চট্টগ্রাম কারাগারের মালী- মনের বাগানও ভরে যাক ফুলে

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে আট কয়েদির গড়ে তোলা ফুলবাগান নিয়ে শুক্রবারের সমকালে যে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে, তা বহুমাত্রিক ভাবনার খোরাক জোগায় বৈকি। সীমাবদ্ধ ভূমির বন্দিজীবনেও বিভিন্ন অপরাধের কারণে দণ্ডিত তো বটেই, এমনকি খুনের দায়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত একদল মানুষ যেভাবে সুন্দরের সাধনা করে যাচ্ছেন, তা কারাজীবনের গতানুগতিক চিত্রে যেন চিড় ধরায়। আমরা জানি নাজিমুদ্দিন রোডে অবস্থিত কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দিজীবন কাটানোর সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফুলের গাছ লাগিয়েছিলেন। অন্য রাজবন্দিরাও এ ধরনের কাজ করতেন। তারা যথার্থই মনে করতেন_ কেবল সময় কাটানো নয়, সুস্থ-সবলভাবে বেঁচে থাকার প্রেরণাও এতে মেলে। সমকালের প্রতিবেদনসূত্রে জানা যাচ্ছে, ২০১১ সালে এক চিলতে জমিতে জনৈক কারাবন্দি প্রথমে বাগান শুরু করেন। পরে তার সঙ্গে যোগ দেন অন্য সাতজন। সম্প্রসারিত হয়েছে বাগানও। এখন কারাগারের ভেতরেই বিভিন্ন প্লটে আটটি ফুলবাগান গড়ে তুলেছেন তারা। নানা ঋতুতে সেখানে হেসে ওঠে ও সুগন্ধ ছড়ায় অন্তত ৪১ প্রজাতির ফুল। স্বউদ্যোগে কাজটি বেছে নেওয়া এবং কোনো শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ছাড়া এভাবে ফুল ফোটানো তাদের হৃদয়ের সৌন্দর্যই পরিস্ফুট করেছে। কারা কর্তৃপক্ষের সহযোগিতাও স্মরণ করতে হবে বৈকি। তারা যেভাবে জমি দিয়েছেন এবং উৎপাদিত ফুল বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি না করে কারাগারের বিভিন্ন দপ্তর ও স্থাপনার সৌন্দর্য বর্ধনের কাজে ব্যবহার করছেন, তা ব্যতিক্রমী। স্থান ও আগ্রহী বা দক্ষ 'মালী' থাকলে বাণিজ্যিকভাবেও ফুলের উৎপাদন হতে পারে। সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্তদের দিয়ে যদি অন্যান্য উপকরণ তৈরি করা যায়, ফুল চাষ হবে না কেন? বিনাশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদিরাও ইচ্ছা করলে যাতে যুক্ত হতে পারেন, সে সুযোগ রাখা উচিত। বস্তুত ইউরোপে এমন নজির অনেক রয়েছে। বিশেষত প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কয়েদিদের রাখা হতো বিরানভূমিতে তৈরি অস্থায়ী কারাগারে। যেখানে অনেকেই 'শখের' বাগান গড়ে তোলেন। ফুল ছাড়াও শাক-সবজি জন্মানো হতো। কারাগার থেকে মুক্ত হয়েও সেই 'চাষিরা' সমিতি গড়ে তুলে ফুল ও ফল উৎপাদন অব্যাহত রেখেছেন_ এমন উদাহরণ কম নয়। চট্টগ্রাম কারাগারকে কেন্দ্র করেও অনুপ্রেরণাদায়ক সেসব নজিরের পুনরাবৃত্তি হতে পারে। আমরা চাইব, কারাগারে অবস্থানকালেও ফুলের সৌন্দর্যের এই চর্চা 'সংশোধনের' জন্য থাকা কয়েদিদের জীবনে প্রতিফলিত হোক। তাদের হৃদয় ফুলের মতোই পবিত্র হয়ে উঠুক। সেজন্য কারা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব নেহাত কম নয়। ফুল চাষের জন্য যেভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন, সেভাবে কয়েদিদের হৃদয়-বাগান ফুলে ভরিয়ে তোলার জন্যও আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। কারাগারের অমানবিক পরিবেশ অনেক ক্ষেত্রে কয়েদিদের সংশোধনের বদলে আরও অন্ধকারে ঠেলে দেয়। এ ব্যাপারে সতর্কতা ও নজরদারি চাই। চাই পরিবার-পরিজন, বন্ধুহীন মানুষগুলোর প্রতি ভালোবাসা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার 'মনের বাগানবাড়ি' প্রবন্ধে বলেছেন, 'ভালবাসার একটি মহান্ গুণ এই যে, সে প্রত্যেককে নিদেন এক জনের নিকটেও আদর্শ করিয়া তুলে। এইরূপে সংসারে আদর্শ ভাবের চর্চা হইতে থাকে। ভালবাসার খাতিরে লোককে মনের মধ্যে ফুলের গাছ রোপণ করিতে হয়, ইহাতে তাহার নিজের মনের স্বাস্থ্য-সম্পাদন হয়, আর তাহার মনোবিহারী বন্ধুর স্বাস্থ্যের পক্ষেও ইহা অত্যন্ত উপযোগী।' চট্টগ্রাম কারাগারের কিছু কয়েদি ভূমিতে ফুলের বাগান তৈরি করছেন। বিনিময়ে কারা কর্তৃপক্ষ তাদের 'মনের মধ্যে ফুলের গাছ রোপণ' কিন্তু করতেই পারে!

No comments

Powered by Blogger.