পাঠকের মনে প্রভাব ফেলবে

মাহবুব কামালের দুটি সত্তা- একটি রাজনৈতিক, অন্যটি সৃজনশীল। প্রথমটি তিনি আড়াল করেছেন, পরেরটি করেননি। কারণ লেখকসত্তাকে তিনি লালন করছেন। তিনি বুঝেছেন লেখকসত্তাকে বাদ দিয়ে তিনি আর মাহবুব কামাল থাকবেন না, হয়ে যাবেন অন্য মানুষ। লেখক পরিচয়টা তার বেঁচে থাকার জন্য মুখ্য ও জরুরি, অন্য সব গৌণ; এ কারণেই তিনি এই পরিচয়কেই তুলে ধরতে চান পাঠকের সামনে। এতেই তার আনন্দ। সাংবাদিকতা তার পেশা। রাজনীতির কলামিস্ট হিসেবে তার পরিচয় তিনি স্পষ্ট করেছেন। লিখছেন প্রতিনিয়ত। পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করছেন তার ভাবনা, পর্যবেক্ষণ। এবারের একুশে বইমেলায় তার একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সাতাশটি কলাম সংবলিত এ গ্রন্থের নাম ‘জাত নিমের পাতা’। যুগান্তরে তার নিয়মিত প্রকাশিত কলামের নামানুসারেই এ গ্রন্থের নামকরণ। তার পাঠকমাত্রই এ কথা জেনে থাকবেন। মাহবুব কামালের গ্রন্থভুক্ত কলামগুলো সাম্প্রতিক সময়কে ঘিরেই রচিত হয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশের পর এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে সঙ্গত কারণেই। কারণ আগেই বলেছি তার কলাম বিশ্লেষণমূলক। তার কলামের নাম ‘জাত নিমের পাতা’, বোঝাই যায়, তিনি ঝাঁক পালানো পাখি। সংবাদপত্রে অনেকেই লিখছেন; কিন্তু নাড়া দিতে পারছেন কই? যারা পারছেন তাদের মধ্যে মাহবুব কামাল অন্যতম। কারণ বিষয়, ভাবনা এবং ভাষা যদি আকর্ষণীয় হয়, তাহলে তা পাঠককে টানবেই। বলতে দ্বিধা নেই, মাহবুব কামাল পূর্ণমাত্রায় তা পেরেছেন। বুদ্ধিমান পাঠকমাত্রই ভালো লেখা বেছে নিতে ভুল করেন না। ‘জাত নিমের পাতা’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত কলামগুলো বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। আবার লেখক সচেতনভাবে তার লেখার বিষয় নির্ধারণ করেছেন। তিনি শুধু রাজনীতির সে াতে গা ভাসাতে চাননি, এর বাইরেও যে লেখার অনেক ক্যানভাস আছে, সে ভাবনাও তাকে তাড়িত করেছে। আলোচ্য গ্রন্থের একটি কলামের শিরোনাম- ‘ওই বৃদ্ধা জাতিসংঘ জরিপের স্যাম্পল, কম কথা নয়।’ এ কলামে তিনি যেভাবে চামটা নামের এক অজ পাড়াগাঁয়ের দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তিহীন অশীতিপর বৃদ্ধার বেঁচে থাকার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন তা আমাদের ভাবিয়ে তোলে। এ কারণে যে, এর মধ্যে কিছু মৌলিক চিন্তার উপাদান আছে। বৃদ্ধার বেঁচে থাকার মানে কী? বোঝাতে লিখেছেন- ‘ভ্যান চালনা শেষ করে রাতে ফিরে ছেলে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দেন তার শরীরে, নাতি-নাতনি তাকে জড়িয়ে ধরে ডাকে- দাদী! জীবনের এ কি কম বড় তাৎপর্য?’ সত্যিই তো, এ এক নিবিড় বন্ধন, সম্পর্কের এ মূল্য অসীম। একই লেখায় তিনি প্রশ্ন করেছেন- এই গ্রাম, এই নিস্তব্ধ-নিঝুম সন্ধ্যা, বৃক্ষশোভিত মনোরম পরিবেশ, এর আয়ু আর কত দিন? উত্তর সাজিয়েছেন নিজের মতো করেই। নগরায়নের কল্পিত রূপের কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হতে হয় বৈকি!
‘ক্লে-শচীন-বুবকা ও তিন চান্সেও ছিপি খুলতে না পারার ব্যর্থতা’ কলামে তিনি আইনস্টাইনের উদাহরণ দিয়ে শুরু করে শেষও করেছেন তাকে নিয়ে একটি জোকস্ দিয়ে। কিন্তু মাঝখানে কখন কীভাবে থামতে হয়, সরে যেতে হয় নেতৃত্ব-অবস্থান থেকে, তা বোঝাতে গিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি কিছু উপায় নির্দেশ করেছেন। পারফরমেন্স উন্নত করতে বা ধরে রাখতে না পারলে কারোরই যে স্বীয় অবস্থান বা পদ আঁকড়ে থাকা বাঞ্ছনীয় নয়, এটাই তিনি তার লেখায় বোঝাতে চেয়েছেন।
জাসদ নিয়ে তার যে মূল্যায়ন ও পর্যবেক্ষণ তা তিনি তুলে ধরেছেন এ গ্রন্থের তিনটি কলামে- ‘অনাবশ্যক সৃষ্টির অনিবার্য বিলুপ্তি’, ‘কথাগুলো সত্য হয়ে থাকলে তা মুহূর্তের অনুপ্রেরণা’, ‘ওইসব হঠকারিতা না করলে শেয়ারের রিকশায় চাপাচাপি করে বসতে হতো না।’ শিরোনামই বলে দেয় তিনি কী বলতে ও বোঝাতে চেয়েছেন। ছাপা হওয়ার পরে অনেকে এ লেখা পড়ে রুষ্ট হয়েছেন, অনেকে প্রশংসা করেছেন। কিন্তু তিনি যে সাহস করে নির্মোহভাবে সময়ের বাস্তবতা বোঝাতে চেয়েছেন এখানেই তার সার্থকতা। নিজে জাসদ-রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন, তবুও বলতে দ্বিধা করেননি- এক সময় জাসদ-রাজনীতি করেছি বটে, তবে অতীত নিয়ে আমার কোনো গ্লানি নেই..... নিজেকে শোধরাতে পেরেছি কিনা সেটাই বড় কথা। এই যে তার আত্মোপলব্ধি, ভুল-ত্র“টি শোধরানোর মানসিকতা তা বুঝতে পারি লেখা পাঠের মধ্য দিয়েই। মাহবুব কামাল কোনো বদ্ধ ধারণার ভেতর থাকেন না। তিনি উচিত-অনুচিত, ঠিক-বেঠিকের হিসাবটা খুব ভালোভাবেই নিরূপণ করতে সক্ষম। তার মধ্যে গোঁড়ামি নেই। নিজেকে নিরন্তর, নির্মাণ-পুনঃনির্মাণের মধ্য দিয়ে সামনে এগিয়ে নেন। অর্থাৎ তার ভেতরে আত্মশোধনের প্রয়াস লক্ষণীয়, আছে সত্যানুসন্ধানের তাড়নাও।
এ গ্রন্থে মাহবুব কামালের লেখার বিশেষত্ব হচ্ছে তার চমৎকার হিউমার। ‘ময়লা’ কলামে তার এই হিউমারের যথার্থ পরিচয় মেলে। চিন্তার ময়লা, রাজনীতির ময়লা কিভাবে আমাদের শিক্ষা, রুচি, ব্যক্তিত্ব ও ভবিষ্যতকে নষ্ট করছে, কিভাবে ডুবিয়ে দিচ্ছে এই ‘ময়লা’ অতল অন্ধকারে, তা খুব নিপুণভাবে তিনি তুলে ধরেছেন যা আমাদের ভাবনা আর উপলব্ধির দৈন্যকে স্পষ্ট করে। জোনাকী প্রকাশনী থেকে গ্রন্থটি প্রকাশ হয়েছে। মূল্য ধরা হয়েছে তিনশত টাকা। বইটি সংগ্রহে থাকলে পাঠকমাত্রই যে উপকৃত হবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ঠিকঠাক মতো খবর পৌঁছালে বইটি দ্রুতই নিকেশ হয়ে যাওয়ার কথা। দিদার হাসান

No comments

Powered by Blogger.