দুই ভিনদেশীর অন্যরকম ভালবাসা by হাফিজ উদ্দিন ও একে আজাদ

ভিনদেশী দুজন মানুষ। ভাষাও ভিন্ন। কিন্তু মানুষের প্রতি মমত্ববোধ থেকেই এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এ দুজনই। সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন বাংলাদেশের মানুষের সেবায়। মাতৃভূমি ও মাতৃত্বের বন্ধন ছেড়ে থিতু হয়েছেন এই দেশে। একজন ভেলরি টেইলর। সাভারে গড়ে তুলেছেন পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র (সিআরপি)। যেখানে সেবা শুশ্রূষায় মানুষ ভুলে যায় তাদের অসহায়ত্ব। পঙ্গুত্ব নিয়েও বাঁচার লড়াইয়ে এগিয়ে যায় জীবনযুদ্ধে। অন্যজন ফাদার মারিনো রিগন। যিনি এসেছিলেন খুলনা অঞ্চলে ধর্মপ্রচারে। কিন্তু একাত্তরে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবায় নিজেকে সঁপেছিলেন। একে একে গড়েছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অসহায় ও দুস্থ নারীদের কর্মসংস্থানে কল্যাণমূলক অনেক প্রতিষ্ঠান। ভেলরি ও রিগনের ভালবাসা আজ বিশ্বস্বীকৃত। দেয়া ও নেয়ার কালস্রোতে এরা বাংলাদেশের মানুষকে শুধু দিয়েই গেলেন। চিরন্তন ভালবাসার এক অনন্য প্রতীক।
পক্ষাঘাতগ্রস্তদের কাছের মানুষ: ভিনদেশী এক মহীয়সী নারী। যিনি বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের সেবায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছেন। এদেশের মানুষের প্রতি ভালবাসার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। নিজের সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন মানুষের সেবায়। মাতৃভূমি ও মাতৃত্বের বন্ধন ত্যাগ করে চলে এসেছেন বাংলাদেশে। আত্মোৎসর্গ করেছেন নিজেকে। তিনি মিস ভেলরি এন টেইলর। বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী, পক্ষাঘাতগ্রস্ত ও মানুষের কল্যাণে প্রতিষ্ঠা করেছেন হাসপাতাল, পুনর্বাসন কেন্দ্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। রাজধানীর সন্নিকটে সাভারে প্রতিষ্ঠা করেছেন পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র (সিআরপি)। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে তৈরি করেছেন চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও পরামর্শ কেন্দ্র। ভেলরির জন্ম ৮ই ফেব্রুয়ারি ১৯৪৪ সালে যুক্তরাজ্যের ব্রুকলিনে। তার বাবা উইলিয়াম টেইলর ছিলেন গির্জার পুরোহিত। মা মেরি টেইলর ছিলেন গৃহিণী। তিন বোনের মধ্যে ভেলরি দ্বিতীয়। তিনি ১৯৬৯ সালে ভলান্টারি সার্ভিস ওভারসিজ (ভিএসও) নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাজে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান: বাংলাদেশ) আসেন। উদ্দেশ্য ছিল ফিজিওথেরাপি প্রদান। তিনি বাংলাদেশের চট্টগ্রামের কাছে চন্দ্রঘোনা খ্রিষ্টান হাসপাতালে ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে চলে যান নিজ জন্মভূমিতে। যুদ্ধোত্তর এদেশে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় পুনরায় ১৯৭২ সালে ফিরে আসেন। ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ডা. আরজে গাস্টের সঙ্গে একজন ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে রোগীদের সেবা দিতে শুরু করেন। রোগীদের সেবার পাশাপাশি ফিজিওথেরাপি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করেন। ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে রোগ মুক্ত হয়ে সুস্থ জীবনযাপন করা যায় একথা জানত না আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ। তিনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়েছেন। মানুষকে বুঝিয়েছেন ফিজিওথেরাপির কথা। একপর্যায়ে ১৯৭৯ সালের ১১ই ডিসেম্বর এই মহীয়সী নারী সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের একটি পরিত্যক্ত গোডাউনে মাত্র চারজন রোগী নিয়ে সিআরপির কাজ শুরু করেন। মানুষের সচেতনতা ও রোগীর সংখ্যা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯৮১ সালে ধানমন্ডির শঙ্করে বাড়ি ভাড়া করে সিআরপির কাজ চালানো হয়। একপর্যায়ে ফার্মগেটের একটি ভাড়া বাড়িতেও কিছুদিন সিআরপির কাজ চলে।
অবশেষে ১৯৯০ সালে সাভারে ১৪ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠা করা হয় সিআরপির প্রধান কার্যালয়। ক্রমান্বয়ে সিআরপির কলেবর বৃদ্ধি পেয়ে ঢাকার মিরপুর, সাভারের গণকবাড়ি, মানিকগঞ্জ এ ছাড়া পুরানো ঢাকার একটি পাইলট প্রজেক্টসহ ৮টি জেলার ৬১টি উপজেলায় সিআরপির সমাজভিত্তিক পুনর্বাসন কর্মসূচি চালু রয়েছে। সর্বস্তরের স্থানীয় প্রতিবন্ধীদের সহযোগিতার লক্ষ্যে সমাজ সেবা অধিদফতরের সহযোগিতায় ১৩ জেলায় ১১৫টি উপজেলায় কার্যক্রম বিস্তৃত হয়েছে। ড. মিস ভেলরি এন টেইলরের অক্লান্ত পরিশ্রম, ত্যাগতিতিক্ষার বিনিময়ে সিআরপি আজ এক পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠান। মানবসেবার এক বিশেষ মাইলফলক সিআরপি। সমাজের অগণিত প্রতিবন্ধী ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষের জীবন সাজাতে নিবিড়ভাবে কাজ করে চলেছে দুঃখী মানুষের এই প্রতিষ্ঠানটি। সিআরপির রয়েছে এক বিশাল দেশী-বিদেশী কর্মী বাহিনী। তাদের মেধা, শ্রম ও আন্তরিকতার ফলে প্রতিদিন সুস্থ হয়ে নিজ ঘরে ফিরছে মানুষ।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের ১০ শতাংশ মানুষ পক্ষাঘাতগ্রস্ত। সড়ক দুর্ঘটনা, গাছ থেকে পড়ে যাওয়া, জন্মগত ত্রুটি, মাথা বা ঘাড়ে বোঝা নিয়ে পড়ে যাওয়া, গরুতে আঘাতপ্রাপ্ত, শিল্প কারখানার দুর্ঘটনা, স্পাইনাল কর্ডের আঘাত প্রভৃতি কারণে প্রতিদিনই অসুস্থ হয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হচ্ছে অনেক মানুষ। হারিয়ে ফেলছে নিজ জীবন-জীবিকা। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে পরিবার, পরিজন ও সমাজ থেকে। সিআরপি এ ধরনের মানুষদের চিকিৎসার পাশাপাশি প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে থাকে। ফিজিওথেরাপি সেন্টারের মহররম, কম্পিউটার শাখার জ্যোতি, রুমা, বজলু, হোসনে আরাসহ এরকম ২০ জন প্রতিবন্ধী কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে এখানে। যারা সুস্থ মানুষের চেয়েও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য, পুনর্বাসন, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও বাহ্যিক পরিবেশ ফিরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে নিরন্তর কাজ করে চলেছে এই প্রতিষ্ঠানটি।
সিআরপির প্রধান কার্যালয়ে রয়েছে আউটডোর চিকিৎসা সুবিধা। এখানে প্রতিমাসে গড়ে পাঁচ হাজার রোগী ফিজিওথেরাপি এবং এক হাজার রোগী অকুপেশনাল থেরাপি চিকিৎসা নিয়ে থাকে। মেরুদ-ে আঘাতপ্রাপ্ত রোগীদের জন্য রয়েছে একশ’ সংখ্যার একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল। মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য রয়েছে একটি শিশু ইউনিট। মা ও শিশুদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। প্রতিবন্ধী শিশুর দৈনন্দিন জীবনযাপন ও কর্মকা-ের সহায়ক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হয় এখানে। আছে একটি স্পিচ অ্যান্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপি ইউনিট। বিভিন্ন প্রকার স্নায়ুবিক সমস্যা স্ট্র্রোক, মস্তিষ্কের আঘাত, প্যারালাইসিস ও ব্যথার জন্য এখানে রয়েছে বিশ্বমানের ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি এবং স্পিচ অ্যান্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপির চিকিৎসা।
এখানে আছে অত্যাধুনিক সুযোগ সুবিধা সংবলিত অপারেশন থিয়েটার, প্রতিবন্ধী সুইমিংপুল, প্যাথলজি, রেডিওলজি, টেলিমেডিসিন লিংক সার্ভিস। শারীরিক প্রতিবন্ধীদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে রয়েছে ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট। যেসব রোগী পুরোপুরি সুস্থ হয় না তারা যাতে বাড়ি ফিরে নিজের কাজ নিজে করতে পারে তাই চিকিৎসা শেষে তাদের হাফওয়ে হোস্টেলে রাখা হয় কয়েক সপ্তাহ। সঙ্গে থাকতে পারেন স্ত্রী ও সন্তান। বাড়ি গিয়ে কিভাবে চলাফেরা করবে এবং কি কাজ করবে এসব কিছু জানার জন্য রাখা হয় এই হোস্টেলে। এখানে শ্রেণী বিভাজন অনুযায়ী রয়েছে থাকার ঘর ও সিট। অনেকেই এখানে চিকিৎসা শেষে আবার কেউ কেউ দূর-দূরান্ত থেকে আসেন প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য। তারা তখন এখানকার ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে উঠেন। এখানে শেখানো হয় কম্পিউটার, ইলেকট্রনিক্স মেরামত, টেইলারিং, এমব্রয়ডারি, সপ ম্যানেজমেন্ট, নার্সারি, পোলট্রি ও সেলুনের কাজসহ নানা কিছু। লেখাপড়ার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে স্পেশাল নিডস স্কুল। রয়েছে সব ধরনের খেলাধুলা ও বিনোদনের ব্যবস্থা।
সিআরপির রোগীদের চিকিৎসা সেবা, পুনর্বাসনে যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয় তার বেশির ভাগই আসে বৈদেশিক সাহায্য থেকে। তবে রোগীদের আর্থিক অবস্থা বুঝে আনুপাতিক হারে চিকিৎসার জন্য অর্থ আদায় করা হয়।
মিস ভেলরি এন টেইলরের বৈদেশিক যোগাযোগের কারণে সিআরপির ফান্ড পেতেও তেমন অসুবিধা হয় না। দেশী-বিদেশী নানা সংস্থা, ব্যক্তি প্রতি বছর এই প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন। সেসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির সহযোগিতাও রয়েছে অনেক। তাছাড়া সিআরপির মিরপুর শাখাটি সম্পূর্ণই আয়ের উৎস হিসেবে কাজ করছে। সমাজের উচ্চবিত্তদের মধ্যে যারা টাকা দিয়ে চিকিৎসা করতে সক্ষম তাদের জন্য এখানে আছে মেডিক্যাল কেয়ার অ্যান্ড কনসালট্যান্সি, ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, ডায়াগনস্টিক সার্ভিসেস, শিশু বিভাগ ও স্ট্রোক রিহ্যাবিলিটেশন ইউনিট।
সিআরপির লক্ষ্য সম্পর্কে ড. ভেলরি এন টেইলর জানান, শারীরিক ভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষকে সুচিকিৎসার মাধ্যমে কর্মক্ষম করে তুলাই সিআরপি’র মূল লক্ষ্য এবং এ লক্ষ্য নিয়ে সিআরপি এখন সমগ্র বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার একটি সুপরিচিত নাম।
দুঃস্থ্য, দুর্গত মানুষের সেবার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৫ সালে বৃটেনের রাণী তাকে বিশেষ খেতাব ‘অর্ডার অব দ্যা বৃটিশ এম্পেয়ার’এ (ওবিই) ভূষিত করেন। এছাড়াও দেশের মানব কল্যাণের জন্য তিনি ১৯৯৬ সালে হল্যান্ডের ওয়ার্ল্ড অর্থোপেডিক কনসার্ন-এর দেয়া ‘আর্থার আয়ার ব্রাক’ স্বর্ণপদক লাভ করেন। ভেলরি ২০০০ সালে বাংলাদেশে জাতীয় সমাজসেবা পদক, ২০০১ সালে ডা. এমআর খান ও আনোয়ার ট্রাস্ট স্বর্ণপদক এবং হাক্কানী মিশন বাংলাদেশ পুরস্কার, ২০০৪ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কার এবং ২০০৫ সালে রোকেয়া শাইনিং পারসোনালিটি অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। এ ছাড়াও বেসরকারি হাউজিং প্রতিষ্ঠান শেলটেক (প্রা.) লিমিটেড কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ১৯৯৮ সাল থেকে প্রবর্তিত শেলটেক পদক, মানবসেবায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করায় সিআরপি’র প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে রোটারি ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিক্টের দি ওয়ান প্রজেক্ট কর্তৃক তাকে এক লাখ মার্কিন ডলার পুরস্কারের ঘোষণা দেয়া হয়।
জীবন বিলানো এক ফাদার
বাংলা, বাঙালি আর বাংলাদেশকে ভালবেসে যিনি নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন, যার রক্তের কণায় কণায় বাঙালির ঐতিহ্য, হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দনে বাংলাদেশের মানুষের কথা বলে, নারী মোহ নয়, রয়েছে অবহেলিত নারীদের মুক্তির সংগ্রাম, যার ভালবাসায় সিক্ত মংলার মানুষ, তিনি হচ্ছেন ফাদার মারিনো রিগন। ভিনদেশী এ মহান পুরুষ সেবক, শিক্ষক, ধর্মগুরু ও মুক্তিযোদ্ধা। তার অবদান বাংলাদেশের পতাকায়, প্রত্যন্ত অঞ্চলের ধূলিকণায়। যৌবনকাল বাংলাদেশে কাটালেও জীবন সায়াহ্নে এসে তিনি অবস্থান করছেন নিজ জন্মভূমি ইতালিতে। ১৯২৫ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি ইতালির ভিসেনছা প্রভিন্সের ভিলন্ডাভেরলা গ্রামে ফাদার মারিনো রিগনের জন্ম। বাবা রিকার্দো রিগন ছিলেন একজন কৃষক, অভিনেতা ও গায়ক। মা মনিকা রিগন ছিলেন স্কুলের শিক্ষিকা। আট ভাই-বোনের মধ্যে মারিনো সবার বড়। মাত্র ৫-৬ বছর বয়স থেকেই মারিনো ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। ওই বয়সেই তিনি স্বপ্ন দেখেন পুরোহিত হওয়ার। মারিনো ছাত্র সময় থেকেই গ্রিক, ফ্রেঞ্চ, লাতিন ও ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। মারিনো রিগনের বয়স তখন মাত্র ২৮ বছর। ধর্মের দীক্ষা নেয়া এক টগবগে যুবক। ধর্মগুরুরা নির্দেশ দিলেন তোমাকে বাংলাদেশে যেতে হবে ক্যাথলিক ধর্মপ্রচারক হিসেবে। মারিনো রাজি হলেন। ১৯৫৩ সালর ৭ই জানুয়ারি তিনি প্রথম যশোরের মাটিতে পা রাখেন। এরপর স্টিমারযোগে ঢাকায়। মারিনো ঢাকার আর্য বিশপ মিশনে থাকেন চার মাস। ওখানে বসেই বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ এবং সংস্কৃতি বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা অর্জন করেন। চার মাস পর মারিনোকে পাঠিয়ে দেয়া হয় কুষ্টিয়ার মুজিবনগরের ভবেরপাড়া ক্যাথলিক মিশনে। এর পর ১৯৫৪ সালে তিনি মংলার মালগাজি মিশনে আসেন। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত কাজ করেন খুলনার ক্যাথলিক মিশনে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার দায়িত্ব ছিল গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের বানিয়াচর মিশনে। সেখানে তিনি আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দিতেন। এর পর ১৯৭৯ সালে তিনি আবার মংলায় এসে শেলাবুনিয়ার সেন্টপলস ক্যাথলিক মিশনে যোগ দেন। ২০১৪ সালে ইতালিতে ফিরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি মংলার মাটি ও মানুষের সঙ্গে মিশে থাকেন। তিনি তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন শেলাবুনিয়ার ক্যাথলিক মিশন। গড়েছেন একাধিক হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অসহায়, দুস্থ ও নারীদের কর্মসংস্থানসহ নানা কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান। ১৯৫৪ সালে মংলায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বাগেরহাট জেলার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয়। শুরুর দিকে তিনি ওই বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া ফাদার রিগন খুলনার ফাতেমা উচ্চ বিদ্যালয়সহ যশোর, বাগেরহাট ও মংলার বিভিন্ন স্থানে ১৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়েছেন। অসহায় ও দুস্থ নারীদের জন্য মংলার শেলাবুনিয়ায় তিনি ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন নকশিকাঁথা সেলাইকেন্দ্র। শতাধিক নারী এখানে কাজ করছেন। এখানকার নকশিকাঁথা দিয়ে ১৯৮৬ সালের ২ থেকে ১০ই সেপ্টেম্বর ইতালির ভিসেনজা শহরের মনতে ডি পিয়েত্রা হলে, ১৯৯১ সালে ভেনিসে এবং ১৯৯৪ ও ২০০২ সালে রোমে প্রদর্শনীরও আয়োজন হয়েছে। বাংলা সাহিত্যচর্চা করেছেন ফাদার মারিনো রিগন। শোনেন লালনের গান। এসব সাহিত্য ও গান ইতালির ভাষায় অনুবাদও করেছেন। তার অনূদিত গীতাঞ্জলি ১৯৬৪ সালে ইতালিতে প্রকাশিত হয়। এ পর্যন্ত তিনি রবীন্দ্রনাথের ৪০টিরও বেশি কাব্যগ্রন্থ অনুবাদ করেন। তার অনুবাদ করা জসীমউদদীনের বইয়ের মধ্যে আছে নকশিকাঁথার মাঠ, জসীমউদদীনের নির্বাচিত কবিতা, সোজন বাদিয়ার ঘাট, সূচয়নী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের চন্দ্রনাথ, প-িত মশাই, সুকান্ত ভট্টাচার্যের সুকান্ত সমগ্র, লালন ফকিরের ৪০০টি লালনগীতি, লালন ফকির ও অন্যান্য বাউল গানের সংকলন, বাংলার বাউল ও বাউল গান। এ ছাড়া তিনি শেলাবুনিয়ার রূপকথা নামে একটি বই এবং ইতালিয়ান ভাষায় মৌলিক গবেষণাধর্মী ৯টি বইও লিখেছেন। ১৯৮৬ সালের ২৩শে নভেম্বর ইতালিতে আন্তর্জাতিক শিশু সংগীত প্রতিযোগিতায় রিগনের উদ্যোগে বাংলাদেশ থেকে শিশুশিল্পী অরিণ হক অংশগ্রহণ করে। প্রতিযোগিতায় সে প্রথম স্থান অধিকার করে। ১৯৮৭ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর থেকে ২রা অক্টোবর রিগন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির একটি সাংস্কৃতিক দল নিয়ে ইতালি সফর করেন। তারা সেখানকার ফ্লোরেন্স, ফায়েঞ্জা, চেরনুসকো, মিলান, ভেনিস ও ভিসেঞ্জাতে জসীমউদদীনের নকশিকাঁথার মাঠ অবলম্বনে নৃত্যনাট্য পরিবেশন করেন। এ ছাড়া ১৯৯১ সালে শামীম আরা নিপা, অপি করিমসহ নাচের দল নিয়ে রিগন ইতালি এবং ভ্যাটিকান সিটিতে সাংস্কৃতিক সফরে যান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, সমাজসেবা ও সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ২০০৮ সালে ৩০শে ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার তাকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেয়। সমাজসেবায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার ও সম্মাননা। ফাদার মারিনো রিগন শিক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে তার জন্মদিন উপলক্ষে মংলার হলদি বুনিয়া গ্রামে কয়েক বছর ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে রিগন মেলা। ফাদার রিগনের ঘনিষ্ঠ সহচর মংলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ সুনীল কুমার বিশ্বাস জানান, জীবন সায়াহ্নে সুদূর ইতালি বসেও ফাদার রিগন স্মরণ করছেন বাংলাদেশের মানুষের কথা। তিনি তার ঘনিষ্ঠজনদের বলেছেন, শেষ নিঃশ্বাসটুকু তিনি ফেলতে চান শেলাবুনিয়ার মাটিতে। চির শায়িত হতে চান মংলার কাদা মাটির কবরে।

No comments

Powered by Blogger.