শিশুদের আতঙ্কের ভবিষ্যৎ- সহিংসতায় নিহত মোট ১০ শিশু, আহত কমপক্ষে ২০ শিশু by শেখ সাবিহা আলম

৪ ফেব্রুয়ারি। অন্য দিনের মতো রাকিব মিয়া (১২) বাসে করে আড়তে যাচ্ছিল সবজি কুড়াতে। পেট্রলবোমা হামলায় ওর গোটা গায়ে আগুন ধরে গেল। কেউ একজন বলল মাটিতে গড়াগড়ি করতে। রাকিব গড়াতে লাগল। আগুন তবু নেভে না। গুরুতর দগ্ধ রাকিব হিউম্যান হলারে করে বাড়ি পৌঁছাল। ঢুকে চিৎকার, ‘আম্মা, আমারে বাঁচাও’। সেই রাকিব এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা বলছেন, চলমান সহিংসতা শিশুদের বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। পরিবার ও চেনা পরিবেশ থেকে তাদের থাকতে হচ্ছে দূরে। কেবল দগ্ধ শিশুরা নয়, দগ্ধ স্বজনদের শিশুদেরও কাটছে আতঙ্কের অস্থির সময়। যার প্রভাব পড়ছে অন্য শিশুদের ওপরও। এতে তারা একটা অস্বাভাবিক, আতঙ্কের ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জে পেট্রলবোমায় দগ্ধ আড়াই বছরের সাফির, গাজীপুরে সাত বছরের মরিয়ম ও ১২ বছরের রাকিব এখন তাই বার্ন ইউনিটে মানুষের ভিড় দেখলেই ভয়ে কুঁকড়ে যায়। চার বছরের ইফাত দূর থেকে দগ্ধ বাবা জামদানি কারিগর হারিসকে দেখে, কাছে ঘেঁষতে চায় না। বাবা নিহত হয়েছেন ‘বন্দুকযুদ্ধে’। তাঁর লাশ নিতে রাতের বাসে মায়ের সঙ্গে ঝিনাইদহ থেকে সরাসরি মর্গের ফটকে হাজির হওয়া শিশুটিও ছিল বিষণ্ন, চোখেমুখে আতঙ্ক।
৩৬ দিন ধরে টানা অবরোধ-হরতালে চলমান সহিংসতায় গতকাল সোমবার পর্যন্ত দগ্ধ হয়ে নিহত ৫১ জনের মধ্যে ১০ জন শিশু। মৃত্যুর মুখোমুখি আরও দুই শিশু। এ ছাড়া আহত অন্তত ২০ শিশু।
চিকিৎসক, সমাজবিজ্ঞানী ও মনোরোগ চিকিৎসকেরা বলছেন, সহিংসতার সরাসরি শিকার হয়েছে এমন শিশুদের দীর্ঘ মেয়াদে শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হবে। যে শিশুরা সহিংসতার খবর রাখছে, হরতাল-অবরোধে আহত বা নিহত হওয়ার ভয়ে স্কুলে যেতে পারছে না বা বাড়ি থেকে বেরোতে পারছে না, তাদের বিকাশও ব্যাহত হচ্ছে। যেসব শিশুর স্বজন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে, রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি তাদের তৈরি হচ্ছে বিতৃষ্ণা।
খেলাঘরের চেয়ারপারসন মাহফুজা খানম প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিশুকে সুস্থ, স্বাভাবিক ও বিবেকবান করে গড়ে তুলতে একটা সুষ্ঠু পরিবেশ দরকার। শিশুরা মানুষের কাছ থেকে দয়া-মায়া-মমতা-সহায়তা চায়। এখন তারা মানুষের একটা দানবীয় রূপ দেখছে। বড়দের প্রতি, রাজনীতিকদের প্রতি তাদের একটা বিরূপ ধারণা হচ্ছে। বাঙালি প্রয়োজনের সময় এক হতে জানে। আশা করি, এ সমস্যা উত্তরণে সাধারণ মানুষ একতাবদ্ধ হবে।’
কীভাবে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু
চিকিৎসকেরা বলছেন, পেট্রলবোমায় শিশুদের শরীর গভীরভাবে পুড়ে গেছে। তাদের ক্ষতস্থানে চামড়া লাগাতে হবে। অনেক ক্ষেত্রেই এই শিশুদের দুই হাড়ের সংযোগস্থলগুলো বেঁকে যেতে পারে। পূর্ণ বয়সে মেয়েদের দেহের স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ফুলে উঠতে পারে পুড়ে যাওয়া জায়গাগুলো।
শারীরিক এই সমস্যাগুলোর পাশাপাশি এই শিশুরা মানসিক সমস্যায় ভুগতে পারে। অনেক শিশুই ঠিকমতো ঘুমাতে পারবে না, দুঃস্বপ্ন দেখবে, খাওয়ার রুচি থাকবে না, কোনো কিছুতে অনেক সময় আগ্রহ পাবে না। ভুগতে পারে শেখার সমস্যায়।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিক্ষক হেলাল উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, মাতৃগর্ভের স্মৃতিও শিশুদের মনে থাকতে পারে। আড়াই বছরের সাফির কখনো হামলার কথা ভুলে যাবে না। দগ্ধশিশুদের প্রত্যেকে মানুষের প্রতি তাদের আস্থা হারিয়ে ফেলবে। অনিশ্চয়তা আর আতঙ্কের মধ্যে বেড়ে ওঠায় তারা সহজে কারও সঙ্গে মিশতে পারবে না। বিষণ্নতায় ভুগবে।
যাদের মা-বাবা বা কাছের মানুষ দগ্ধ হয়েছে, তাদের একটি বড় অংশ এখন আর নিজের পরিবারে চেনা পরিবেশে থাকার সুযোগ পাচ্ছে না। গত ৫ জানুয়ারি ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের সামনে মো. সিদ্দিকের ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় পেট্রলবোমা ছুড়ে মারে দুর্বৃত্তরা। স্ত্রী শিরীন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, এক মাস ধরে তাঁর তিন সন্তান তিন আত্মীয়ের বাসায়। সবচেয়ে ছোটটির বয়স আড়াই বছর। একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে কর্মরত সাইদা ফাতিমার সন্তান রীমের বয়স এক বছর চার মাস। ২৩ জানুয়ারি গুলিস্তান থেকে ভুলতাগামী বাসে পেট্রলবামা হামলায় দগ্ধ হন সাইদা ও তাঁর স্বামী ইয়াসির আরাফাত। সেই থেকে রীম মা-বাবা ছাড়া।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বেশ কয়েকজন দগ্ধ ব্যক্তির স্বজন বলেছেন, তাঁদের সন্তানেরা দগ্ধ বাবার কাছে আসতে ভয় পাচ্ছে।
সমাজবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাহবুবা নাসরীন বলেন, দেশের চলমান পরিস্থিতিকে যেকোনো বিবেচনায় দুর্যোগ বলা যায়। আর এই দুর্যোগের শিকার শিশুগুলো পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে অপুষ্টিতে ভুগতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।
এই সহিংসতার প্রভাব কিশোরদের ওপর পড়ে আরও গভীরভাবে। জাতিসংঘের ‘ইমপ্যাক্ট অব আর্মড কনফ্লিক্ট’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অশান্ত পরিস্থিতিতে কিশোরদের প্রতিক্রিয়া হয় অন্যভাবে। অনেক কিশোরের ওপর ছোট ভাইবোনের দেখাশোনার দায়িত্ব বর্তায়। এ ছাড়া কিশোর-কিশোরীদের কাছে তাদের মা-বাবা কিংবা পরিবার প্রধান হন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। এঁরা যখন আঘাতে বিপর্যস্ত হন, তখন বাড়ির কিশোর সদস্যরা ভেঙে পড়ে।
যারা সহিংসতার সরাসরি শিকার নয়, তারাও এর প্রভাবমুক্ত নয়। তাদের সহপাঠীরা আক্রান্ত হচ্ছে। যশোরের মাইশা তাসনীমের সহপাঠীরা, ফেনীতে অনীক আর হৃদয়ের সহপাঠীরা রাস্তায় নেমে এসেছে। রাজধানীর বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়া কমপক্ষে আটজন শিশুর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের প্রত্যেকেই জানে, দেশে একটা বিরূপ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। প্রায় প্রত্যেকে বলেছে, বাড়ি থেকে বেরোলেই বোমা হামলার শিকার হতে পারে—এই আশঙ্কায় তারা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করেছে। তিনটি কন্যাসন্তানের জনক পেশায় চিকিৎসক একজন বাবা প্রথম আলোকে বলেন, বাড়ি থেকে বেরোবার পর আলাদাভাবে তাঁর তিন মেয়ে প্রতিদিন অসংখ্যবার ফোন করে। দিনভর তারা উদ্বেগ আর আতঙ্কে দিন কাটায়।

No comments

Powered by Blogger.