নির্মাণ হচ্ছে আরেকটি টুইন 'রানা প্লাজা' by অমিতোষ পাল

এ যেন টুইন রানা প্লাজা! দুটি ১৫ তলাবিশিষ্ট মার্কেটের মধ্যে একটির চতুর্থ ও আরেকটির পঞ্চমতলা পর্যন্ত উঠে যাওয়ার পর ধরা পড়েছে ভবন দুটির নির্মাণকাজ খুবই নিম্নমানের। এভাবে তৈরি হলে ভবিষ্যতে সাভারের রানা প্লাজার মতো আরেকটি ভয়াবহ ভবনধস হতে পারে। নিম্নমান ধরা পড়ার পর ভবন দুটির নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। পরে নমুনা সংগ্রহ করে পাঠানো হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট)। বুয়েটের রিপোর্টে উঠে আসে নিম্নমানের নির্মাণকাজ ও সামগ্রী ব্যবহারের ভয়াবহ চিত্র। কলামে কংক্রিট প্রয়োজনের চেয়ে প্রায় ৭৯ শতাংশ পিএসআই কম। পিএসআই বলতে বোঝায় কংক্রিটের শক্তির একক বা পাউন্ড পার স্কয়ার ইঞ্চি। যেখানে কলামে কংক্রিট নূ্যনতম ৩ হাজার ৬২৫ পিএসআই থাকার কথা, সেখানে আছে মাত্র ৭৯০। এই মানের কলামে কোনোভাবেই কোনো বহুতল ভবন টিকে থাকতে পারে না। ইতিমধ্যে তৈরি হওয়া অংশটুকুও রাখা যাবে কি-না তা নিশ্চিত হতে ভবনের নিচের মাটি খুঁড়ে ফাউন্ডেশনের পুরুত্ব পরীক্ষার সুপারিশ করেছে বুয়েট। এ ন্যক্কারজনক ও মানহীন নির্মাণকাজ হয়েছে ডিএসসিসির ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেটের 'এ' ও 'বি' বহুতল শপিং কমপ্লেক্সে। সাভারের রানা প্লাজা ভবন নির্মাণেও এরকম ত্রুটি ছিল। খুবই নিম্নমানের নির্মাণকাজের কারণে ভবনটি ধসে মারা যান সহস্রাধিক মানুষ। এর আগে সূত্রাপুরের দয়াগঞ্জে ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) পরিচ্ছন্ন কর্মীদের বাসস্থানের জন্য নির্মিত ছয়তলা একটি ভবনে বসবাস শুরুর আগেই ২০০৭ সালের ২৫ মে তা ধসে পড়ে। নির্মাণকাজ ও নির্মাণসামগ্রীর মানহীনতাই ছিল ভবনটি ধসে পড়ার প্রধান কারণ। কিন্তু ওই ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দয়াগঞ্জের চেয়ে আরও নিম্নমানের কাজ হচ্ছিল ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেটের এ দুটি ভবন নির্মাণে।কয়েক বছর আগে ডিএসসিসির ফুলবাড়িয়া নগর ভবনের দক্ষিণ পাশে ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-০২ প্রকল্পের অধীনে দুটি ১৫ তলা ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করে করপোরেশন। ভবন দুটির প্রত্যেকটি তলার আয়তন ধরা হয় ৩৫ হাজার বর্গফুট। দোকান বানিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের মধ্যে এবং উন্মুক্তভাবে বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী দুটি ভবনের বিপরীতে প্রায় দুই হাজার দোকান বরাদ্দও সম্পন্ন হয়েছে। নিচতলা ও দোতলায় কিছু দোকানি ব্যবসাও চালু করেছেন। দেলোয়ার হোসেন দেলু নামে এক ঠিকাদার ভবন দুটির নির্মাণকাজ করছিলেন। গত ২৮ জানুয়ারি ডিএসসিসির প্রধান প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান কয়েকজন প্রকৌশলী নিয়ে নির্মাণকাজ দেখতে যান। ঢালাই ও কলাম দেখে তার সন্দেহ হয়, এই সব কলাম কোনোভাবেই ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের ভার বহনে সক্ষম হবে না। ২৯ জানুয়ারি তিনি কোর কাটার দিয়ে দুই ভবনের সাতটি কলামের নমুনা সংগ্রহ করে বুয়েটে পাঠান। গত ১ ও ২ ফেব্রুয়ারি বুয়েট নমুনা ও ভবনের কলামগুলোর চাপ শক্তি পরীক্ষা (কমপ্রেসিভ স্ট্রেন্থ টেস্ট) করে। এতে দেখা যায়, 'এ' নম্বর ভবনে কলাম-১-এর কংক্রিটের পিএসআই ৮৩০, যেখানে থাকার কথা নূ্যনতম ৩ হাজার ৬২৫। অর্থাৎ প্রয়োজনের তুলনায় ৭৭ দশমিক ১০ শতাংশ কম। একইভাবে কলাম-২-এর কংক্রিটে আছে ১ হাজার ৩৪০ পিএসআই। কলাম-৩-এ ২ হাজার ২০০ পিএসআই। 'বি' নম্বর ভবনের কলাম-১-এ আছে ১ হাজার ৪০ পিএসআই। কলাম-২-এ ৭৯০, কলাম-৩-এ ২ হাজার ১১০ ও কলাম-৪-এ ৩ হাজার ৩৭০ পিএসআই। কোনো কলামের কংক্রিটেই প্রয়োজনীয় ৩ হাজার ৬২৫ পিএসআই নেই।বুয়েটের প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে, প্রয়োজনের তুলনায় কংক্রিটের কমপ্রেসিভ স্ট্রেন্থ অনেক কম এবং কংক্রিট অনেক নিম্নমানের। এসব কলামের ওপর ভবন দুটি ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ করলে রানা প্লাজার চেয়েও ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।
নিম্নমানের নির্মাণকাজ সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, ভবন দুটির কাজে আলাদা করে কোনো সুপারভিশন ও কোয়ালিটি কন্ট্রোল ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ঠিকাদারের তরফ থেকে কোনো দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার নেই। ঢালাইয়ের সময় সিমেন্ট-বালু-পাথরকুচির অনুপাত ঠিক রাখা হয়নি। স্লাম্প টেস্ট করা হয়নি। কংক্রিটে বেশি পানি ঢেলে ঢালাই করা হয়েছে। শাটারিংয়ের ছিদ্র দিয়ে সিমেন্ট-পানি বের হয়ে যাওয়ায় হানিকম্ব তৈরি হয়েছে। ঢালাইয়ে সিলেট স্যান্ডস বা মোটা বালি ব্যবহার করা হয়নি। ঢালাইয়ের পর কলামগুলো চট দিয়ে ঢেকে পানি দেওয়া হয়নি। স্লাব সমান হলো কি-না তা লেভেল মেশিন দিয়ে পরীক্ষা করা হয়নি। সাইটে কোনো সাইট অর্ডার বই নেই। ফাউন্ডেশন করার আগে সয়েল টেস্ট (মাটি পরীক্ষা) করা হয়নি। সুপারভিশনের জন্য ডিএসসিসির প্রয়োজনীয় জনবল ছিল না। নির্মাণকাজ চলাকালে ডিএসসিসির জনবল দিয়ে সার্বক্ষণিক যে তদারকি করার কথা ছিল, তা করা হয়নি।প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে, মাটি খুঁড়ে কোর কাটার দিয়ে ভবন দুটির ফাউন্ডেশনের নমুনা সংগ্রহ করে এর মান পরীক্ষা করতে হবে। দেখতে হবে ফাউন্ডেশনের পুরুত্ব যা আছে তা কত তলার ভার বহন করতে পারবে। ভবনগুলোর পাশের দুই-তিনটি পয়েন্টের মাটি পরীক্ষা করতে হবে। নিয়োগ দিতে হবে দক্ষ প্রকৌশলী। এসব পরীক্ষার পর রিপোর্টের ভিত্তিতে ভবন দুটির রেট্রোফিটিং বা সংস্কারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।ডিএসসিসি সূত্র জানায়, ভবন দুটির নির্মাণের ক্ষেত্রেও নানা অনিয়ম রয়েছে। যে কারণে এই কাজের জন্য কোনো দরপত্র আহ্বান না করে দেলোয়ার হোসেন দেলুকে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। প্রকৌশল বিভাগের পরিবর্তে ডিএসসিসির সম্পত্তি বিভাগ ও প্রশাসকের দপ্তর থেকে পর্যবেক্ষণ করা হয়। ফলে এখন নিম্নমানের কাজের দায়িত্ব প্রকৌশল বিভাগ নিতে চাইছে না। তারা প্রকাশ্যে এ নিয়ে কোনো মন্তব্যও করতে চাইছে না। তবে প্রধান প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান সমকালকে বলেন, 'এটা নিয়ে এখনও কথা বলার সময় আসেনি। এর আগেও অনেক লোক এই পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তারা কেউ এখানে হাত দেননি। আমি ধরতে পারার পর অনেক চাপ আসছে। বেশি কথা বললে হয়তো দেখা যাবে আমার চাকরিই নেই।'
এ প্রসঙ্গে ঠিকাদার দেলোয়ার হোসেন দেলুর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে জানা যায়, তিনি এখন দেশের বাইরে। সরেজমিন দেখা যায়, ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন জাকের মার্কেটের পশ্চিমে হানিফ ফ্লাইওভারের দক্ষিণ পাশঘেঁষে প্রায় ১০ বিঘা জমির ওপর পাশাপাশি ভবন দুটির অবস্থান। পূর্ব পাশে 'এ' নম্বর ভবন। পশ্চিমে 'বি' নম্বর ভবন। 'এ' নম্বর ভবনের চারতলা পর্যন্ত উঠেছে তার ওপরে আরও কয়েকটি কলামের কিছু অংশ তৈরি করে রাখা হয়েছে। 'বি' নম্বর ভবনের পাঁচতলা পর্যন্ত ওঠার পরও একটি স্লাবের রড ও কলামের খাঁচা তৈরি করে রাখা হয়েছে। আর নিচতলায় মার্কেটের বিভিন্ন দোকান চালু হয়ে গেছে।

No comments

Powered by Blogger.