বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পর্যটন জাহাজ চালাতে চায় ভারত by জাহাঙ্গীর শাহ

নৌ-প্রটোকলের আওতায় বাংলাদেশের নদীপথ ব্যবহার করে পর্যটন জাহাজ চালাতে চায় ভারত। কয়েক মাস আগে এ প্রস্তাব দিয়েছে প্রতিবেশী দেশটি। প্রস্তাব অনুযায়ী, এমভি সুকাপা নামে একটি পর্যটন জাহাজ কলকাতা থেকে বাংলাদেশের নদীপথ ব্যবহার করে আসামের গুয়াহাটিতে যাবে। তাতে যাত্রী পরিবহন করা হবে। কিন্তু নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এ প্রস্তাবে এখনো সাড়া দেয়নি।
তবে ৯ ও ১০ ফেব্রুয়ারি ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত প্রটোকল-সংক্রান্ত যৌথ স্ট্যান্ডিং কমিটির সভায় পর্যটন জাহাজ নেওয়ার দাবিটি জোরেশোরে তোলা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের আপত্তিতে শেষ পর্যন্ত তা ভেস্তে যায়। যদিও বিষয়টি বিবেচনা করার আশ্বাস দিয়েছে বাংলাদেশ।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত জুন মাসে এমভি সুকাপা নামের পর্যটন জাহাজটি চলাচলের অনুমতি পেতে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিও) কাছে আবেদন করা হয়। জাহাজটি আসাম বেঙ্গল নেভিগেশন ও বাংলাদেশের জার্নি প্লাস নামের একটি টুর অপারেটর প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে পরিচালনা করছে। জার্নি প্লাস বিআইডব্লিউটিএতে এ আবেদনটি করেছে।
প্রাথমিক প্রস্তাব অনুযায়ী, কলকাতা থেকে ঢাকা পর্যন্ত এক দফা যাত্রী আনা হবে। ঢাকায় যাত্রী নেমে গেলে আবার যাত্রী নিয়ে আসামে যাবে জাহাজটি। পরীক্ষামূলকভাবে এ নৌপথে একবার চলার অনুমতি চাওয়া হয়েছে। এর অভিজ্ঞতা থেকে পরে নিয়মিত চলাচলের অনুমোদন চেয়ে আবেদন করা হবে এমন পরিকল্পনা রয়েছে।
এ প্রস্তাব পাওয়ার পরপরই স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মত চায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। কিন্তু ইমিগ্রেশনসহ অন্যান্য জটিলতার কারণে আপত্তি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। উদ্যোগটি সেখানেই থেমে আছে।
জার্নি প্লাসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তৌফিক রহমান প্রথম আলোকে জানান, এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার জন্য নৌ-ভ্রমণের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ ছাড়া সড়ক ও রেলপথে বাংলাদেশের মধ্যে যোগাযোগের সুযোগ থাকলে নৌপথেও যাত্রী পরিবহন থাকা উচিত। এ যুগে সব পথই খুলে দেওয়া উচিত।
বাংলাদেশে জার্নি প্লাসের এ আবেদনের পাশাপাশি দিল্লিতে অনুষ্ঠিত স্ট্যান্ডিং কমিটির সভায় নৌ-প্রটোকলের আওতায় পর্যটন জাহাজ পরিচালনার প্রস্তাবও করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আপত্তি করে বলা হয়, প্রটোকলের ১(৩) ধারা অনুযায়ী, এর আওতায় শুধু পণ্য পরিবহন করা যাবে। যাত্রী পরিবহন করার বিধান নেই। তবে ইতিবাচকভাবে বিষয়টি বিবেচনা করার আশ্বাস দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রফিকুল ইসলাম। আর ভারতের পক্ষে নেতৃত্ব দেন সে দেশের নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় উপদেষ্টা সি ভি সিং।
রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পর্যটন জাহাজ আসতে দেওয়া না-দেওয়ার সিদ্ধান্ত সরকারের ওপর নির্ভর করে। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার স্ট্যান্ডিং কমিটির নেই। আমরা শুধু বিদ্যমান আইনটির মধ্যে যেসব বিষয় আছে তা মূল্যায়ন করে থাকি।’
অন্য দাবি: স্ট্যান্ডিং কমিটির সভায় প্রটোকলের আওতায় আশুগঞ্জ পর্যন্ত নৌপথে, আর বাকিটা সড়কপথে আখাউড়া হয়ে আগরতলা পর্যন্ত পথটি নিয়মিত করার দাবি করেছে ভারত। ভারতের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ২০১১ সালে এ পথে পরীক্ষামূলক লোহাজাতীয় পণ্যের চালানটি সফলভাবে আগরতলায় গেছে।
কিন্তু আশুগঞ্জ নৌবন্দরে পর্যাপ্ত অবকাঠামো না থাকায় বাংলাদেশ তাতে রাজি হয়নি। বাংলাদেশ বলেছে, পৃথক বিবেচনায় এক-দুটি করে পণ্যের গুরুত্ব বুঝে অনুমতি দেওয়া যেতে পারে।
উল্লেখ্য, এ পথে ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভারী যন্ত্রপাতি নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া মানবিক কারণে ত্রিপুরায় এ পর্যন্ত ৩৫ হাজার টন চাল নেওয়ার অনুমতিও দেওয়া হয়েছে ভারতকে।
এদিকে ভারতের পক্ষ থেকে প্রটোকলের নবায়ন মেয়াদকাল তিন বছরের পরিবর্তে পাঁচ বছর করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু এ প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে বাংলাদেশ বলেছে, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যচুক্তির আওতায় এ প্রটোকল পরিচালিত হচ্ছে। নবায়নযোগ্য বাণিজ্যচুক্তির মেয়াদ তিন বছর হওয়ায় প্রটোকলের মেয়াদ পাঁচ বছর করা সম্ভব নয়। উল্লেখ্য, আগামী ৩১ মার্চ প্রটোকল নবায়নের মেয়াদ শেষ হচ্ছে।
১৯৭২ সালে দুই দেশের মধ্যে নৌ-প্রটোকলটি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু ১৯৮০ সালের ৪ অক্টোবর দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যচুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। এর পর থেকে এ প্রটোকলটি বাণিজ্যচুক্তির অংশ হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে।
ব্রিটিশ আমল থেকেই কলকাতার সঙ্গে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের নৌপথে বাণিজ্য হতো। কিন্তু পাকিস্তান আমলে দুই দেশের বৈরী সম্পর্কের কারণে এ নৌপথটি বন্ধ ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবারও প্রটোকল করে এ বাণিজ্যপথটি খোলা হয়। মোট আটটি পথে (আসা-যাওয়াসহ) এ প্রটোকলটি পরিচালিত হচ্ছে। এ প্রটোকলের আওতায় নৌপথে দুই দেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানির পাশাপাশি বাংলাদেশের নৌপথ ব্যবহার করে পশ্চিমবঙ্গ থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য নেওয়া যায়। তবে কলকাতা থেকে ফ্লাই অ্যাশ আমদানি করতেই প্রটোকলের নৌপথ ব্যবহার করে বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশ থেকে ভারতে পণ্য খুব একটা যায় না। পশ্চিমবঙ্গ থেকে এখন উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম ও ত্রিপুরায় পণ্য পাঠাতে ট্রানজিট হিসেবে নৌপথ ব্যবহারে বেশি আগ্রহী ভারত।

No comments

Powered by Blogger.