি কিছু বই রাখতে হবে। সুন্দর বই দেখলে বাচ্চারা ধরবেই। এটা শিশু মনস্তত্ত্বের ব্যাপার। দেখবে, উল্টাবে, পড়বে। শ্রেণিকক্ষে বইপত্র ছড়িয়ে দেয়ার কাজটি আমরা করতে পারিনি।
যুগান্তর : আপনি বইয়ের প্রশংসা করলেন। পাঠ্যবইয়ে নানা ধরনের অসঙ্গতির অভিযোগ রয়েছে!
রাশেদা কে. চৌধূরী : আমি কথাটা নেব। তবে আংশিকভাবে। কয়েক বছর আগেও আমাদের পাঠ্যবইয়ে অনেক বেশি অসঙ্গতি ছিল। পাঠ্যবইগুলো করা হতো নিউজপ্রিন্টে। বাচ্চাদের কাছে একেবারেই আকর্ষণীয় ছিল না সেগুলো। দ্বিতীয় হল, ওগুলোর মধ্যে ভুলভ্রান্তি, অসঙ্গতি অনেক কিছু ছিল। তৃতীয় হল, রঙের কোনো বালাই ছিল না। বাচ্চাদের আকৃষ্ট করতে হলে রঙের ব্যবহার করতেই হবে। সেগুলো ছিল না। অনেক বছর পরে আমাদের শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক রিভিউর কাজ শুরু হয়েছে। তারপরও কিছু কিছু অসঙ্গতি রয়ে গেছে- এ কথা সত্য। কিন্তু মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে অনেক বেশি খোলামেলা ও উদার। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হচ্ছে- বই নিয়ে যদি কোনো বক্তব্য ও মন্তব্য থাকে, যে কেউ সেগুলো জমা দিতে পারবেন পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে। প্রতিবছর আমরা এ সুযোগটা নিচ্ছি।
যুগান্তর : ঝরে পড়ার কারণ হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষাকে দায়ী করে এ পরীক্ষা বাতিলের দাবি তোলা হয়েছে।
রাশেদা কে. চৌধূরী : প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা ঝরে পড়ার কারণ-এটা ঢালাওভাবে বলা যাবে না। ঝরে পড়াটা তো শুরু হয় প্রথম শ্রেণী থেকেই। তখন তো সমাপনী পরীক্ষার চিন্তা-ভাবনা থাকে না।
যুগান্তর : ক্লাস ফোরে কিন্তু ঝরে পড়ার পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়!
রাশেদা কে. চৌধূরী : তা বেড়ে যায়। এর অন্য কারণও আছে। মেয়েদের ক্ষেত্রে টয়লেট সমস্যা একটা বড় কারণ। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার চাপটা আমার মনে হয়, নিজেরাই তৈরি করেছি। পরীক্ষাটা হওয়ার কথা ছিল উৎসবমুখর পরিবেশে। একটা সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য বাচ্চারা দৌড়াদৌড়ি করে পরীক্ষায় অংশ নেবে। কিন্তু আমরা এটাকে কোচিং বাণিজ্যের হাতিয়ার বানিয়ে ছিয়েছি। গোল্ডেন-এ, জিপিএ-৫ পাওয়ার জন্য মা-বাবা, অভিভাবকদের ঠেলে দিয়েছি একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্যে। অন্যদিকে বাংলাদেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে, স্কুলগুলোও নেমে পড়েছে অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্যে। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার উদ্দেশ্য তো এটা ছিল না! উদ্দেশ্য ছিল, প্রাথমিক একটা মূল্যায়ন। সেখান থেকে বাচ্চাগুলো কী অবস্থায় চলে গেছে! যেন প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর সার্টিফিকেটই তার জীবনের সবকিছু। একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরির মাধ্যমে এর উদ্দেশ্যটাকে বিনষ্ট করা হয়েছে। আমাদের শিক্ষানীতিতে কিন্তু বলা আছে, প্রাথমিক শিক্ষা হবে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত। তাহলে তো ৫ম শ্রেণীতে সমাপনী পরীক্ষা নেয়ার বিষয়টাই থাকে না। এতে পরীক্ষার বোঝাও যেমন কমবে, পরীক্ষা গ্রহণের যে বিশাল খরচ রয়েছে, সেটাও থাকবে না। এ খরচটা শিক্ষার মানোন্নয়নে ব্যয় করা যাবে। এখন বোধহয় সময় এসেছে, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নিয়ে নতুন করে ভাবনা-চিন্তা করার।
যুগান্তর : প্রশ্নপত্র ফাঁসরোধে সরকার নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করার কথা বলেছে। এটা ফলপ্রসূ হবে?
রাশেদা কে. চৌধূরী : প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি আসলেই মানুষকে নাড়া দিয়েছে। মূল্যবোধের অবক্ষয় কোন পর্যায়ে গেছে- এ প্রশ্ন নিজেকেই নিজে করা উচিত। একেবারে শিশুদের নিয়েও আমরা ছিনিমিনি খেলছি। এখানে অবশ্যই সরকারের একটা দায়িত্ব আছে। মন্ত্রণালয়ও ব্যবস্থা নিচ্ছে। তবে যেটা হল, আমাদের বোধহয় পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কারের কথা ভাবা উচিত।
যুগান্তর : দেশে বছরে অন্তত ৩২ হাজার কোটি টাকার কোচিং বাণিজ্য হচ্ছে। এ অতিরিক্ত অর্থ কেন ব্যয় করবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবক?
রাশেদা কে. চৌধূরী : কোচিং বাণিজ্য একটা ব্যাধির মতো হয়ে গেছে। এটাকে এখন নেতিবাচকভাবে শ্যাডো অ্যাডুকেশন বলা হয়। এ শ্যাডো অ্যাডুকেশনের পাল্লায় পড়ে আমাদের মূলধারার শিক্ষা বিপর্যস্ত হচ্ছে। যে কোনোভাবেই হোক, এটার লাগাম টেনে ধরতে হবে। এ ব্যাপারে মহামান্য আদালতেরও একটা নির্দেশনা আছে। নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও তা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। কারণ মনিটরিংয়ে দুর্বলতা রয়েছে। আমার মত হচ্ছে- কোচিং বাণিজ্য বন্ধে সরকারের হাতটাকে অনেক শক্তিশালী করতে হবে। এটা অন্য কারও পক্ষে সম্ভব নয়। কোচিং কিন্তু একটা ব্যবসা। অন্যদের ঠকিয়ে ব্যবসা- সে রকম নয়। এর সঙ্গে হাজার হাজার মানুষ জড়িত। তাদের রুটি-রুজির বিষয়ও জড়িত। কাজেই এখানে হাত দিতে গেলে সবদিক চিন্তা করে দেয়া উচিত। কোচিংয়ে যারা যাচ্ছে, তারা যেমন এক ধরনের প্রতারণার শিকার হচ্ছে, কোচিং যারা করাচ্ছেন, তারাও প্রতারকের দলের মধ্যে পড়ে যাচ্ছেন। প্রশ্ন হল, এমন কোনো ব্যবসাকে কি আমাদের উৎসাহিত করা উচিত, যেটা ছেলেমেয়েদের ক্ষতির কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে! কোচিং করে রেজাল্ট ভালো করেছে- এ প্রমাণ কেউ দেখাতে পারবে? অবশ্য সরকার একটা বিকল্প ব্যবস্থা করেছিল- ক্লাসের পরে কোচিং। মনিটরিংয়ের অভাবে সেটার সুফলও আমরা পাচ্ছি না। শিক্ষার এমন চাহিদা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে- মানুষ সবকিছুর বিনিময়েও সন্তানদের লেখাপড়া করাতে চায়। এটা হচ্ছে ডিমান্ড। সাপ্লাইয়ের জায়গা থেকে আমরা একটা অনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকে গেছি। এ ব্যাপারে আমাদের কোনো বিধিমালা নেই। কোনো মনিটরিং মেকানিজমও নেই। শুধু একটা নির্দেশনা আছে আদালতের। যেভাবেই হোক, এ ব্যাধি নির্মূল করা উচিত।
যুগান্তর : দেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত। এ বিভাজন নিয়েই বড় হচ্ছে দেশের লাখ লাখ শিশু। জাতীয় ঐক্য ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে এটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না কি?
রাশেদা কে. চৌধূরী : ঐক্য রক্ষায় স্বাধীনতার পরবর্তীকালে জাতীয়করণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু একটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পরে আমরা সেটা আর ধরে রাখতে পারিনি। বিশেষ করে, সামরিক শাসনের সময় এটা একদম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। আমরা যখন মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রবেশ করলাম, তখন এ ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল, ফ্রিডম অব চয়েজ। আপনি যদি সঙ্গতিপূর্ণ ও সচ্ছল হোন, ব্যয়ভার বহন করতে পারেন, তবে যে কোনো শিক্ষাব্যবস্থা পছন্দ করতে পারেন। আমরা ঢালাওভাবে এ সুযোগ করে দিলাম। তবে শিক্ষানীতির মাধ্যমে লাগাম টানার চেষ্টা করা হয়েছে। শিক্ষানীতি ২০১০-এ বলা হয়েছে, মূলধারা তো আছেই, ইংরেজি ও ধর্মীয় মাধ্যমসহ অন্য সব ধারায় ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত কতগুলো ন্যূনতম শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি অনুসরণ করতে হবে।
যুগান্তর : উন্নত দেশে মধ্যম স্তরে কারিগরি শিক্ষায় মেধাবী শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর হার ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ হলেও বাংলাদেশে এ হার ২ থেকে ৩ শতাংশ। দেশের মেধাবীরা এ শিক্ষায় আগ্রহী হচ্ছে না কেন?
রাশেদা কে. চৌধূরী : এটা এখন বোধহয় একটু বেড়েছে। আমরা এমন একটা শিক্ষাব্যবস্থা উপহার দিচ্ছি, সবাই ধরে নিচ্ছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পড়তে হবে। মেধা-মনন ও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে শিক্ষার্থীদের যে কোনো ধারায় যাওয়ার সুযোগ এখানে সীমিত। তবে আমরা জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি করেছি ২০১১ সালে। এটার মধ্যে ভালো কিছু দিক আছে। কেউ যদি ন্যূনতম লেখাপড়া জানে অথবা টেকনিক্যাল কাজ জানে কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার সুযোগ পায়নি, তাকে সার্টিফিকেট দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
যুগান্তর : মেধাবীরা কেন যাচ্ছে না?
রাশেদা কে. চৌধূরী : সত্য কথা হল, আমরা তাদের সুযোগটা দিতে পারছি না। মেধাবীদের আকৃষ্ট করার জন্য স্কলারশিপ, স্টাইপেন্ড ইত্যাদি দেয়া খুবই প্রয়োজন। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আমরা শিক্ষায় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনেক কৃপণ। শিক্ষার বাজেট টাকার অংকে বাড়ছে, কিন্তু জিডিপির খাতে কমছে ক্রমাগত এবং দক্ষিণ এশিয়ায় তা সর্বনিু। আমরা শিক্ষা খাতে জিডিপির ২ দশমিক ৬ শতাংশ ব্যয় করে মধ্য আয়ের দেশ হব- এমন ভাবাটা ঠিক না। শিক্ষিত-প্রশিক্ষিত-দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে গেলে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতেই হবে।
যুগান্তর : ইতিপূর্বে দেশের একটি বৃহৎ এনজিও শিক্ষা কার্যক্রম অর্থাৎ শিক্ষক প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। এনজিওগুলোর পক্ষে কি এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব?
রাশেদা কে. চৌধূরী : বাংলাদেশে এনজিওরা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে কিছু কিছু মডেল তৈরি করেছে। তাদের ভালো ভালো সাকসেস স্টোরি রয়েছে। এগুলোকে মূলধারায় প্রতিফলনের জন্য তো আমরা নিতেই পারি। আমার দুঃখ লাগে, বিদেশ থেকে দাতা সংস্থার আনুকূল্যে কোথায় কলম্বিয়ায় কোনো সাকসেসফুল মডেল আছে, সে সম্পর্কে গবেষণার জন্য আমরা কনসালটেন্ট নিয়ে আসি। তারা আমাদের প্রেসক্রিপশন দিয়ে যান। আমাদের নিজের দেশেই এ রকম আছে! শিবরাম স্কুল আছে আমাদের। ব্র্যাক কিন্তু এখন মূলধারায় ঢুকে গেছে। তারা এখন প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে এবং ভালোও করছে। কাজেই এ মডেলগুলো পরীক্ষামূলকভাবে নেয়া অযৌক্তিক হবে না। বিদেশ থেকে কাউকে ভাড়া করে না এনে দেশের মাটিতে এ ধরনের অভিজ্ঞতা যদি কারও থাকে, যেসব মডেল নিয়ে কাজ করা যেতে পারে। দিনের শেষে একটা কথা মনে রাখা দরকার- মৌলিক শিক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এখানে রাষ্ট্রকে পিছু হটলে হবে না। রাষ্ট্র এখন কী করছে? বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালিত কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে এলিট স্কুলগুলো তো ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ব্যাঙের ছাতার মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্র পিছু হটেছে। এটা ঠিক না। একটা জায়গায় রাষ্ট্রের দায়িত্ব থাকতেই হবে। প্রথম হল, মূলধারার মৌলিক শিক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। দ্বিতীয়, রাষ্ট্রের একটা রেগুলেটরি মেকানিজম থাকতেই হবে। তদারকির দায়িত্ব রাষ্ট্রের হতে হবে। এখন কিন্তু ব্র্যাক সরকারের অনুরোধে সেকেন্ডারি এডুকেশনে কাজটা করছে।
যুগান্তর : তখন তো ব্র্যাকের প্রস্তাবে সরকার রাজি হয়নি।
রাশেদা কে. চৌধূরী : তখন এক ধরনের ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। ব্র্যাকও বাড়াবাড়ি করেছিল। সত্যি কথা বলতে গেলে ব্র্যাকও বুঝতে পারেনি। হুড়মুড় করে তো এসব হয় না। আপনাকে ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। শিক্ষকদের সঙ্গে বসতে হবে। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা খুব বেশি কেন্দ্রীভূত। এগুলো, বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষা স্থানীয় পর্যায়ে যদি দিয়ে দেয়া যেত, খুব ভালো হতো। পার্বত্য জেলাগুলোয় প্রাথমিক শিক্ষা হিল ডিস্ট্রিক্ট পরিষদের কাছে দিতে পারলে অন্যগুলো স্থানীয় সরকারকে দিতে সমস্যা কোথায়? শিক্ষকদের নিয়োগ-বদলি সব করা হয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর থেকে। সে কারণে শিক্ষকরাও জানেন, তারা যদি তিন দিন স্কুলে না আসেন, তাহলে জবাবদিহিতার জায়গায় স্থানীয়ভাবে কেউ নেই। অধিদফতরকে তারা কোনোভাবে ম্যানেজ করে ফেলবেন। এটা তো ঠিক না। নজরদারির কাজটা সবচেয়ে ভালো পারেন ইউনিয়ন পরিষদের একজন চেয়ারম্যান। তিনি অনেক বেশি জানেন তার এলাকা সম্পর্কে।
যুগান্তর : বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ রয়েছে। সুশৃংখল ধারা প্রতিষ্ঠার জন্য কোন কোন বিষয় জরুরি?
রাশেদা কে. চৌধূরী : উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সবকিছু সরকারকেই করতে হবে- এটা ঠিক না। এখানে বেসরকারি উদ্যোক্তা থাকতেই পারে। কিন্তু বেসরকারি উদ্যোগ যখন শুধু মুনাফার জন্য পরিচালিত হয়, তখন উদ্যোক্তাদের নীতি-নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। সেটাই আমরা দেখতে পাচ্ছি। একটা হচ্ছে, তারা ভর্তি বাণিজ্যের মাধ্যমে ব্যবসাটা করতে চাচ্ছেন। দ্বিতীয় হচ্ছে, ন্যূনতম যে দক্ষতা ও যোগ্য-দক্ষ শিক্ষক থাকা দরকার, অনেক প্রতিষ্ঠানেই তা নেই। শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি ছাড়া বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে জনমনে যথেষ্ট অসন্তোষ রয়েছে। আমি মনে করি, ইউজিসিকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি এটাকে এমন শক্তিশালী জায়গায় নিয়ে যাওয়া উচিত, যার হাত যত লম্বাই হোক না কেন, সে যেন নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়।
যুগান্তর : প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতিকে কি মেধা যাচাইয়ের জন্য সঠিক মনে করেন?
রাশেদা কে. চৌধূরী : আমাদের শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় প্রায়ই বিশ্বমানের শিক্ষা অর্জন করার স্বপ্ন দেখান। স্বপ্নটা ঠিক আছে। কিন্তু তা পূরণ করতে হলে, যা করা দরকার, সেটা শুধু পরীক্ষা না। মেধা যাচাই শুধু পরীক্ষার মাধ্যমে হয় না। পরীক্ষার মাধ্যমে ন্যূনতম একটা মান যাচাই হতে পারে। একজন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, তাকে কিন্তু শুধু পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করা হয় না। তার সার্বিক মেধা দেখার ক্ষেত্রে নানা ধরনের বিষয়বস্তু থাকে; বিভিন্ন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়। এখন পর্যন্ত আমরা ওই জায়গায় যেতে পারিনি। সরকারের একটা কর্মসূচি আছে- মেধা অন্বেষণ কর্মসূচি। এ কর্মসূচির উদ্দেশ্যই হল, পরীক্ষার বাইরেও আরও কিছু, আরও যেসব জ্ঞানের ভাণ্ডার আছে, তা অন্বেষণ করা।
যুগান্তর : সৃজনশীল পদ্ধতি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
রাশেদা কে. চৌধূরী : সৃজনশীল পদ্ধতি সময়ের প্রয়োজনে করা হয়েছে। এটা যে কোনো শিক্ষার্থীর জ্ঞানের ভাণ্ডার বাড়ানোর জন্য সহায়ক। তবে আমাদের দুর্বলতাটা অন্য জায়গায়। দুর্বলতা হল- আমাদের প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব রয়েছে। সৃজনশীল পদ্ধতির সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা ছিল- এ পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা যে কোনো একটা পাঠ্যপুস্তকের যে কোনো একটা বিষয়, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়বে-শিখবে-বুঝবে। কিন্তু অনেক সময় শিক্ষক বা প্রশ্নপত্র যারা তৈরি করেন, তারা এমনভাবে কাজটা করেন, শিক্ষার্থীরা শিখেছে কিনা- সেটা সব সময় যাচাই করা যায় না। আমি মনে করি, পাঠ্যপুস্তকের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যদি একজন শিক্ষার্থী ভালোভাবে পড়ে, চর্চা ও অনুশীলন করে, তাহলে সৃজনশীল পদ্ধতি অবশ্যই ভালো। এতে জ্ঞান যাচাইয়ের কাজটা সহজ হয়।
যুগান্তর : আপনি কি ছাত্র রাজনীতি বন্ধের পক্ষে?
রাশেদা কে. চৌধূরী : আমি নিজে ছাত্র রাজনীতির ফসল। আমি এটা বন্ধ করার পক্ষে নই। তবে অসুস্থ ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার পক্ষে। ছাত্র রাজনীতি যখন পচে যায়, দিকভ্রষ্ট হয়; যখন নীতি-নৈতিকতার কোনো বালাই থাকে না, সেই ছাত্র রাজনীতি চাই না। দুঃখজনক হল, আমাদের সময়ে ছাত্র রাজনীতি ছিল মেধাবীদের জন্য। সেখান থেকে ছাত্র রাজনীতি কী করে যেন চলে গেল ‘মানি’ আর ‘মাসলের’ জায়গায়।
যুগান্তর : ছাত্র রাজনীতি পরিশুদ্ধ করার প্রক্রিয়াটা কী হবে?
রাশেদা কে. চৌধূরী : পরিশুদ্ধ করার দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোকে নিতে হবে। এখন তো দলভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি। আমাদের সময় তা ছিল না। আদর্শভিত্তিক ছিল। দলভিত্তিক থেকে আদর্শভিত্তিক করার দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর। ছাত্র রাজনীতি তাদেরই লেজুড়বৃত্তি করে। তারাই পারেন ছাত্র রাজনীতিকে আবার সুস্থধারায় ফিরিয়ে আনতে।
যুগান্তর : নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হলেও এর জন্য যে ব্যাপক প্রস্তুতি, প্রক্রিয়া ও গবেষণা দরকার, তা করা হয়নি। এ প্রেক্ষাপট সামনে রেখে জানতে চাচ্ছি- কোন পথে শিক্ষানীতি?
রাশেদা কে. চৌধূরী : এটা আমার জন্য অবশ্যই ভালো লাগার একটি বিষয়-অনেক বছর পরে হলেও আমরা একটা শিক্ষানীতি পেয়েছি। এ শিক্ষানীতি একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এসেছে। জনমানুষের আলাপ-আলোচনা, এমনকি- যারা এটা নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন তারাও যখন দেখলেন, শিক্ষানীতি আমাদের আগামী স্বপ্ন পূরণের উপযোগী, তখন প্রতিবাদ করা থেকে সরে এসেছেন। আমাদের আশংকা ছিল, একটা সরকার এসে নীতি করে, আরেকটা সরকার এসে তা বাতিল করে দেয়, এক্ষেত্রে যেন এমনটা না হয়। এদিক থেকে শিক্ষানীতির একটা শক্ত ভিত আছে। শিক্ষানীতি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হচ্ছে, এটা বলা যাবে না। তবে বিভিন্ন আঙ্গিকে বাস্তবায়িত হচ্ছে। শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছিল, আমাদের পাঠ্যপুস্তক সংস্কার করা হবে। আমাদের এনসিটিবিকে আরও একাডেমিক লাইনে যেতে হবে। শিক্ষক প্রশিক্ষণ, বিনামূল্যে বইপত্র দেয়া ও বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে এসব করা হচ্ছে। দুটি বড় স্বপ্ন আছে শিক্ষানীতিতে; এক- শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করা। দুই- মানবসম্পদ উন্নয়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া। এ দু’টো জায়গায় আমরা এখন পর্যন্ত অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছি না। অস্বীকার করব না, দুর্বলতাগুলো আছে। তার সঙ্গে বাস্তবায়নেও ধীরগতি আছে। শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি একটা কাজ করেছিল। তারা বলেছিলেন, আমরা যদি জিডিপির ৪ শতাংশ খরচ করি, তাহলে দাতা সংস্থার কাছেও যেতে হবে না। আমরা নিজেরাই শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করতে পারব। যে দেশে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র ১৫ লাখ মানুষ ট্যাক্স দেয়- সেখানে সরকারের রেভিনিউ বাজেটই বা কত? সেজন্যই সরকারের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আমি মনে করি, শিক্ষা খাতে আরও বিনিয়োগ করতে হবে। তা না হলে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ।
রাশেদা কে. চৌধূরী : আপনাকেও ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.