তিস্তা আর নেই তিস্তায় by শেখ রোকন

তিস্তা নদীর বুকে এখন আর পানি নেই। এর বুকে জেগে উঠেছে বিশাল চর
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিন দিনের 'বহুল প্রত্যাশিত' ঢাকা সফর শেষ হয়েছে। বহুল প্রত্যাশিত কেন? ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিভক্ত বাংলার দুই অংশের নেতৃত্ব একত্রে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করবেন বলে? ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসের আয়োজনে 'বৈঠকি বাংলা' অনুষ্ঠানে দুই বাংলার রাজনীতিক ও সুধী সমাজ আনন্দঘন মুহূর্ত কাটাবেন বলে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সফরসঙ্গী সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে বাংলাদেশের পেশাগত বন্ধুদের ভাব বিনিময় হবে বলে? রফতানি বন্ধ থাকা ইলিশ আবার ওপার বাংলার বাঙালিদের রসনা তৃপ্ত করবে বলে? এপাশের আগ্রহ ও আন্তরিকতার কেন্দ্রে ছিল তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যু। বস্তুত সীমান্তের এপাশ এর জন্য অপেক্ষায় ছিল অন্তত ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশ সংলগ্ন রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে তখন রাষ্ট্রীয় সফরে এসেছিলেন। কথা ছিল মমতাও আসবেন এবং দুই দেশের মধ্যে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিনি সফরটি বাতিল করেছিলেন। ফলে চূড়ান্ত খসড়া পর্যায়ে থাকা চুক্তিটি আর স্বাক্ষরিত হয়নি।
তিস্তা ইস্যুটি যারা মনোযোগের সঙ্গে অনুসরণ করেন, তাদের নিশ্চয়ই মনে আছে_ প্রায় ছয় দশকের দরকষাকষির পর ২০১১ সালে প্রথমবারের মতো ১৫ বছরের অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তিতে উপনীত হওয়ার কাছাকাছি পেঁৗছেছিল দুই প্রতিবেশী। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছিল, মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের আগে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননের ঝটিকা সফরের সময়ই তিস্তার পানি বণ্টনের হার চূড়ান্ত হয়েছিল। তৎকালীন পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশচন্দ্র সেন ও সচিব শেখ ওয়াহিদুজ্জামানও তখন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, বাংলাদেশ প্রত্যাশামতো ৫০ শতাংশ পানিই পাচ্ছে। তবে সেটা ভারতীয় অংশের গজলডোবা ব্যারাজ থেকে কি-না, তা কোনো পক্ষ নিশ্চিত করেনি। ওই বছর জুন মাসে নয়াদিলি্লতে খসড়া চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন দুই দেশের পানিসম্পদ সচিব। খসড়া চুক্তিতে বলা হয়েছিল, নদীর নাব্যতার জন্য ৪৬০ কিউসেক রেখে বাকি পানি ভারত ৫২ শতাংশ ও বাংলাদেশ ৪৮ শতাংশ পাবে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাপেই শেষ পর্যন্ত পিছু হটে মনমোহন সরকার।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের তরফে অভিযোগ ছিল, শিবশঙ্কর মেনন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, চুক্তির চূড়ান্ত খসড়ায় তা মানা হয়নি। সফর শুরুর একদিন আগে ঢাকায় না যাওয়ার ঘোষণা দিলে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং বাংলাদেশের পক্ষে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানানো হলে মমতা বলেছিলেন, তিনিও বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক চান; কিন্তু রাজ্যের স্বার্থ তার অগ্রাধিকার। ঢাকা ছাড়ার আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী কথা দিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সম্মতি সহযোগে অচিরেই চুক্তিটি হবে।
সেই অচিরে আর চিড় ধরেনি। পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকার জানিয়েছিল, তারা তিস্তার পানি প্রবাহ নিয়ে স্বতন্ত্র সমীক্ষা করবে। তার পর চুক্তির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত। এ জন্য সেখানকার শীর্ষস্থানীয় নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রকে প্রধান করে একটি কমিটিও করা হয়। ওই বছরই নভেম্বরের মধ্যে সেই কমিটির কাজ সম্পন্ন করার কথা ছিল। পরে আরও কয়েক দফা সময় বাড়ানো হয়। শেষ পর্যন্ত, শোনা কথা, এ বছর কল্যাণ রুদ্র তার সমীক্ষা প্রতিবেদন দিয়েছেন। কিন্তু সমীক্ষাটি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ডিপ ফ্রিজে সুরক্ষিত। পরে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দফায় দফায় বরফ গলানোর চেষ্টা চলেছে। বলা বাহুল্য, কাজ হয়নি।
পরের ইতিহাস সবার জানা। তিস্তা দিয়ে কেবল অনেক পানি অথবা পানিশূন্যতা প্রবাহিত হয়নি; দিলি্লতে কংগ্রেস জমানা শেষ হয়ে বিজেপি যুগ শুরু হয়েছে; ঢাকাতেও আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করেছে। সীমান্তের এপাশ এবং ওপাশে পানিসম্পদ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও এসেছে পরিবর্তন। কেবল পরিবর্তন ছিল না তিস্তাচিত্রে। যখনই সুযোগ মিলেছে বাংলাদেশের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পানিসম্পদমন্ত্রী ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পানিসম্পদমন্ত্রীর কাছে আগের মতোই তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যু 'দ্রুত নিষ্পত্তি' করার আবেদন জানিয়ে এসেছেন। তারাও আগের সরকারের মতোই আশ্বাস দিয়ে গেছেন। সর্বশেষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ঢাকার 'বহুল প্রত্যাশিত' ঢাকা সফর করলেন বটে; একুনে আশ্বাস ছাড়া কিছুই মিলল না।
সফরের শুরুতে ২০ ফেব্রুয়ারি 'বৈঠকি বাংলা'য় সুধীজনদের উদ্দেশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, 'ল্যান্ড বাউন্ডারি প্রবলেম যেমন সল্ভ করে দিয়েছি, তিস্তা নিয়েও কোনো সমস্যা হবে না_ আমার ওপর আস্থা রাখুন। আগামীকাল (শনিবার) হাসিনাদির (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হবে। আমাদের ওপরই ছেড়ে দিন। তিস্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না।' ( সমকাল ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫)।
প্রশ্ন হচ্ছে, কয়েক মাস আগ পর্যন্ত তিস্তার পানি বণ্টন প্রশ্নে বিরূপ মমতা হঠাৎ এমন নরম হলেন কেন? তিস্তার পানি নিয়ে এই আশ্বাস আসলে কতটা বাস্তব? বিষয়টি বোঝা যায় কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় বুধবার প্রকাশিত সম্পাদকীয় পড়লে_ 'দুর্জনে বলিতে পারে, মুখ্যমন্ত্রীর বাংলাদেশ যাত্রার প্রকৃত উদ্দেশ্যটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং গূঢ় :তিনি সে দেশের সরকারকে জামায়াত-আদি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে তৎপরতার মাত্রা কমাইবার অনুরোধ জানাইতে গিয়াছিলেন, কারণ সেই তৎপরতার ফলে সীমান্তের এ পারে তাঁহার দলের অসুবিধা হইতেছে। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন যে কোনও নাগরিক আশা করিবেন, ইহা দুর্জনের অপপ্রচারমাত্র, এমন কোনও দুষ্টচিন্তা মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁহার সহকর্মী তথা সফরসঙ্গীদের অন্তরের ত্রিসীমানাতেও স্থান পায় নাই। কিন্তু সেই কারণেই আরও বেশি করিয়া প্রশ্ন উঠিবে :এই সফর শেষে তাঁহার হাতে কী রহিল? তিস্তা লইয়া তিনি 'ভাবিয়া দেখিবেন', এই পরম দৈববাণীটুকু বাদ দিলে নূতন কথা শূন্য। তিস্তার জল-ভাগ লইয়া তাঁহার ধনুর্ভঙ্গ পণ ছাড়িয়া মুখ্যমন্ত্রী ভাবিয়া দেখিতে প্রস্তুত, এই সংবাদ বাংলাদেশের পক্ষে আশাব্যঞ্জক হইতে পারে, কিন্তু সত্য ইহাই যে, নদীর জলের মোট পরিমাণ বাড়াইবার উপায় নাই, সুতরাং বাংলাদেশের ভাগ বাড়িলে পশ্চিমবঙ্গের কমিবে।'
তার মানে, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের এই অবস্থান পরিবর্তনের কারণ নিছক রাজনৈতিক। বিধানসভা নির্বাচনে যাতে তার মুসলিম ভোটব্যাংক বিব্রত না হয়, যাতে বাংলাদেশের প্রতি নস্টালজিক হিন্দু ভোট ঠিক থাকে, যাতে সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার তাকে আরও বেকায়দায় না ফেলে। আগে কেন তিস্তা নিয়ে কড়া কড়া কথা বলেছিলেন? সাড়ে তিন দশকের বাম শাসন হটিয়ে ক্ষমতায় আসা মমতাকে মসনদ পোক্ত করতে হলে সাধারণ ভোটারের সামনে 'রাজ্যের স্বার্থ রক্ষায়' অনড় ভাবমূর্তি অটুট রাখা জরুরি ছিল। সেদিক থেকে তিস্তা আকর্ষণীয় ইস্যু, সন্দেহ নেই। বিজেপিও এখন তিস্তার ব্যাপারে নরম। ক্ষমতায় আসার আগে কেন বিরোধিতা করেছিল? সেখানেও রাজনীতি। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার যাতে কূটনৈতিক সাফল্য ভোটের বাজারে ভাঙাতে না পারে, তা নিশ্চিত করা।
তিস্তা যদিও সীমান্তের এপাশের জন্য কৃষি, পরিবেশ, প্রতিবেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ; এখানেও রাজনীতি কম ছিল না। তিস্তা চুক্তি সম্পাদন করতে পারলে নিঃসন্দেহে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেটা আওয়ামী লীগের জন্য 'সাফল্যগাথা' হতে পারত। বিএনপি নির্বাচনে এলে 'তিস্তা ব্যর্থতা' একটি বড় নির্বাচনী ইস্যু হতো, সন্দেহ নেই। গত বছর এপ্রিলে বিএনপি যখন তিস্তা অভিমুখে লংমার্চ করেছিল, তখন হঠাৎ নদীটিতে পানি বেড়ে গিয়েছিল। দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব দাবি করেছিলেন, এ তাদের লংমার্চের 'সুফল'!
তার মানে, তিস্তা ইস্যু আর নিছক তিস্তা নদীতে নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুই দেশের বহুমাত্রিক রাজনীতি। জটিলতা আরও আছে। রাজনীতির বাইরে খোদ তিস্তার প্রাকৃতিক পরিস্থিতি ভালো নয়। কয়েক বছর আগে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক বিশ্বের বিপন্ন আটটি নদী নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। অতি ব্যবহারের কারণে পানিশূন্য হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে থাকা ওই নদীগুলোর মধ্যে আমাদের তিস্তাও রয়েছে। জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, 'উন্নয়ন' প্রকল্প প্রভৃতি কারণে তিস্তার উজান অংশ সিকিমে যে দক্ষযজ্ঞ চলছে, তার নেতিবাচক প্রভাবও পড়ছে তিস্তায়। পানির প্রাকৃতিক জোগান কমে যাচ্ছে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। হিমবাহ চক্রে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে। তাহলে তিস্তার মতো নদীর ভবিষ্যৎ অন্ধকার। রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক জটিলতার বাইরে সীমান্তের দুই পাশে ২৫ হাজার কিউসেক সামর্থ্যের দুটি সেচ প্রকল্প থাকায় পাহাড়ি নদীটির পানি বণ্টন সংক্রান্ত জটিলতা অবধারিত। পাহাড়ি নদীর প্রবাহে নাটকীয়তার অন্ত থাকে না। ওই অঞ্চলে কিংবা উজানে বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভর করে এর প্রবাহ। সব মিলিয়ে পানিই যদি না থাকে_ রাজনীতি, কূটনীতি, জাতীয়তা, প্রাদেশিকতা, নির্বাচন পেরিয়ে চুক্তি হলেই কী বা না হলেই কী?
সাংবাদিক ও গবেষক
skrokon@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.