বন্ধ করুন এই রাজনীতি by আলমগীর খান

সারাদেশে দরিদ্র, কর্মজীবী, নিরীহ মানুষ পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। নারী ও শিশুরা পর্যন্ত বাদ যাচ্ছে না। আবার যারা আহত হয়ে বেঁচে থাকছেন, তারা কেউ কেউ সারাজীবন এর যন্ত্রণা ও ভয়াবহ অভিজ্ঞতা ভোগ করে যাবেন। যারা মারা গেছেন, তারা এমন বহু মানুষকে দুনিয়ায় ফেলে রেখে গেলেন, যারা খাওয়া-পরা, শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা ও জীবনযাপনের নানা কারণে তাদের ওপর সম্পূর্ণ ও আংশিকভাবে নির্ভরশীল ছিলেন। যে দেশে এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র সামান্যই তার দায়দায়িত্ব পালন করে, সে দেশে পরিবারের একজনকে হারানো যে একটি পরিবারের জন্য কত বড় ট্র্যাজেডি, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবেন না। আমরা যারা গরিব কিন্তু একটু-আধটু পড়তে-লিখতে পারি, তারা খবরের কাগজে আমাদের অনেক প্রিয় নেতা-নেত্রীর বাপ-মা-ভাইবোন-পুত্রকন্যা হারানোর অন্তর্বেদনার কথা পড়ি ও কেঁদে বুক ভাসাই। কারণ আমরা সে বেদনাটা বুঝি। কিন্তু নেতা-নেত্রীদের যারা বেঁচে থাকেন তারা কি আমাদের মতো অসহায় অবস্থায় পড়েন? পড়েন না বলেই তারা আমাদের কষ্টটা বোঝেন না। আমরা এও শুনি_ অমুকের মৃত্যুতে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। তবে গরিব মানুষরা পেট্রোল বোমায় পুড়ে মারা গেলে যে জাতির কোনো লাভক্ষতি হয় না, তা আমরা ভালো করেই জানি। নেতা-নেত্রীরা তা আরও ভালো করে জানেন বলেই দীর্ঘদিন ধরে চলছে এই মরণখেলা। রাজনীতিক নামধারী বাংলাদেশি মহামানব-মানবীদের খেলাই বটে!
মনে আছে কুড়িগ্রামে পঞ্চম শ্রেণীর মেধাবী ছাত্রী নিহত জেসমিনের মায়ের আহাজারি? তিনি বলছিলেন, 'মোর বেটিক যাই মারছে, আল্লাহ যেন তাকও এইভাবে মারে। মোর বেটির কী দোষ আছিল, ওরা ক্যানে মোর বেটিক মারিল। মুই আজনীতি বোঝং না, আজনীতি করং না, মুই বিচার চাং।' এ আহাজারি আর অভিশাপ আজ সবার।
এখন রাষ্ট্রীয় মঞ্চে গণতন্ত্র রক্ষার নাটক চলছে। একপক্ষ বলছে, গণতন্ত্র লাশ হয়ে শুয়ে আছে; অন্যপক্ষ বলছে, গণতন্ত্র খুশিতে লাফাচ্ছে। মঞ্চাভিনয়ের আড়ালে চলছে আরেক খেলা, গদি নিয়ে টানাটানি। বৃহৎ জনগণ এই গদি টানাটানির যুদ্ধে নেই, কিন্তু তারা এর কোলাটারাল ড্যামেজ বা আবশ্যকীয় অপচয়। সামান্য একটা গদিতে কী আছে? জনগণ এটাই বোঝে না, বোঝে না যে গদিটা সামান্য নয়, অসামান্য। বাংলাদেশে অলৌকিক উন্নতি লাভের নিশ্চিত সিঁড়ি হেথায়। হেথায় বিনা পুঁজি, বিনা মেধা, বিনা শ্রমে সব পাওয়া যায়_ ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি, গাড়ি-বাড়ি কী নয়? গদির আশপাশে থাকার জন্য যে পুঁজি, মেধা ও শ্রম প্রয়োজন তা সামান্য নয়। আমাদের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলকে ঘিরে এই ব্যবস্থাটা গড়ে উঠেছে। জনগণ যতক্ষণ এই গদির মাজেজা না বুঝছে, ততক্ষণ এই গদি টানাটানি যুদ্ধের কোলাটারাল ড্যামেজ হয়েই তাদের বাঁচতে হবে।
বাংলাদেশে আওয়ামী-বিএনপির দুটি যুদ্ধংদেহী ক্যাম্পে বিভক্ত হয়ে পড়ার কোনো কারণ আছে কি? এই দুটি দল কি দুটি ভিন্ন ধর্মীয়, ভিন্ন জাতিক, ভিন্ন ভাষিক দল? যে দেশে ধর্মীয়, জাতিগত, ভাষিক ইত্যাদি বিভক্তি দুনিয়ার অন্যান্য দেশের চেয়ে আশ্চর্যরকম কম, সে দেশে এ যুদ্ধ কিসের আলামত? আমাদের দুটি প্রধান দলের মধ্যে যে ফ্যাসাদ, শুভবুদ্ধির জয় হলে সারাদেশের মানুষকে জিম্মি না করেও তা ফয়সালা করা যায়। সব শুভবুদ্ধিসম্পন্ন রাজনীতিক দেশ থেকে এখনও হারিয়ে যাননি। তাহলে দেশটাকে কেন পোড়ানো এবং এর রূপ ও প্রকৃতিকে খামাখা বিকৃত করা? যে দেশের কবি গেয়েছেন, 'সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই'_ সেই দেশ পুড়িয়ে বংশী বাজানোর পরিণতি কী হবে আমাদের জানা নেই।
গবেষক, ঢাকা

No comments

Powered by Blogger.