সরকার তার দায়িত্ব এড়াতে পারে না by হাসান ফেরদৌস

দায়িত্বভার গ্রহণের সময় সরকারের প্রত্যেক সদস্যকে শপথ নিতে হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর মন্ত্রিসভার প্রত্যেক সদস্যকেও নিতে হয়েছে। সেই শপথ অনুযায়ী তাঁরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, দেশের প্রতিটি মানুষের জানমাল রক্ষা করবেন, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন। দেড় মাস ধরে অব্যাহত হরতাল ও অবরোধের কারণে সারা দেশে অচলাবস্থা নেমে এসেছে। প্রতিদিন নিহত হচ্ছে নিরীহ মানুষ। এসএসসি ও সমমানের প্রায় ১৫ লাখ পরীক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বিপর্যয়ের মুখে দেশের অর্থনীতি। এসবের কোনোটাই ঘটবে না—ক্ষমতা গ্রহণের সময় সরকার সে বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। বাস্তবে ঘটেছে উল্টো। যেভাবেই দেখুন, হরতাল-অবরোধের জন্য বিরোধী জোট দায়ী—শুধু এই কথা বলে সরকারের দায়িত্ব শেষ হয় না, হতে পারে না। যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তা যেভাবেই হোক সমাধান খোঁজার দায়িত্ব সরকারের। সাধারণ নাগরিক হিসেবে এ কেবল আমাদের প্রত্যাশা নয়, এটা আমাদের দাবিও।
জ্বালাও-পোড়াও ও পেট্রলবোমা ছোড়ার যে রাজনীতি বিরোধী জোট অনুসরণ করছে, তা ধ্বংসাত্মক, এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। দেশকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়ে তারা যদি ক্ষমতা দখলের কোনো স্বপ্ন দেখে থাকে, তা যে অলীক কল্পনা, সে কথাও আমরা অনায়াসেই বলতে পারি। ধরা যাক, বাঁকা কোনো পথে তাঁরা শেষতক নিজেদের মঞ্জিলে মকসুদে পৌঁছালেন। কিন্তু তারপর তাঁরা কোথায় সৌধ গড়বেন? এতগুলো মানুষের কবরের ওপর?
অন্যদিকে, বিরোধী জোটের সঙ্গে কোনো সংলাপ নয়, কারণ তারা সন্ত্রাসী—এই যুক্তিতে গোঁ ধরে বসে আছে সরকার। এটাও কোনো কাজের কথা নয়। পুলিশ দিয়ে বা আধা সামরিক বাহিনী নামিয়ে দেশের সব জেলখানা হয়তো ভরানো সম্ভব, কিন্তু এভাবে সংকটের সমাধান হবে না। কারণ, চলমান সংকট শুধু নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক নয়, এর মূল চরিত্র রাজনৈতিক। যে সংকট রাজনৈতিক, তা সমাধানের লক্ষ্যে সবচেয়ে যা জরুরি, সরকার মনে হয় সেটি করতেই নারাজ। সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের এই মনোভাব খুব বাস্তবসম্মত বলে মনে হয় না।
প্রতিপক্ষের সঙ্গে কথা বলা মানেই সরকারের হার মেনে নেওয়া—এমন যুক্তিতে যদি কেউ সংলাপের বিরোধিতা করেন, সেটি খুব অর্থপূর্ণ হবে না। আসলে এটি একটি সামন্ততান্ত্রিক মনোভাব। পাশাপাশি দুই জমিদার একে অপরের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেই যাচ্ছে বা একে অন্যের মাথা না ফাটানো পর্যন্ত ভাড়াটে লেঠেল দিয়ে লাঠালাঠি করেই যাচ্ছে। ঢালিউড-বলিউডের ছবিতে এমন ঘটনা হরহামেশাই ঘটে। এই লাঠালাঠির পরিণতি কী, তা আমাদের জানা—দুই পক্ষই একসময় দেউলিয়া হয়ে শুধু পরিধেয় বস্ত্রটি নিয়ে মাঠ ছাড়বে। এখন যে রাজনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তা বলিউডি ফিল্ম থেকে খুব বেশি ভিন্ন কিছু নয়। রাজনীতিকেরা যদি নিজেরা একে অপরের সঙ্গে লাঠালাঠি করে পথে বসতে মনস্থ করে থাকেন, তাতে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু চলতি লাঠালাঠির ফলে শুধু তাঁরা নন, পুরো দেশই মাঠে বসার উপক্রম হয়েছে। এই সাধারণ সত্যটি দেশের অধিকাংশ মানুষ বোঝে। বিদেশি কূটনীতিকেরা পর্যন্ত আমাদের সেই বিপদের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। শুধু হুঁশ আসছে না তাঁদের, যাঁরা নিজ নিজ কাচের দেয়ালঘেরা ঘরে বসে অন্যের দিকে পাথর ছুড়ছেন।
নিরাপত্তা বাহিনীর মাধ্যমে চলতি সংকটের সমাধান সম্ভব, এই হিসাব কষে যাঁরা নিশ্চিন্তে বসে আছেন, তাঁরা হিসাবে বোধ হয় ভুল করেছেন। প্রত্যেক বিরোধী রাজনীতিক ও তাঁদের সমর্থকদের জেলে না ঢোকানো পর্যন্ত জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতি থামবে না। কারণ, তাঁরা ধরে নিয়েছেন নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠার এটিই একমাত্র পথ। এই হরতাল-অবরোধের পথ ধরে একসময় এরশাদকে হঠানো গেছে, খালেদা জিয়ার ভেজাল নির্বাচন ঠেকানো গেছে। বিরোধী জোট সে অভিজ্ঞতায় পুষ্ট হয়ে এখন ২০১৪ সালের ভেজাল নির্বাচনের ফলাফল উল্টে দিতে চাইছে। যদি কোনো পক্ষই পিছু না হটে, তার ফল দাঁড়াবে যে এই দুই জমিদার একে অপরকে খাক করবে, সঙ্গে খাক হব আমরা।
কিন্তু এর বিকল্প পথও তো আছে। আর সেটি হলো দুই পক্ষের মুখোমুখি সংলাপ। রাজনৈতিক নেতৃত্বের শীর্ষ পর্যায়ে যে সংলাপ হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা নিউইয়র্কে সরকার ও বিরোধী পক্ষের বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন। আমার বিবেচনায় এটি বিরোধী পক্ষের একধরনের ছাড়। আলোচনার শর্ত হিসেবে বিএনপি-প্রধান যে সাত দফা প্রস্তাব দিয়েছেন, তা থেকে খোকার প্রস্তাব কিঞ্চিৎ ভিন্ন। সংলাপের আগে সরকারের পদত্যাগের দাবির মতো কোনো পূর্বশর্ত তিনি হাজির করেননি। সরকার চতুর হলে অনায়াসে এই ছাড়কে কাজে লাগিয়ে বিরোধী জোটের সঙ্গে আলোচনার শুরুতে সম্মতি জানাতে পারত। হোক না মাঝপর্যায়ে এ আলোচনা, কিন্তু তেমন সংলাপ শুরু হলেই আন্দোলনের তাপ কমবে। তার সঙ্গে কমবে মানুষের ভোগান্তি।
নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা রাষ্ট্রপতির মধ্যস্থতায় সংলাপ শুরুর প্রস্তাব দিয়েছেন। সে প্রস্তাব মাটিতে পড়তে না পড়তেই সরকারপ্রধান নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, যাঁরা প্রস্তাব রেখেছেন, তাঁদের একজন ছাড়া সবাইকে ঢালাওভাবে ওয়ান-ইলেভেনের মতলববাজদের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন। এমনকি সরকারের অবস্থানের ব্যাপারে যাঁরা ভিন্নমত পোষণ করেন, বিশেষত টক শোতে নরম-গরম কথা বলা যাঁদের অভ্যাস, প্রধানমন্ত্রী তাঁদের তালিকা তৈরির হুমকিও দিয়েছেন। এর চেয়েও ভয়াবহ কথা শোনা গেছে পুলিশ প্রশাসন থেকে। তারা বলেছে, একটি লাশ পড়লে তারা দুটি লাশ ফেলবে। এই প্রথম সম্ভবত কোনো গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের এক কর্মকর্তা প্রকাশ্যে বিচার-প্রক্রিয়ার বাইরে হত্যাকাণ্ডের পক্ষে সাফাই গাইলেন।
এসবই নিয়মতান্ত্রিক পথ থেকে সরে আসার ইঙ্গিত। গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘদিন সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের ন্যায্য দাবি যে দলটি বরাবর করে থাকে, এখন সেই দলের হাতেই ধীরে ধীরে গণতন্ত্রের মৃত্যুর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সেই মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব, কিন্তু তার জন্য ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ দূরে সরিয়ে দেশের স্বার্থকে সবার আগে রাখা দরকার। এই সাধারণ সত্যটি যদি আমাদের নির্বাচিত নেতারা না বোঝেন, তাহলে তার চেয়ে বড় ট্র্যাজেডি আর কী হতে পারে!
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.