ভালো করে বাংলা বলি by মামুন রশীদ

সময়টা সম্ভবত ১৯৮৫ সালের শেষ ভাগ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বাসে আমার সামনের আসনে বসেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষকের স্ত্রী। তিনি পাশের মহিলা যাত্রীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। এতে হঠাৎ করেই যেন তার প্রতি আমার সব উৎসাহ উবে গেল। তার কথাগুলো, গলার স্বর, শব্দ চয়ন এমনকি বাচনভঙ্গি এতই কর্কশ এবং অমোলায়েম যে, তার সৌন্দর্যের সঙ্গে পুরোপুরি বেমানান। ভদ্রমহিলা যেন অনেকটা খিস্তিখেউর আওড়াচ্ছিলেন। আমার কেন জানি বাংলা ভাষার এ ধরনের ব্যবহার দেখে অস্বস্তি লাগছিল। কিছুদিন আগে বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের বক্তব্য শুনছিলাম। সম্প্রতি হরতাল-অবরোধের কারণে সহিংসতা এবং মানুষ হত্যা বৃদ্ধির আলোকে তারা তাদের নিজ নিজ পরিকল্পনা ও উদ্যোগের কথা বলছিলেন। সরকারি কর্মকর্তারা দলীয় নেতা-নেত্রীর মতো বক্তব্য রাখতে পারেন কি-না কিংবা উচিত কি-না সে ব্যাপারে আমি কিছু বলব না। তবে শীর্ষ পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিদের বক্তব্যে আমি কখনোই 'করতাছি', 'খাইতাছি', 'মাইরা ফালামু', 'পিটাইয়া তক্তা বানাইয়া ফেলুম'-এর মতো শব্দ চয়ন আশা করিনি। প্রজাতন্ত্রের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা দাপ্তরিক বা অফিসিয়াল ভাষা ব্যবহার করবেন সেটাই কাম্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মাঠের বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া এবং সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ তারই প্রমাণ রাখছেন। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতসহ মন্ত্রিপরিষদের অনেক সদস্যেরই বাংলা উচ্চারণ ও পরিবেশন উচ্চমার্গের। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ভাষণগুলো ছিল সুলিখিত। ড. ফখরুদ্দীন আহমদ এমনকি সাবেক সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদও ভালো বাংলা বলতেন। প্রয়াত বিচারপতি হাবিবুর রহমানের তো কোনো তুলনাই ছিল না। যতদূর জানি, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রায় ৭০ শতাংশ কর্মকর্তা মেজর পদ না ডিঙিয়েই অবসরে চলে যান। ব্রিগেডিয়ারের ওপর উঠতে পারেন হাতেগোনা কয়েকজন। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে মেজর জেনারেল পদের কোনো কর্মকর্তা বাংলা এবং ইংরেজিতে পারদর্শী না হলেও ভালো করে কথা বলতে পারবেন। সত্যি করে বলতে কি, আমি মর্মাহত হই যখন একজন মেজর জেনারেলের কাছ থেকে 'করতাছি', 'খাইতাছি' কথা শুনতে হয়। শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কারও কারও বাংলা শুনে কাঁদতে ইচ্ছা করে, বাংলা ভাষার জন্য করুণা হয়। দুঃখ লাগে যখন টেলিভিশনের পর্দায় দেখি বেশিরভাগ ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাই ভালো বাংলা বলতে পারেন না। তাদের প্রায় সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, কেউ কেউ আবার রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র এমনকি শরৎচন্দ্রের উপন্যাস মুখস্থ করে ফেলেছিলেন। বাংলাদেশে ইদানীংকালে বিসিএস কর্মকর্তারা যদিও সিএসপিদের নিয়ে হিংসায় ভোগেন, একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা হিসেবে গর্ববোধ করেন, তাদের অনেকেরই বাংলা উচ্চারণ কিন্তু ভালো নয়। বাংলা ভাষা মধুর ভাষা। এ ভাষাকে আভিজাত্য দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ, কাজী নজরুল, শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, সত্যজিৎ রায়সহ অগণিত লেখক, কবি, ঔপন্যাসিক এবং গল্পকার। জাতির অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক লেনদেন এবং প্রাত্যহিক কাজকর্মেও বাংলার ব্যবহার বাড়ছে। ভালো ইংরেজি বলার সঙ্গে সঙ্গে ভালো বাংলা বলার কোনো সংঘর্ষ নেই। সত্যিকার অর্থে সৈয়দ আলী আহসান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান এমনকি সৈয়দ মনজুরুল ইসলামসহ অনেকেরই ইংরেজি সাহিত্যের জ্ঞানও ঈর্ষণীয়।
আমরা আশা করব, প্রজাতন্ত্রের সব শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তি, কর্মকর্তা এবং কুশীলবরা শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ করবেন, ভালো বাংলায় কথা বলবেন ও লেখার চেষ্টা করবেন। সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বিপিএটিসি, সামরিক কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্টাফ কলেজ এবং পুলিশ একাডেমিতে সঠিক বাংলা উচ্চারণ ও শুদ্ধ বাংলায় কথোপকথন দৈনন্দিন প্রশিক্ষণের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। চলুন, আমরা সবাই ভালো করে বাংলা বলি। বাংলা শুধু আমাদের মায়ের ভাষা নয়, অদূর ভবিষ্যতের একটি সমৃদ্ধ জাতির যোগাযোগের মাধ্যমও।
অর্থনীতি বিশ্লেষক ও উদ্যোক্তা

No comments

Powered by Blogger.