সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য -১৫৩ by ড. একেএম শাহনাওয়াজ

রাজা রামমোহন রায়
রামমোহন রায় আরবি ও ফারসি ভাষায় কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার প্রথম পাণ্ডুলিপির নাম ‘মনযারাতুল আধিয়ান’। এতে তিনি বিভিন্ন ধর্ম বিষয়ে আলোচনা করেন। এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। মুর্শিদাবাদে থাকাকালীন ছোট কলেবরে তার লেখা একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটির নাম ‘তুহফাত উল মুওয়াহিদ্দীন’। গ্রন্থটি ফারসি ভাষায় লেখা হলেও এর শিরোনাম ও মুখবন্ধ ছিল আরবিতে।
রামমোহন রায় লক্ষ্য করেন আধুনিক বিশেষত ইংরেজি শিক্ষার প্রতি বাংলার হিন্দুদের অনীহা। গোঁড়া হিন্দুরা মনে করে, ইংরেজদের সংস্পর্শে এলে এবং ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করলে ধর্মহানি ঘটবে। এই বাস্তবতাটি রামমোহন রায়কে ব্যথিত করে। তিনি মনে করেন, বহু দেবতাবাদ ও মূর্তিপূজায় আচ্ছন্ন থাকায় হিন্দু সমাজের মানুষ মুক্তচিন্তা নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারছে না। এসব কারণে তিনি মূর্তিপূজাবিরোধী তার মনোভাব প্রকাশ করতে থাকেন।
রামমোহন রায় ১৮১৫ সালে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে কলকাতায় আসেন। এ সময় থেকে তিনি সমাজ সংস্কারে নিবেদিত হন। সেখানে তিনি সমমনা বন্ধুদের একত্রিত করে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এর নাম হয় ‘আত্মীয়সভা’। ধর্মীয় ও সামাজিক নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হতো সেখানে। এই সভায় দ্বারকানাথ ঠাকুর ও প্রসন্নকুমার ঠাকুরের মতো বরেণ্য ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকতেন।
সাধারণ হিন্দুদের ভেতর মুক্তচিন্তা ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে রামমোহন রায় সংবাদপত্র প্রকাশের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এ লক্ষ্যে ১৮২১ সালে প্রকাশ করেন ‘সংবাদ কৌমুদী’ নামে একটি বাংলা সংবাদপত্র। পরের বছর ফারসি ভাষায় আরেকটি সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। এর নাম ছিল ‘মিরাত উল আখবার’।
উপনিষদে বহু দেবদেবির পরিবর্তে নিরাকার ব্রহ্মার উপাসনার কথা রয়েছে। এ সূত্রেই রামমোহন রায় ১৮২৮ সালে ‘ব্রাহ্মসভা’ নামে একটি সংগঠনের জন্ম দেন। এখানে নিরাকার ব্রহ্মার স্মরণে ধর্মসঙ্গীত গেয়ে দিনের কর্মসূচি শুরু করা হয়। পরবর্তী সময়ে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেলে ব্রাহ্মসভা ‘ব্রাহ্মসমাজ’ নামে আত্মপ্রকাশ করে।
বহুকাল আগে থেকেই হিন্দু সমাজে অনেক কুপ্রথা প্রচলিত ছিল। এর অন্যতম সতীদাহ প্রথা। এ প্রথা অনুসারে স্বামী মারা গেলে স্ত্রীকে স্বামীর চিতায় জীবন্ত পেড়ানো হতো। গোঁড়া হিন্দুদের প্রবল প্রতিরোধের মধ্যেও রামমোহন রায় সতীদাহের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে থাকেন। তিনি প্রভাবিত করতে থাকেন কোম্পানির শাসকদের। এই সূত্রে ১৮২৯ সালে গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিংয়ের অনুমোদনে সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত ঘোষণা করে আইন পাস হয়।
রামমোহন রায় ও তার সমমনা বন্ধুরা ইংরেজ শাসকদের সহযোগিতা প্রদানে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, এই সম্পর্কের মধ্য দিয়ে ভারতবাসী ইংরেজ শাসকদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক সুবিধা লাভ করতে পারবে। পাশাপাশি তিনি ভারতীয়দের প্রতি সরকারের কোনো কোনো বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেন।
১৮২৩ সালে গভর্নর জেনারেল জন এডাম ভারতীয় সংবাদপত্রের ওপর কয়েকটি বিধিনিষেধ আরোপ করেন। রামমোহন রায় ও সমমনা বন্ধুরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে লন্ডনে প্রিভি কাউন্সিলে স্মারকলিপি প্রদান করেন। ভারতে তখন রাজনৈতিক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা না থাকায় এ স্মারকলিপি গৃহীত হয়নি। পরবর্তী সময়ে রামমোহন রায় ও তার বন্ধু দ্বারকানাথ ঠাকুর ‘ইন্ডিয়ান জুরি অ্যাক্ট ১৮২৬’-এর ভেতরকার কয়েকটি বৈষম্যমূলক ধারা বাতিলের দাবিতে প্রতিবাদলিপি পেশ করেন। এই পত্রে কলকাতার হিন্দু-মুসলমান নাগরিকদের স্বাক্ষর গ্রহণ করা হয়েছিল।
রামমোহন রায় ও তার বন্ধুরা বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার জমিদারদের পক্ষ থেকে ১৮২৯ সালে আরেকটি আবেদনপত্র জমা দেন গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংয়ের কাছে। এতে জমিদারদের জন্য ক্ষতিকর সরকারের রাজস্ব নীতি পরিবর্তনের দাবি জানানো হয়।

No comments

Powered by Blogger.