হুমায়ুন আজাদের পর অভিজিৎ রায়

১১ বছরের ব্যবধানে যেন ভয়ঙ্কর সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বইমেলা থেকে ফেরার পথে প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদের ওপর যেভাবে হামলা হয়, একই কায়দার হামলায় নিহত হয়েছেন মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রগতিশীল লেখক ড. অভিজিৎ রায়। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। তখন ওই এলাকায় ছিল বহু মানুষের উপস্থিতি। তার মধ্যেই দুর্বৃত্তরা অভিজিৎ রায় ও তার স্ত্রী ব্লগার রাফিদা আহমেদ বন্যাকে কুপিয়ে চলে যায়। বন্যাও শঙ্কামুক্ত নন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এ দম্পতি গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দেশে আসেন। বুয়েটের সাবেক শিক্ষক অভিজিৎ পেশায় প্রকৌশলী আর বন্যা চিকিৎসক। তারা আট বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। কারা তাদের ওপর এ হামলা চালিয়েছে তা তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ। তবে ধর্মীয় উগ্রপন্থি গোষ্ঠী এতে জড়িত থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন কেউ কেউ। সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী লেখালেখির জন্য অভিজিৎ রায়কে অনেক দিন ধরেই হুমকি দিয়ে আসছিল প্রতিক্রিয়াশীল একটি চক্র।
পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার আবদুল বাতেন সমকালকে বলেন, 'প্রাথমিকভাবে পাওয়া তথ্যমতে, তিন থেকে চার অস্ত্রধারী দুর্বৃত্ত তাদের ওপর হামলা চালায়। তবে কেন ও কারা এ হামলা চালায়, তা এখনও স্পষ্ট নয়।' তার প্রগতিশীল মতবাদের বিরোধীরা এ হামলা চালায় কি-না জানতে চাইলে পুলিশের এ কর্মকর্তা বলেন, 'সে বিষয়টিসহ তিন-চারটি সম্ভাবনাকে ধরে কাজ শুরু করেছে পুলিশ।'
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাফিদা আহমেদ বন্যা সাংবাদিকদের জানান, বইমেলায় একটি প্রকাশনা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে তারা ফিরছিলেন। পথে টিএসসি মোড়ে রাত সাড়ে ৯টার দিকে তাদের ওপর হামলা চালানো হয়। দুর্বৃত্তরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপালে অভিজিৎ মাথায় গুরুতর জখম হন। আঙুল বিচ্ছিন্ন হয় বন্যার। তারা রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে গেলে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। পরে একটি অনলাইন নিউজপোর্টালের ফটোসাংবাদিক জীবন আহম্মেদসহ আশপাশের লোকজন তাদের উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে যান। চিকিৎসকরা রাত সাড়ে ১০টায় অভিজিৎকে মৃত ঘোষণা করেন।
ঢামেকের চিকিৎসক সোহেল আহমেদ সমকালকে জানান, গুরুতর জখমের কারণে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয় অভিজিতের। চিকিৎসকরা তাকে বাঁচানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করেন; কিন্তু হাসপাতালে যখন আনা হয়, তখনই তার অবস্থা ছিল সংকটাপন্ন।
যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী অভিজিৎ রায়ের নতুন বই 'শূন্য থেকে মহাবিশ্ব : উৎপত্তি ও অস্তিত্বের সাম্প্রতিকতম ধারণা' এবারের একুশের বইমেলায় প্রকাশ করেছে শুদ্ধস্বর। এটির প্রকাশনা উৎসবে যোগ দিতেই তিনি দেশে আসেন। শুদ্ধস্বর-এর স্বত্বাধিকারী আহমেদুর রশীদ সমকালকে জানান, সন্ধ্যা ৭টার দিকে বইমেলায় তাদের স্টলে একটি অনাড়ম্বর প্রকাশনা অনুষ্ঠান হয়। এ সময় শুদ্ধস্বরের অন্যান্য বইয়েরও মোড়ক উন্মোচন করা হয়। অভিজিৎ ও বন্যা ওই অনুষ্ঠানে যোগ দেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে তারা স্টল থেকে বেরিয়ে মেলায় ঘুরে বেড়ান। মেলা শেষ হওয়ার পর তারা বাসায় ফেরার উদ্দেশ্যে টিএসসির দিকে যান। প্রগতিশীল লেখালেখির জন্য অভিজিৎকে অনেকদিন ধরেই হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল একটি চক্র।
অভিজিৎ রায়ের অন্য বইগুলোর মধ্যে রয়েছে_ অবিশ্বাসের দর্শন, ভালোবাসা কারে কয়, আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে, স্বতন্ত্র ভাবনা :মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি, সমকামিতা :বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্তি্বক অনুসন্ধান, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো : এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে, বিশ্বাসের ভাইরাস, বিশ্বাস ও বিজ্ঞান (সম্পাদনা গ্রন্থ) ও স্বতন্ত্র ভাবনা (সম্পাদনা গ্রন্থ)। তার স্ত্রী বন্যা আহমেদের বই 'বিবর্তনের পথ ধরে' প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালে।
অভিজিৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক অজয় রায়ের ছেলে। তিনি রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় থাকেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসে এ বাসাতেই অবস্থান করছিলেন অভিজিৎ ও তার স্ত্রী।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) এক কর্মকর্তা জানান, প্রযুক্তিগত সহায়তা নিয়েও ঘটনার রহস্য অনুসন্ধানের চেষ্টা চলছে। ঘটনার সময় ওই এলাকায় সন্দেহজনক অবস্থান ছিল কাদের, তাদের কথোপকথনে কী ছিল, তা বের করার চেষ্টা চলছে।
শাহবাগ থানার ওসি সিরাজুল ইসলাম সমকালকে বলেন, মতাদর্শিক বা ব্যক্তিগত বিরোধের কোনো কারণে অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হয়েছে কি-না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ঘটনাস্থল থেকে দুটি চাপাতি উদ্ধার করা হয়েছে।
ঢাবির প্রক্টর অধ্যাপক এএম আমজাদ সমকালকে বলেন, অভিজিৎ রায় দেশে আসার আগে একটি প্রতিক্রিয়াশীল মহল তাকে হত্যার হুমকি দেয় বলে শুনেছি। তারা এ ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে। হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার ঘটনার সঙ্গে এই হামলার মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।
২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে বের হওয়ার পথে প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলা চালানো হয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তদন্তে জানা যায়, জঙ্গিরা এই হত্যায় জড়িত ছিল। এ ছাড়া ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে রাজধানীর মিরপুরে তার বাড়ির সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওই হত্যাকা েও জঙ্গিদের সংশ্লিষ্টতার তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা।

No comments

Powered by Blogger.