কষ্টে আছেন নির্বাচনের আগে পেট্রলবোমায় নিহতদের স্বজনেরা- প্রতিশ্রুতি রাখেনি কেউ

(পেট্রলবোমা হামলায় অগ্নিদগ্ধ রাজু আহমেদ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে (২০) চিকিৎসাধীন। তাঁর শরীরের ১৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। দগ্ধ রাজুর পাশে দুশ্চিন্তায় মগ্ন এক স্বজন l ছবি: প্রথম আলো) ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে পেট্রলবোমায় দগ্ধ ব্যক্তিদের কথা যেন ভুলে গেছে সবাই। প্রতিশ্রুতি দিয়েও সরকার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তা রাখেনি। প্রতিশ্রুতিদাতাদের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কষ্টে থাকা ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট থেকে পাওয়া নথিপত্র অনুযায়ী, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন ২৪ জন, আহত হয়েছেন ৭৪ জন। নিহত ১৩ ব্যক্তির স্বজনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁদের সবার পরিবারেই কষ্টের চিত্র। নিহত ব্যক্তিদের বয়স ছিল ১৬ থেকে ৫৫। আহত ব্যক্তিদেরও অনেকের অবস্থা দুর্বিষহ। বার্ন ইউনিট ছাড়ার পর দীর্ঘদিন ব্যয়বহুল চিকিৎসা করেও তাঁদের অনেকে এখনো পুরো সুস্থ হতে পারেননি।
জানা গেছে, বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আহত ব্যক্তিদের প্রায় সবাইকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ১০ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের ৫০ হাজার করে টাকা দেয় এবং স্বজনকে চাকরির ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দেয়। একজন লিফট অপারেটরের চাকরি পেয়েছেন। আর কেউ চাকরি পাননি, এমনকি তাঁরা যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন বলে জানান।
এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহ্মদ জানান, চাকরি দেওয়ার বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন। যাঁরা অক্ষম হয়ে পড়েছেন, তাঁদের হয়তো চাকরি দেওয়া সম্ভব নয়। যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের পরিবারে চাকরিযোগ্য কেউ আছে কি না, সে বিষয়ে খোঁজখবর করা হচ্ছে। একজনকে চাকরি দেওয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া এখনো শেষ হয়নি। এ বছর নতুন করে যখন সাধারণ মানুষ দগ্ধ হতে শুরু করে, তখন নতুন করে পুনর্বাসনের জন্য বার্ন ইউনিট থেকে তালিকাও চাওয়া হয়।
দুই সপ্তাহ আগে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে নিহত ও আহত ব্যক্তিদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন। অসহায় পরিবারগুলোকে দেখার প্রতিশ্রুতি দেন তাঁরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাসানুল হক ইনু বলেছেন, গত দফায় যাঁরা মারা গেছেন ও পঙ্গু হয়েছেন, তাঁদের এবং এবার যাঁরা নিহত ও আহত হয়েছেন, তাঁদের জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সে নিয়ে আলোচনা চলছে।
কেমন আছেন নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা: ২০১৩ সালের ১০ নভেম্বর লেগুনায় পেট্রলবোমা হামলায় শরীরের ৯০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল মন্টু পালের। চার দিন পর তিনি মারা যান। তাঁর স্ত্রী মঞ্জু রানি পাল এখন থাকেন নারায়ণগঞ্জে বাবা পরেশ পালের বাড়িতে। ষাটোর্ধ্ব পরেশ পাল মূর্তি গড়েন, পূজার মৌসুম ছাড়া আয়-রোজগার থাকে না। পরেশ পাল বলেন, ‘কেমন আর আছি? মেয়েটা এইভাবে পইড়া রইল। বিজিএমইএ বলছিল ছেলেকে চাকরি দিব। প্রধানমন্ত্রীও তো দায়িত্ব নিব বলছিলেন? কেউ খোঁজ করে না। বিজিএমইএ তো ফোনই ধরে না।’
বিজিএমইএর সভাপতি আতিকুল ইসলাম দাবি করেছেন, তাঁরা রানা প্লাজা ধসে নিহত ও আহত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের কথা বলেছিলেন। রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত ব্যক্তিদের ব্যাপারে তাঁদের কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না।
অটোরিকশার চালক আবুল কাশেম (৫০) ২০১৩ সালের ১২ নভেম্বর ফেনীর মুন্সিরহাট বাজারে যাচ্ছিলেন। অটোরিকশায় পেট্রলবোমা হামলায় তাঁর শরীরের ৭৬ শতাংশ পুড়ে যায়। তিনি দুদিন পর মারা যান। রেখে যান পাঁচ ছেলেমেয়ে। বড় ছেলে মো. কায়সার জানান, তিনি ছয় হাজার টাকা বেতনে ফেনীতে এক চিকিৎসকের সহকারীর চাকরি করেন। এই টাকায় থাকা-খাওয়া, দ্বিতীয়, সপ্তম ও দশম শ্রেণিপড়ুয়া ভাইবোনের পড়ার খরচ চলে।
অটোরিকশাচালক আসাদুল গাজী (৪০) সপরিবারে ঢাকায় থাকতেন। তাঁর মৃত্যুর পর স্ত্রী মর্জিনা ঠিকা ঝিয়ের কাজ নিয়েছেন, সন্তানদের বরিশালে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৫ দিন আগে আমাদের নিয়া গেছিল। অনেক অনেক কথা বলছে। আর দুই হাজার ট্যাকা দিছে। বলছে, সরকার সাহায্য করবে। কবে করবে জানেন?’
গাজীপুরের বন্দানের বাসিন্দা আল আমিনের (৩৫) ভগ্নিপতি মো. হানিফ জানান, আল আমিন ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম। একটা গাভি ও অল্প জমি ছিল তাঁদের। সংসার চালাতে বৃদ্ধ মা-বাবা সেগুলো বিক্রি করে দিয়েছেন। নওগাঁর মহাদেবপুরের শাহীন সিরাজগঞ্জের কড্ডার মোড়ে ট্রাকে পেট্রলবোমা হামলায় দগ্ধ হয়ে মারা যান। শাহীনের ছোট ভাই শাহাদৎ বলেন, ‘কেউ কোনো খোঁজ নেয় না। হাসপাতাল থিনে বলেছিল কাগজপাতি জমা দিতি। তারপর কোনো রেজাল্ট পাইনি। এমপি সাহেবও কথা দিয়েছিলেন। তারও কোনো খবর নেই।’
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে ১০ লাখ টাকার স্থায়ী আমানত করে দেওয়া হয়েছে আবদুল আজিজের স্ত্রীর নামে। প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে পান। একই অবস্থা পুলিশ কনস্টেবল ইমাম হোসেনের স্ত্রী আয়েশা খাতুনের। স্কুলপড়ুয়া দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে তিনি কায়ক্লেশে জীবন কাটাচ্ছেন।

No comments

Powered by Blogger.