চরম ঝুঁকিতে পোশাক শিল্প- অর্ডার বাতিল ৪০ শতাংশ; এ পর্যন্ত ক্ষতি ৮৬০০ কোটি টাকা by জিয়াউল হক মিজান

তৈরী পোশাক শিল্প থেকে অর্জিত রফতানিতে ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৩ শতাংশ। বিদায়ী অর্থবছরে প্রায় এক শতাংশ বেড়ে প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ১৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে মাত্র এক শতাংশ। এ সময়ের অর্জন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পিছিয়ে আছে পাঁচ শতাংশ। যদিও চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় ক্ষতির পুরো চিত্র এটি নয়। ক্ষতির প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠবে আরো কয়েক মাস পর যখন বর্তমানে যেসব অর্ডার বাতিল হচ্ছে সেগুলোর টাকা প্রাপ্তির সময় আসবে। ভুক্তভোগী পোশাক শিল্পমালিকদের হিসেবে, অর্ডারের এ ভরা মওসুমে নতুন অর্ডার তো আসছেই না, বাতিল করা হয়েছে অন্তত ৪০ শতাংশ অর্ডার। বিশেষজ্ঞদের মতে, চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তা রফতানি আয়ে ৮০ শতাংশ অবদান রক্ষাকারী দেশের তৈরী পোশাক শিল্পকে চরম ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। হতাশায় ডুবিয়ে দিচ্ছে বস্ত্র খাত ও এর সাথে যুক্ত পশ্চাদ শিল্পগুলোর ৫০ লাখ মালিক-শ্রমিক এবং তাদের পরিবারকে। সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় তৈরী পোশাকের বিদেশী ক্রেতারা চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছেন। তারা নতুন অর্ডার দিতে এবং আগের অর্ডার অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন তদারকি করতে এ দেশে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন। সময় মতো সরবরাহ পাবেন না এ শঙ্কায় আগের দেয়া অর্ডার বাতিল করছেন কিংবা কমিয়ে দিচ্ছেন। অর্ডার সরিয়ে নিচ্ছেন ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে। ফেব্রুয়ারি-মার্চকে অর্ডারের মওসুম উল্লেখ করে শিল্পমালিকেরা জানান, ভরা মওসুমে বায়ার না পাওয়ায় অন্ধকার দেখছেন তারা। আগামী তিন মাস পর হাতে কোনো কাজ থাকবে না জানিয়ে তারা বলেন, তখন বাধ্য হয়ে হাজার হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করে কারখানা বন্ধ করে করে দেয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।
সঙ্কটের বর্ণনা দিতে গিয়ে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, হরতাল-অবরোধে বিদেশ থেকে আমদানি করা কাঁচামাল কারখানায় আনতে পারছি না আমরা। ঠিকমতো কাজ না হওয়ায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য উৎপাদন করতে পারছি না। যেসব পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে সেগুলোও সময়মতো চট্টগ্রাম বন্দরে তৈরী পোশাক পৌঁছাতে পারছি না। বাধ্য হয়ে চার গুণ বেশি ভাড়া দিয়ে জাহাজের পরিবর্তে বিমানযোগে পণ্য পাঠাতে হচ্ছে। এয়ার শিপমেন্টে যে বাড়তি খরচ হচ্ছে তার প্রায় পুরোটাই লোকসান হিসেবে গুনতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী দিনগুলোতে হাজার হাজার কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে পুঁজি করে ভারত ও ভিয়েতনাম বাংলাদেশের ইউরোপীয় বাজার দখল করতে যাচ্ছে জানিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিযুক্ত বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টা জিল্লুল হাই রাজি বলেন, বাংলাদেশের তৈরী পোশাক রফতানি অনেকটাই ইউরোপনির্ভর। ইউরোপের বাজারে বর্তমানে ভিয়েতনাম রফতানি করে তাদের মোট রফতানির ২২.৩ শতাংশ। ভারতের অবস্থান এ ক্ষেত্রে মাত্র ১৬.৭ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশের মোট রফতানিবাজারের ৫৪.৪ শতাংশই ইউরোপ। এমনই একটি প্রেক্ষাপটে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভারত ও ভিয়েতনামের সাথে নতুন করে ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (এফটিএ) করতে যাচ্ছে। তার আশঙ্কা, এর ফলে ইউরোপে ভারত ও ভিয়েতনামের রফতানি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে। স্বাভাবিক কারণেই সবচেয়ে বড় বাজারে মার খেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এ শঙ্কাকে আরো উসকে দেবে বলে আশঙ্কা অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের।
জিএমইএ সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, এক দিনের হরতাল বা অবরোধে তৈরী পোশাক শিল্পে অন্তত ২১৫ কোটি টাকার উৎপাদন ব্যাহত হয়। টেক্সটাইল সুতা, বোতাম, জিপার, সুতার কার্টন, অ্যাম্ব্রয়ডারি, ওয়াশিং, ডায়িংসহ বিভিন্ন খাতে প্রায় ২৮০ কোটি টাকার জোগান বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রতিদিন। গত ৪০ দিনের অবরোধে অর্ডার বাতিল হয়েছে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকার। বায়াররা পণ্যের দাম কমিয়ে দেয়ায় ইতোমধ্যে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে জানান তারা। বিমানভাড়া বাবদ ক্ষতির পরিমাণ ১৪০০ কোটি টাকার মতো। বিলম্বিত জাহাজীকরণ এবং আগুনে ক্ষতি হয়েছে আরো কয়েক হাজার কোটি টাকা।

No comments

Powered by Blogger.