এক যুগে বাঙালিসমগ্র জাদুঘর by তারিক রহমান সৌরভ

২০০৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে বাঙালিসমগ্র জাদুঘরের প্রতিষ্ঠা হয়। এক যুগে পদার্পণ করছে বাঙালিসমগ্র জাদুঘর। বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বহুমুখী ধারাকে সমৃদ্ধ ও বেগবান করতে যেসব কীর্তিমান বাঙালি বিশেষ অবদান রেখেছেন, তাদের সৃষ্টি ও কর্ম সংগ্রহ, স্থায়ী সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের লক্ষ্যেই এ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠা হয়। প্রতিষ্ঠালগ্নে মাত্র ২০টি মূল স্মারক নিয়ে এই জাদুঘরের যাত্রা হলেও বর্তমানে জাদুঘরে প্রদর্শিত স্মারক ৭০টি আর সংগৃহীত স্মারক শতাধিক। উল্লেখযোগ্য স্মারকগুলোর মধ্যে রয়েছে_ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি বাংলা ও ইংরেজি কবিতার মূল কপি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত ধূমকেতু পত্রিকার মূল কপি, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পাণ্ডুলিপি, বেগম রোকেয়ার হাতের লেখা চিঠি, সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর গানের স্বরলিপি, শিল্পী আবদুল লতিফের ব্যবহৃত দোতারা, চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবিরের মুভি ক্যামেরা, প্রথম বাঙালি মুসলমান চিত্রকর কাজী আবুল কাশেমের আঁকা তৈলচিত্র, পটুয়া কামরুল হাসানের আঁকা স্কেচ, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ অন্যান্য দুর্লভ স্মারক এবং বিশিষ্ট বাঙালির অর্ধশতাধিক হাতের লেখা চিঠি ও পাণ্ডুলিপি। ৫০টি পোট্র্রেট নিয়ে জাদুঘরের যাত্রা শুরু হলেও ১১ বছরে এই পোট্র্রেট সংখ্যা ৬৫। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়াত বিশিষ্ট বাঙালির পোট্র্রেটগুলো চারটি ভাগে বিভক্ত হয়ে জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে। প্রায় ১৫শ' বই নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি গ্রন্থাগার, যা এই জাদুঘরে আসা দর্শকদের বিভিন্ন কীর্তিমান বাঙালির জীবন ও কর্ম সম্পর্কে অবহিত করে। ২০টি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছে বাঙালিসমগ্র জাদুঘর। ২০০৬ সালে বাঙালিসমগ্র জাদুঘর নিজস্ব ওয়েবসাইট উদ্বোধন করে। বিগত ১১ বছরে চারটি প্রকাশনা ও একটি গবেষণাকর্ম পরিচালনা করেছে বাঙালিসমগ্র জাদুঘর। আরও তিনটি প্রকাশনা প্রক্রিয়াধীন। গবেষণাকর্মের শিরোনাম_ 'পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ ও পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে প্রদত্ত জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ-১৯৫৪-১৯৫৮।' আগামী মাসে গবেষণা কর্মটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে হস্তান্তর করা হবে। ২০১১ সালে বাঙালিসমগ্র জাদুঘর বিশ্বকবির সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্মারক বক্তৃতার প্রচলন করে। এ পর্যন্ত চারটি স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করা হয়েছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, রবীন্দ্র গবেষক অধ্যাপক আনিসুর রহমান, ঢাকা বিশ্ব্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক বিগত চার বছরের স্মারক বক্তা ছিলেন। বিগত ১১ বছরে বাঙালিসমগ্র জাদুঘরের পথচলার পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাঙালির গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দিতে বাঙালিসমগ্র জাদুঘর নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনীতির স্বচ্ছন্দ গতিময়তা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক পরিবেশে কাজ করতে উৎসাহিত করে সবসময়। কয়েকশ' বছরের সেরা বাঙালিদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের অসামান্য কর্মকুশলতা ও অর্জন বর্তমানে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য আগামী প্রজন্মের কাছে একটু ধূসর প্রেক্ষিতে উপস্থাপিত হচ্ছে না? বাঙালির হাজার বছরের গৌরব ও অর্জন যা বাঙালিসমগ্র জাদুঘর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করে বাঙালি জাতিকে গৌরব ও মর্যাদার আসনে সমাসীন করতে চায়_ সেই প্রয়াস হীন ও ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থের চক্রান্তে লিপ্ত বিরোধী রাজনীতির অশুভ উদ্দেশ্যের কাছে যদি পরাভূত হয়, তাহলে কী হবে? বাঙালি সবসময় সব ষড়যন্ত্র ও অন্যায় প্রতিরোধকে সাহস ও ধৈর্যের সঙ্গে প্রতিহত করে বিজয়ী হয়েছে। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটবে না। বিগত সময়ে যেসব দর্শক, শুভানুধ্যায়ী এই জাদুঘরে এসেছেন, তাদের শুভেচ্ছা জানাই। আপনিও আসুন বাঙালিসমগ্র জাদুঘরে।

No comments

Powered by Blogger.