সেই ভস্মে ঢাকা পম্পেই by ফারুক মঈনউদ্দীন

রোমের মূল রেল স্টেশনটার নাম কায়দা করে স্থানীয় উচ্চারণে বলতে হয় 'তেরমিনি,' আমাদের সহজ ইংরেজিতে যাকে বলা যায় টার্মিনাস বা টার্মিনাল। ভিয়া পালেস্ত্রো অর্থাৎ পালেস্ত্রো স্ট্রিটের কন্টিনেন্টাল হোটেল থেকে তেরমিনির দূরত্ব হাঁটাপথে পাঁচ মিনিট। হোটেলের নাম শুনে কারও ভাবা উচিত নয় এটি কোনো তারকাখচিত হোটেল। আসলে এই ভিয়া পালেস্ত্রোর প্রাচীন ভবনগুলোর বিশাল দরজার ওপাশে বিভিন্ন তলার প্রায় প্রত্যেকটিতে কয়েকটা করে ব্রেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট হোটেল রয়েছে। আমাদের হোটেলটি যে বিল্ডিংয়ে সেখানেও বিভিন্ন তলায় কমপক্ষে চারটি হোটেল রমরমা ব্যবসা করছে, আরও বেশিও থাকতে পারে। কন্টিনেন্টাল হোটেলে চেক ইন করার সময় কাউন্টারের মেয়েটি পাসপোর্ট রেখে দিয়েছিল ফটোকপি করার জন্য। পরে যখন পাসপোর্ট ফেরত নিতে যাই মেয়েটি বলে, আপনি প্রফেসর ইউনূসকে চেনেন?
আমি একটু চমকে যাই। বলি_ চিনি, তবে তিনি আমাকে চেনেন না। কেন বলো তো?
মেয়েটি বলে, পাসপোর্টে আপনার স্থায়ী ঠিকানা দেখলাম চিতাগং, প্রফেসর ইউনূসও চিতাগংয়ের লোক, তাই না? এবার বিষয়টা খোলাসা হয়। যাক, মেয়েটির কাছে আমাদের দামটা একটু বেড়ে গেল।
আমরা যখন রোম থেকে বারি হয়ে দক্ষিণ ইতালির মাতেরা যাই, পরিকল্পনা করেছিলাম ফেরার পথে পম্পেই ঘুরে আসব। কিন্তু আবার নেপলসে এক রাত থাকতে হবে, এসব সাত-পাঁচ ভেবে আর যাই না। তাই রোম থেকেই পম্পেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। তেরমিনি স্টেশন থেকে নেপোলির (নেপলস) টিকিট কিনতে গিয়ে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে পরীক্ষামূলকভাবে একপাশে সারি সারি বসানো সেলফ সার্ভিস টিকিট মেশিনগুলোর বুথে ঢুকে যখন টিকিট কাটার চেষ্টা করছিলাম, তখন এক তরুণ এসে বলে, কী পারছেন না? আমি হেল্প করছি। ওর নির্দেশ মোতাবেক বিভিন্ন বোতাম টেপাটেপির পর নির্দিষ্ট তারিখের টিকিটগুলো যখন মেশিনের ভেতর থেকে বের হয়ে আসে, তখন বুঝতে পারি ব্যাপারটা কত সোজা। খামোখা লাইনে দাঁড়িয়ে এত সময় নষ্ট হলো। তাই ছেলেটি যখন কিছু বকশিশ দাবি করে, তাকে ৫০ ইউরো দিতে কোনো দ্বিধা হয় না।
আমরা রোমের তেরমিনি থেকে নেপোলির উদ্দেশে যখন রওনা হই, তখন সকাল প্রায় সোয়া সাতটা, প্লাটফর্মে অপেক্ষমাণ ট্রেনের পাশে দাঁড়িয়ে বিশাল ভুঁড়িওয়ালা ট্রেন ড্রাইভাররা হুশ হুশ করে সিগারেট টানছিল। তেরমিনি থেকে নেপোলির দূরত্ব সাধারণ ট্রেনে ঘণ্টা দুয়েকের। তবে দ্রুতযানও আছে, সময় লাগে ৭০ মিনিট। সকাল ৯টার ট্রেন ধরে নেপলস সেন্ট্রাল স্টেশনে পেঁৗছি ঠিক ১০টা ১০ মিনিটে। এখান থেকে ট্রেন বদল করে প্রাইভেট লাইন সারকামভিসুভিয়ানার পম্পেই_সরেন্তোর লোকাল ট্রেন ধরে নামতে হবে পম্পেই স্কাভি স্টেশনে। নেপোলি সেন্ট্রাল স্টেশনের প্লাটফর্ম থেকে একতলা নিচে নামলে লোকাল ট্রেনের প্লাটফর্ম। সেখানে গিজগিজ করছে মানুষ, সবাই যে পম্পেই যাচ্ছে তা নয়। অপেক্ষমাণ সেই সব যাত্রীর ফাঁকফোকর গলে ভিক্ষা করছিল জিন্স প্যান্ট এবং পরিষ্কার শার্ট পরা এক অপরূপ সুন্দরী ইতালীয় তরুণী, তার কোলে বছরখানেকের একটা বাচ্চা, পিঠে ঝোলানো র‌্যাকস্যাক। একটা গ্গ্নাস নিয়ে এর-ওর সামনে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়াচ্ছিল হাত বাড়িয়ে, কিছু না দিলে পরক্ষণেই হাত সরিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছিল আরেকজনের সামনে, আমাদের দেশেরগুলোর মতো ঘ্যানঘেনে নাছোড়বান্দা টাইপ নয়। তাই তেমন কোনো উপার্জন হতে দেখি না মেয়েটির। এমন শরীরে শার্টের ওপরের দুটি বোতাম খোলা অবস্থায়ও সেই সুন্দরী ভিখারিণী কারও মন গলাতে পারে না দেখে মনে মনে ভাবি, ইউরোপীয় মন্দা ইতালিতে সত্যিই জেঁকে বসেছে।
নেপোলি থেকে পম্পেই স্কাভি লোকাল ট্রেনেই আধা ঘণ্টার পথ। ছোট্ট স্টেশনটি থেকে বের হয়ে অল্প কিছুদূর হাঁটলেই মৃত নগরী পম্পেইর গেট। টিকিট কাউন্টারের সামনে দর্শনার্থীর একটা মাঝারি লাইন, তার পেছনে গিয়ে দাঁড়াতেই ওখানকার সুপারভাইজার গোছের একজন এসে বলে, নমস্তে। আমি কিছু বলার আগে মিনা বলে ওঠে, জি-না, আমরা ইন্ডিয়ান নই, উই আর ফ্রম বাংলাদেশ। ওর দেশপ্রেম খুব প্রবল। লোকটি মোটেই বিব্রত হয় না, বলে, ওহ, দ্যাটস ফাইন। অ্যানিওয়ে, ওয়েলকাম টু পম্পেই।
জনপ্রতি ১১ ইউরোর টিকিট কেটে ভেতরে ঢোকার পর প্রথম দর্শনে পম্পেইর মৃত নগরীর যে চেহারা চোখে পড়ে সেটি হচ্ছে ধূসর, আধপোড়া মতো দেখতে এক নগরীর ভগ্নস্তূপ। আসলে আধপোড়া নয়, আগ্নেয় ভস্মের নিচে প্রায় ১৭০০ বছর চাপা পড়ে ছিল বলে অবচেতনে মনে হয় আধপোড়া কালচে ছাই। পম্পেইর ধূসরতা এবং প্রায় বৃক্ষবিবর্জিত রুক্ষ পরিবেশ হাজার বছর ধরে ভস্মস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকা নগরীর ভগ্নস্তূপটিকে দিয়েছে একধরনের কাঠিন্য। পরিকল্পিত ছোট্ট শহরটির পাথর বিছানো পথ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে মনে হয় প্রথম শতাব্দীর সমৃদ্ধ এই নগরী যেন থমকে দাঁড়িয়েছিল ৭৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ আগস্টের সকালে, তারপর থেকে আর সামনে এগোয়নি, কেবল ক্ষয়ে চলেছে নীরবে। অথচ নগরীটি খ্রিস্টপূর্ব সময় থেকেই ছিল সমৃদ্ধ। খ্রিস্টপূর্ব ৮৯ অব্দে এটি রোমান সম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর অবকাঠামোগতভাবে প্রভূত উন্নয়ন লাভ করে, যার বেশিরভাগই ঘটে সম্রাট অগাস্টাসের শাসনামলে। কৃষি জমির উর্বরতার কারণে জনসংখ্যার আপেক্ষিক ঘনত্ব ছিল এখানে বেশি এবং সমৃদ্ধিও আসে তার হাত ধরে। এখানে তৈরি করা হয়েছিল অ্যামফিথিয়েটার, জিমনেশিয়াম, এমনকি ইনডোর সুইমিং পুল। রাস্তার কলগুলোতে জলপ্রবাহ নিশ্চিত করতে তৈরি করা হয়েছিল যথার্থ সরবরাহ লাইন। তৈরি করা হয়েছিল চারটি গণহাম্মাম। ভূতত্ত্ববিদ ফিলিপ জেনির মতে আগ্নেয় পর্বতের বিপদের মধ্যেও একটা বৈপরীত্য রয়েছে, এসব পাহাড়ের মাটি থাকে উর্বর, তাই তার চারপাশে লোকজনের বসতিও বেশি। পম্পেইর বেলায়ও ঠিক তাই ঘটেছিল। বিসুভিয়াসের মাত্র আট কিলোমিটার দূরত্বের প্রাচীন পম্পেই নগরীর উপকণ্ঠে ছিল বহু ধনাঢ্য কৃষিজীবীর বাস। প্রাচীনকাল থেকেই এই শহরের সমৃদ্ধি এবং বহু ধরনের নাগরিক সুবিধা এবং আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য ছিল এই ধনাঢ্য শ্রেণীর লোকজন।
টিকিট কেটে ভেতরে ঢোকার পর নগরীর মূল ফটকটি ধনুকাকৃতি ছাদের নিচে, বেশ খাড়া একটা পাথুরে পথ বেয়ে উঠতে হয়। এই ফটকটির নাম 'পোর্তা মেরিনা' অর্থাৎ 'সাগরমুখী দরজা'। এখান থেকে প্রাচীন নগরীর মূল কেন্দ্র 'ফোরাম'-এ পেঁৗছে যাওয়া যায়। গেটটির ঠিক পাশেই অপেক্ষাকৃত সরু আরেকটি তোরণ, এটিতে পেঁৗছার জন্য ভাঙতে হয় বেশ কিছু সিঁড়ির ধাপ। প্রথম ফটকটি ছিল ঘোড়া এবং যান চলাচলের জন্য, আর দ্বিতীয়টি ব্যবহৃত হতো পথচারীদের জন্য। বলাবাহুল্য পথচারীদের জন্য নির্দিষ্ট ফটকটি খোলা নয়, দর্শনার্থীদের বড় ফটকটিই ব্যবহার করতে হয়। তবে এখান দিয়ে এখন আর গাড়িঘোড়া ঢোকে না। লাভার টালি বিছানো পথ ধরে এগিয়ে গেলে হাতের ডানে পড়বে 'ভেনাস মন্দির', তবে নামেই কেবল মন্দির, এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই, একটা থামের ভগ্নাবশেষ, আর কিছু বড় বড় পাথরের চাঁই ছাড়া একসময় নগরীর রক্ষাকর্ত্রী দেবী ভেনাসের মন্দিরটি এখন একটা খোলা জায়গা ছাড়া আর কিছু নয়। চোর ছ্যাঁচোড়ের হাত থেকে ভগ্নাবশেষগুলো রক্ষা করার জন্যই নাকি গ্রিলের দেয়াল দিয়ে জায়গাটা ঘেরা। ওসবের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেলে পাহাড়ের ধারে দাঁড়িয়ে বহুদূর অবধি নিচের লোকালয় দেখা যায়।
ভেনাস টেম্পল পেরিয়ে গেলে ব্যাসিলিকা। এটি ছিল পম্পেইর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গণস্থাপনা, গির্জা এবং বিচারালয়। ভবনটি পুরোপুরি না হলেও আংশিক অক্ষত আছে ছাদসহ, তবে বেশিরভাগ অংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত, কেবল দাঁড়িয়ে রয়েছে লম্বালম্বি খাঁজকাটা গোল ইটের স্তম্ভগুলো। এটার পাশেই তৃতীয় শতাব্দীতে তৈরি দেবতা অ্যাপোলোর মন্দির, এখন কেবল কিছু ভাঙা থামের সারির মাথায় খিলান আর কিছু সিঁড়ির ধাপের মাঝে ঘাসে ঢাকা খোলা জায়গা ছাড়া আর তেমন কিছু অবশিষ্ট নেই। তবে সামনে কালো গ্রানাইটে দেবতা অ্যাপোলোর মূর্তিটা রয়েছে, দুই হাতের ভঙ্গি দেখে বোঝা যায় তীর-ধনুক বাগিয়ে ধরা ছিল, তবে ধনুকটি এখন আর না থাকায় মূর্তিটির দুই হাতের ভঙ্গিমাকে নাচের মুদ্রা বলে মনে হয়।
৭৯ খ্রিস্টাব্দের যে অগ্ন্যুৎপাতে পম্পেই নগরী ধ্বংস হয়েছিল, তার বেশ কিছু আগে থেকেই সেখানে মাঝে মাঝে মাঝারি মাপের ভূমিকম্প হতো। তবে ৬২ খ্রিস্টাব্দে বেশ বড় একটা ভূমিকম্পে শহরটির যথেষ্ট ক্ষতি সাধিত হয়েছিল। সেদিন ছিল সম্রাট অগাস্টাসের জাতির পিতা উপাধি প্রাপ্তির বার্ষিকী। তবে সেই উদযাপন উৎসব ভূমিকম্প-পরবর্তী বিশৃঙ্খলা, এদিক সেদিক জ্বলন্ত বাতির তেল থেকে সৃষ্ট অগি্নকাণ্ড, বিধ্বস্ত ঘরবাড়িতে চুরি ও লুটপাট এবং বেঁচে থাকা মানুষের অনাহারের ফলে ম্লান হয়ে গিয়েছিল।
পম্পেইর বহু নিদর্শন ভস্মের নিচে ১৭০০ বছর চাপা পড়ে থেকেও অবিকৃত অবস্থায় রয়ে গেছে_ এই বিস্ময়ের জবাব মেলে যখন জানা যায় চাপাপড়া অবস্থায় বাতাসের সংস্পর্শে না আসাই এর মূল কারণ। ফলে খুঁড়ে আবিষ্কার করার পর একদিকে যেমন এসব অবিকৃত নিদর্শন প্রথম শতাব্দীর পম্পেইবাসীর জীবনপ্রণালি সম্পর্কে গবেষণার খোরাক জুগিয়েছে, আবার অন্যদিকে আলো, হাওয়া, জল এবং মানবস্পর্শের কারণে এসবের ক্ষয়প্রাপ্তির সম্ভাবনাও বেড়েছে।
বিসুভিয়াস আগ্নেয় পর্বত যেদিন বিস্টেম্ফারিত হয়, সেদিন নেপলস উপসাগরে অবস্থানরত নৌবাহিনীর জাহাজের অধিনায়ক প্লিনি দ্য এলডার চরম দুঃসাহস দেখিয়ে জাহাজ নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন উদগিরণরত বিসুভিয়াসের দিকে, যাতে আরও কাছ থেকে অগ্ন্যুপাতের দৃশ্য দেখা যায় এবং সেটির কাছাকাছি উপকূল থেকে উদ্ধার করা যায় তাঁর আত্মীয়-স্বজন এবং অন্যান্য উপদ্রুত মানুষজনকে। তবে তাঁর সেই উদ্যোগ সফল হয়নি, অগ্ন্যুৎপাতের ফলে জাহাজেই মারা গিয়েছিলেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.