গরিবের চুড়ি চুরমার করে ‘এলাকা পরিষ্কার’ করল পুলিশ

চোখের সামনে পুঁজিপাট্টা শেষ হতে দেখে কান্না থামাতে
পারেননি এই নারী ব্যবসায়ী। ছবি: মানসুরা হোসাইন
অভিযানের পর লন্ডভন্ড চুড়ি গুছিয়ে নিচ্ছেন
এই নারী। ছবি: মানসুরা হোসাইন
চারুকলার সামনে উচ্ছেদ অভিযানে চুরমার চুড়ির ঝাঁকা। আজ
শনিবার বিকেলে তোলা। ছবি: মানসুরা হোসাইন
‘গরিবের লাইগ্যা কিছু নাই। দোকান বসতে দিব না, ভালো কথা। কিন্তু দোকান ভাঙল ক্যান? এখন হাতে একটা টাকাও নাই।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন প্রান্তিক পর্যায়ের চুড়ি ব্যবসায়ী সূর্যবান।
আজ শনিবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে তিনি রাজধানীর শাহবাগে চারুকলা ইনস্টিটিউটের বিপরীত পাশের ফুটপাতে তাঁর ভাঙা চুড়ির ঝাঁকার সামনে বসে কথাগুলো বলছিলেন।
কিছুক্ষণ আগেই শাহবাগ থানার পুলিশ ফুটপাত থেকে অবৈধ ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদের অংশ হিসেবে সূর্যবানসহ বেশ কয়েকজনের চুড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়।
সেখানে গিয়ে দেখা গেছে রেশমি চুড়ি, কাটিং, মান্তি, পুটিচুড়ি, খায়রুন, লারেলাপ্পা, সুতা চুড়িসহ হরেক রকমের চুড়ি ফুটপাতে গড়াচ্ছে। চুড়ি ব্যবসায়ী, তাঁদের ছেলেমেয়ে সবাই মিলে সেখান থেকে যেগুলো ভালো আছে তা বের করার চেষ্টা করছিল। তবে বেশির ভাগ চুড়ি কাচের হওয়ায় প্রায় সব চুড়িই ফেটে গেছে। এসব চুড়ি আর বিক্রি করা যাবে না।
আজ ছিল বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। আজ অনেক প্রেমিক, স্বামী তাঁদের প্রেমিকা ও স্ত্রীকে চুড়ি কিনে দিচ্ছিলেন। এ ছাড়া অনেক তরুণীও চুড়ি কিনছিলেন। বইমেলা উপলক্ষে লোকসমাগমও বাড়ছিল। এর মধ্যেই পুলিশ এসে সব শেষ করে দিয়েছে।
তবে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলাম টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই চুড়ি ব্যবসায়ীদের বহুবার বলা হয়েছে। কথা শোনে না। আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে বলেছি। আজকেও উচ্ছেদের আগে বলা হয়েছে। এ ছাড়া আমার কাজ এলাকা পরিষ্কার করা। এলাকা পরিষ্কারের জন্য এ ধরনের কাজ করতেই হয়।’
সূর্যবান চোখের পানি মুছতে মুছতে জানালেন, ১০ বছর ধরে চুড়ির ব্যবসা করেন। চার মেয়ে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। স্বামী মারা গেছেন। রাতে ব্যবসা গুটিয়ে ফুটপাতেই ঘুমান। চকবাজার থেকে মালামাল কেনেন। দিনে গড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার চুড়ি বিক্রি হয়। লাভ থাকে ৫০ টাকার মতো।
ময়মনসিংহের মাসুমা ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে ঢাকায় আসেন। উদ্দেশ্য, বইমেলা উপলক্ষে বেচাবিক্রি ভালো হবে। তিনি আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘পাঁচ মিনিটও সময় দিল না পুলিশ। বাইড়াইয়া সব শেষ কইরা দিলো।’
জামালপুরের অবেদাও বইমেলাকে কেন্দ্র ঢাকায় এসেছিলেন। মহাজনের কাছ থেকে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার মাল নিয়ে আসছেন বাকিতে। ব্যবসা করে টাকা শোধ দেওয়ার কথা ছিল। এখন তাঁর মাথায় হাত। অবেদার চার ছেলে, দুই মেয়ে। স্বামী নেই।
এই চুড়ি ব্যবসায়ীদের কান্নায় ফুটপাত দিয়ে যাঁরাই যাচ্ছিলেন তাঁরাই কিছুক্ষণ থামতে বাধ্য হন। চুড়ি ব্যবসায়ীরা যাকে সামনে পাচ্ছিলেন তাঁর কাছেই নালিশ দিচ্ছিলেন। একজন ব্যবসায়ী বললেন, ‘সরকার ভালোই দেখাচ্ছে। গরিবরে আরও মারতাছে।’
জামালপুরের মিঠু, হাফিজা, তালেব আলীসহ সবাই তাঁদের অসহায়ত্বের কথা জানাচ্ছিলেন। চারুকলার পাশের ফুটপাতে কিছু চুড়ি ব্যবসায়ী তখনও ব্যবসা করছিলেন। তবে তাঁরা জানালেন, তাঁরাও ভয়ে আছেন। যেকোনো সময়ই পুলিশ এসে সব ভেঙে দিতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.