ব্যাংক থেকে বাড়তি টাকা তুলে নিচ্ছেন গ্রাহক by আশরাফুল ইসলাম

ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত টাকা তুলে নিচ্ছেন গ্রাহক। চলমান সঙ্কটে আপৎকালীন প্রয়োজন মেটাতে গ্রাহকদের মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা দেখা দিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার কয়েকটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে আলাপকালে এ তথ্য পাওয়া গেছে। তারা জানিয়েছেন, কয়েক মাস যাবৎই চলতি আমানত কমে যাওয়ার ধারা অব্যাহত রয়েছে। সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতে চলতি আমানতের ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি ক্রমান্বয়েই খারাপ অবস্থানে চলে যাচ্ছে। এটা সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতের জন্যই অশনি সঙ্কেত বলে মনে করছেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, ২০টির বেশি ব্যাংকের প্রচলিত ও ইসলামি ব্যাংকিং শাখাসহ আমানতের প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ১০টির প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়ে গেছে। আর বাকি ১০টির প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। ব্যাংকগুলোর এ চিত্র গত ২৭ নভেম্বরের। আর চলতি আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে হয়েছে ঋণাত্মক প্রায় ৯ শতাংশ। সেই সাথে মেয়াদি আমানতের প্রবৃদ্ধিও কমে অর্ধেকে নেমেছে। যেখানে আগের বছরে ছিল প্রায় ৭ শতাংশ, সেখানে চলতি অর্থবছরে চার মাসে কমে নেমেছে সাড়ে তিন শতাংশ।
ব্যাংকারেরা জানিয়েছেন, এ চিত্র কয়েক মাস আগের। তবে হালনাগাদ চিত্র আরো করুন। তাদের মতে, আপৎকালীনে সাধারণত অতিরিক্ত অর্থ হাতে রাখতেই গ্রাহকেরা সাধারণত ব্যাংক থেকে বেশি হারে টাকা তুলে নিচ্ছেন। যেমন কোনো দুর্যোগকালীন খাবার-দাবার বেশি হারে রাখা হয় আপৎকালীন সময় পার করার জন্য। তেমনি ব্যাংকের গ্রাহকের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতির কারণ হিসেবে ব্যাংকারেরা জানিয়েছেন, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো দেশব্যাপী হরতাল-অবরোধ শুরু করেছে। এটা আজ ৪০ দিন পার হতে চলল। কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি। বরং দিন দিন তা আরো অবনতির দিকে যাচ্ছে। এ অবস্থায় ব্যাংকও গ্রাহকদের নগদ টাকার সঙ্কট মেটাতে এটিএম বুথগুলোতে প্রয়োজনীয় টাকা সরবরাহ করতে পারছে না। নিরাপত্তার অভাবে বেশির ভাগ সময়ে ব্যাংকগুলোর এটিম বুথগুলো টাকাশূন্য থাকছে। নিজেদের জরুরি প্রয়োজন মেটাতে তাই গ্রাহক ব্যাংক থেকে প্রয়োজনের তুলনায় বাড়তি অর্থ তুলে নিচ্ছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, সাধারণত ঈদের আগে ব্যাংকগুলো থেকে বাড়তি অর্থ উত্তোলন করেন গ্রাহক। এক সাথে বেশি গ্রাহক টাকা উত্তোলন করায় অনেক ব্যাংকেই নগদ টাকার সঙ্কট দেখা দেয়। এ সঙ্কট মেটাতে কলমানি (আন্তঃব্যাংক লেনদেন বা এক ব্যাংক আরেক ব্যাংকের কাছ থেকে স্বল্প সময়ের জন্য ধার করে থাকে) থেকে ধার করে। ফলে টাকার সঙ্কট থাকলে কলমানি মার্কেটে সুদের হার বেড়ে যায়। আর টাকার সরবরাহ বেশি থাকলে কলমানি মার্কেটে সুদের হার কম থাকে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রায় প্রতিটি ব্যাংক থেকেই টাকা উত্তোলন বেড়ে গেছে। এর ফলে কলমানি মার্কেটে সুদের হার বাড়ছে। এ অবস্থায় নড়ে চড়ে বসেছেন মার্কেট প্লেয়ারেরা। যাদের কাছে বাড়তি টাকা রয়েছে তারা অনেকটা দেখে শুনে টাকা ছাড়ছেন।
কলমানি মার্কেটের সুদের হারের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত বছরের ৩০ জুনে কলমানি মার্কেটে ১০০ টাকা ধার করতে ব্যয় করতে হয় ৬ টাকা ৫১ পয়সা। গত ১১ ফেব্রুয়ারিতে ব্যয় করতে হয়েছে ৮ টাকা ২৪ পয়সা। এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গড়ভিত্তিক পরিসংখ্যান। কিন্তু ব্যাংকভিত্তিক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় কোনো কোনো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে কলমানি মার্কেট থেকে ১০০ টাকা ধার নিতে ৯ শতাংশ পর্যন্ত সুদ গুনতে হয়েছে। যেমন গত ১২  ফেব্রুয়ারির পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ওই দিন ১১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান কলমানি মার্কেট থেকে ধার নিতে ৯ শতাংশ সুদ গুনেছে। এর মধ্যে বিএফআইসি ৪৫ কোটি টাকা, ডেলটা ব্র্যাক ২২০ কোটি, ফার্স্ট ফিন্যান্স ৩৫ কোটি, লঙ্কা-বাংলা ২০৯ কোটি, পিপলস লিজিং ৩৬ কোটি, ফোনিক্স ৯৪ কোটি, প্রিমিয়ার লিজিং ১৩১ কোটি, রিলাইয়েন্স ফিন্যান্স ২৮ কোটি টাকা ৯ শতাংশ সুদে কলমানি মার্কেট থেকে ধার করেছে। এর বাইরে ২৪টি ব্যাংক ২ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা ধার করেছে, যার মধ্যে সর্বোচ্চ সুদের হার ছিল ৮ শতাংশ। ওইদিন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান মিলে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ধার করে কলমানি মার্কেট থেকে।
ব্যাংকারেরা জানিয়েছেন, এখনতো কোনো বিনিয়োগ চাহিদা নেই। এমনিতেই এত দিন গ্যাস, বিদ্যুৎ, অবকাঠামোসহ আস্থার সঙ্কট ছিল বিনিয়োগকারীদের। এর ফলে ব্যাংকের তেমন উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ চাহিদা ছিল না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতিতে গত ৬ মাসের বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হয়নি। এখন ৫ জানুয়ারির পর থেকে একটানা দেশব্যাপী হরতাল-অবরোধ চলছে। এখন তো বিনিয়োগ পরিস্থিতি পুরোপুরিই ভেঙে পড়েছে। সুতরাং এই পরিস্থিতিতে টাকার চাহিদা থাকার কথা নয়। কিন্তু চলমান সঙ্কটের কারণে গ্রাহক ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত নগদ টাকা তুলে নেয়ায় এ সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে। তাদের মতে, চলমান সঙ্কট আরো দীর্ঘায়িত হলে ব্যাংকিং খাতে নগদ টাকার সঙ্কট আরো বেড়ে যাবে। কেননা, আমানতের সুদের হার কমে যাওয়ায় এমনিতেই ব্যাংকে আমানত কমছে। এর পাশাপাশি চলমান সঙ্কটে ব্যাংকের আরো বিপদ ডেকে এনেছে। তাদের মধ্যে চলমান সঙ্কট দ্রুত না কাটলে ব্যাংকিং খাতের জন্য অশনি সঙ্কেত বয়ে আনবে বলে তারা মনে করছেন।

No comments

Powered by Blogger.