অস্তাচলের পথে যখন উকিল ও বিচারকরা by শফিক রেহমান

আগস্ট ১৯৪৭-এ ইনডিয়া যখন বিভক্ত হয় তখন পূর্ব পাকিস্তানমুখী আমাদের মতো খুদে পাঠকরা দুশ্চিন্তায় পড়েছিল। আমরা ভাবছিলাম ঢাকায় গিয়ে কিভাবে কলকাতার দেব সাহিত্য কুটির কর্তৃক প্রকাশিত বার্ষিক পূজা সংখ্যা এবং মাসিক কাঞ্চনজঙ্ঘা ও মাসিক প্রহেলিকা সিরিজের বইগুলো পাবো। এই বইগুলো বাধানোভাবে অর্থাৎ হার্ড কভারে প্রকাশিত হতো এবং তাতে সেই সময়ের প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকরা লিখতেন। কভার এবং ভেতরের পৃষ্ঠায় ছবি আকতেন প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতিটি ছবির নিচে ইংরেজিতে লেখা থাকত তার প্রথম নামটি : Protul, প্রতুল। ছোটদের চিত্তাকর্ষক এই দুটি সিরিজের লেখাগুলো ছিল রহস্য-রোমাঞ্চে ভরা এবং আমরা প্রতি মাসে তাকিয়ে থাকতাম নতুন বইটির প্রকাশনার জন্য।
যত দূর মনে পড়ে ১৯৫০ পর্যন্ত দেব সাহিত্য কুটিরের বইগুলো পূর্ব পাকিস্তানে আসত। এর মধ্যে একটি বই আমার কিশোর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। সেই বইটির নাম ছিল অস্তাচলের পথে। বইটির লেখকের নাম মনে নেই। তবে কাহিনীর সারমর্ম মনে আছে।
এই বইয়ের প্রধান চরিত্র ছিল এমন এক ব্যক্তি যার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। কিন্তু সে ছিল সম্পূর্ণ নির্দোষ। ব্যক্তিটি কোনোভাবে জেলখানা থেকে পালিয়ে যায়। তারপর তাকে যারা দণ্ডিত করেছিল, সেই বিচারক, জুরি এবং সরকার পক্ষের উকিলের বিরুদ্ধে সে প্রতিশোধ নেওয়া শুরু করে। একে একে তাদের হত্যা করতে থাকে। বইটির প্রচ্ছদে ছিল এক ব্যক্তি বড় সাড়াশি হাতে তাড়া করছে পলায়নপর বিচারক অথবা জুরিকে। তার সাড়াশির লক্ষ্য ছিল প্রাণভয়ে ভীত বিচারক অথবা জুরির গলা। প্রচ্ছদে বোঝার উপায় ছিল না পলায়নপর ব্যক্তিটি কে ছিলেন। বিচারক? নাকি কোনো জুরি? নাকি সরকারি কৌশুলি?
তবে ওই কিশোর বয়সে অস্তাচলের পথে বইটির এই প্রচ্ছদ এবং কাহিনীটি আমার মনে গভীরভাবে দাগ কেটেছিল। আমি এতটুকু বুঝেছিলাম, অন্যায় বিচারে নিষ্পাপ কোনো ব্যক্তিকে শাস্তি দিলে, শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তির প্রতিশোধস্পৃহা চরমে উঠতে পারে এবং পরবর্তী কোনো সময়ে সেই মামলায় অভিযোগকারী উকিল এবং রায় দানকারী বিচারক ও জুরিবৃন্দকে চরম খেসারত দিতে হতে পারে।
তাদের সবাইকে অস্তাচলের পথে যেতে হতে পারে।
অস্তাচল কি?
অস্তাচল হচ্ছে হিন্দু পুরাণে বর্ণিত একটি পাহাড়।
কল্পনা করা হয় সূর্য এই পাহাড়ের পেছনে অস্ত যায়।
বইটি পড়ার প্রায় ৬৭ বছর পরে সে রকমই একটি ঘটনা ঘটেছে।
নিউ ইয়র্ক টাইমসে ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪-তে রিচার্ড এ. ওপেল জুনিয়র-এর লেখা একটি রিপোর্টের শিরোনাম ছিল অ্যাজ টু মেন গো ফৃ, এ ডগেড এক্স-প্রসিকিউটর ডিগস ইন (As two Men Go Free, a Dogged Ex-Prosecutor Digs In, দুই ব্যক্তি যখন মুক্তি পেল, তখন এক নাছোড়বান্দা সরকারি কৌশুলি আত্মরক্ষার্থে গেড়ে বসল।) এখন পুরো রিপোর্টের ভাষান্তরটি পড়ুন।
ল্যামবারটন, নর্থ ক্যারোলাইনা। ১৯৮৩-তে একটি জঘন্য ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের যে মামলায় হেনরি ম্যাককালাম ও তার সৎ ভাই লিওন ব্রাউনকে তিন দশক জেলে কাটাতে হয়েছিল তার সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্তটি ছিল আদালতে একটি বৃলিয়ান্ট নাটকীয়তা প্রদর্শন।
রোবসন কাউন্টির ডিস্টৃক্ট এটর্নি (সরকারি কৌশুলি), সংক্ষেপে ডিএ (D.A.) জো ফৃম্যান বৃট-র উচ্চতা ছিল সাড়ে ছয় ফিট। তিনি আমেরিকার ডেডলিয়েস্ট ডিএ (Deadliest D.A.) বা সবচেয়ে প্রাণঘাতী সরকারি কৌশুলি নামে কুখ্যাত হয়েছিলেন। ওই মামলার শেষপর্যায়ে জুরিদের তিনি অনুরোধ করেন পাচ মিনিট দম বন্ধ করে থাকতে যাতে তারা কিছুটা হলেও বুঝতে পারেন হতভাগিনী ধর্ষিতা কি মৃত্যুযন্ত্রণা অনুভব করেছিল। এগারো বছর বয়সী একটি কিশোরী সাবৃনা বুলে-কে ধর্ষণের পর তার খুনিরা তার প্যান্টি গলায় একটি লাঠি দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। ফলে ওই কিশোরী সাবৃনার দম বন্ধ হয়ে মারা যেতে পাচ মিনিট সময় লেগেছিল।
মি. বৃটের ওই নাটকের পর জুরি রায় দেন অভিযুক্ত দুই ব্যক্তি দোষী। বিচারক কর্তৃক ম্যাককালাম মৃত্যুদণ্ডে এবং ব্রাউন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। দুই দশকে এভাবেই মি. বৃট ৪০-টিরও বেশি মৃত্যুদণ্ড আদায় করতে পেরেছিলেন।
কিন্তু ওই দুই ভাইয়ের অসংলগ্ন কথার ভিত্তিতে ওই দন্ড দুটি আদায় করা হয়েছিল। কয়েক দিন পরে সে সব কথা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। তার পরিবর্তে ওই দুই ব্যক্তির স্বীকারোক্তি (Confessions কনফেশনস) এবং সিনকেয়ার নামে একজন ইনফর্মারের (যিনি এর আগে ওই দুই ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করেন নি) তার সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তারা দণ্ডিত হন। যদিও মামলা চলার সময়ে আদালতে ওই দুই ব্যক্তি বলেছিলেন, তাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে স্বীকারোক্তিতে সই দিতে তাদের বাধ্য করা হয়েছিল।
গত সপ্তাহে সেই স্বীকারোক্তি ও সাক্ষ্য নাকচ করে দেওয়া হয়। ফলে ম্যাককালাম ও ব্রাউন সকল অভিযোগ থেকে মুক্তি পান এবং জেল থেকে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
তাদের মুক্তির ফলে একটি বিচার বিভাগীয় ভয়ঙ্কর কাহিনীর (a judicial horror story) সমাপ্তি ঘটল। হত্যাকাণ্ডটির সঙ্গে ওই দুই ব্যক্তির জড়িত থাকার কোনো দৈহিক প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও তাদের একজনকে ডেথ রো-তে (Death Row বা কমনডেমড সেলে) পাঠানো হয়েছিল।
এই মামলাটি যখন চলছিল তখন ঠিক সেই সময়ে অপরাধ সংঘটিত হবার স্থান (ক্রাইম সিন, Crime scene) থেকে ১০০ গজেরও কম দূরে থাকত এক সিরিয়াল যৌন অপরাধী। তার নাম ছিল রস্কো আর্টিস। বিচারাধীন হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হবার মাত্র কয়েক সপ্তাহ পরে ক্রাইম সিনের কাছেই প্রায় একই রকম পরিস্থিতিতে একটি টিনএজার মেয়েকে ওই সিরিয়াল যৌন অপরাধী খুন করেছিল। কিন্তু আর্টিসকে চলমান মামলায় সন্দেহভাজন রূপে উপস্থিত করানোর কোনো চেষ্টা কখনোই হয় নি।
পরিচয়ের বিভ্রান্তির ফলে নির্দোষ ব্যক্তি যে মৃত্যুদণ্ড পেতে পারেন এই মামলাটি সেটা প্রমাণ করে।
এই কেইস ফাইনালি শেষ হলেও, সমালোচকরা বলছেন, আমেরিকার এই অঙ্গরাজ্যে যেখানে বর্ণবৈষম্য প্রবল এবং দারিদ্র বেড়ে চলেছে, সেখানে হতভাগ্য গরিব মানুষরা যুগ যুগ ধরে একটি নিষ্ঠুর ফৌজাদারি বিচার পদ্ধতির (a merciless criminal justice system) শিকার হয়েছে। এই মামলার চূড়ান্ত পরিণতি মনে করিয়ে দিয়েছে কত নোংরা সেই বিচারব্যবস্থা।
এই নোংরামির প্রাণপুরুষটি হচ্ছেন জো ফৃম্যান বৃট, যিনি গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে এবং ৬০ মিনিটে (60 Minutes) নিজের স্থান করে নিয়েছেন মানুষকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করাতে সর্বাধিক পারদর্শি ব্যক্তি রূপে। তবে বৃটের ওকালতিতে দণ্ডিত সকল ব্যক্তিদের মধ্যে শেষ পর্যন্ত মাত্র দুইজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। (এই দুইজনের মধ্যে একজন ছিলেন মিজ ভেলমা বারফিল্ড (৫২) যিনি তার প্রেমিকের বিয়ারের মধ্যে বিষ মিশিয়ে তাকে হত্যা করেছিলেন।)
জো ফৃম্যান বৃটের বয়স এখন ৭৯। তিনি রিটায়ার করেছেন। মৃত্যুদণ্ড আদায়ে পারদর্শী রূপে এই অঙ্গরাজ্যে তিনি আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। এখন আদালতে ভিন্ন পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
বর্তমান ডিস্টৃক্ট এটর্নি জনসন বৃট-এর দাদা ছিলেন জো ফোরম্যান বৃটের পিতার কাজিন ভাই। জনসন বৃট বলেন, আমার পূর্বসূরী হয়তো অত্যাচারী ছিলেন। দোর্দন্ড প্রতাপে তিনি তার অফিস চালাতেন। মানুষজন তাকে ভয় করত। উকিলরা তাকে ভয় করত। তার ট্যাকটিকসে অন্য উকিলরা আতংকিত থাকত। সেভাবেই তিনি তার কাজ করতেন। কিন্তু আমাদের উচিত মানুষকে সম্মান দেখিয়ে কাজ করা কারণ তাতে অনেক বেশি সুফল পাওয়া যায়। মানুষকে গাড়িচাপা দেওয়ার ভয় না দেখিয়ে তাকে গাড়িতে তুললে ভালো ফল হয়। কিন্তু তার ট্যাকটিকসই ছিল মানুষকে ভয় দেখানো।
জনসন বৃটের এই কথার উত্তরে জো ফৃম্যান বৃট বলেন, ধরেই যদি নিই আমি ছিলাম একটা মূর্তিমান বাঘ তাহলে জনসন একটা মূর্তিমান বিড়াল। কি বলবেন? আমি মনে করি, যারা শুধু মদ খায় আর ফুর্তি করে, তাদের সঙ্গে জনসন বৃট খুব বেশি সময় কাটিয়েছে। আপিলে জনসন তাই কিছুই করতে পারেনি। ডিস্টৃক্ট এটর্নি রূপে সে আদালতে ফেল করেছে। তাই বিচারকরা আগের রায় উলটে দিতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু আমি জানি ওই দুই অভিযুক্ত ব্যক্তি প্রকৃতই দোষী।
নর্থ ক্যারোলাইনা নিষ্পাপ তদন্ত কমিশন (North Carolina lnnocence Commission) এই আপিলের সূচনা করেছিল এবং এটা সমর্থন করেছিলেন জনসন বৃট।
এক সময়ে নথ ক্যারোলাইনাতে টেক্সটাইল ও তামাকের শিল্পব্যবসা রমরমা ছিল। কিন্তু সে সব পড়ে যাওয়ার পর এই রাজ্যে বেড়ে যায় ড্রাগসের ব্যবসা। এখনো এই রাজ্যে সবচেয়ে বেশি সহিংস অপরাধ সংঘটিত হয়। এখানে মানুষ তিন ভাগে বিভক্ত : শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ এবং আদিবাসী আমেরিকান ইনডিয়া। শ্বেতাঙ্গরা সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও কৃষ্ণাঙ্গ ও আদিবাসীদের দাবিয়ে রেখেছে। ১৯৮৬-তে এক নিরস্ত্র ড্রাগস সন্দেহভাজনকে এক শ্বেতাঙ্গ ডেপুটি শেরিফ গুলি করে হত্যা করেছিল। কিন্তু অতি দ্রুত এবং অসম্পূর্ণ তদন্তের পর ডেপুটি শেরিফের বিরুদ্ধে মামলা খারিজ হয়ে যায়। এই ঘটনার দুই বছর পরে, এই ধরনের বৈষম্য এবং ফৌজদারি বিচার পদ্ধতিতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য একটি স্থানীয় সংবাদপত্র অফিসে ১৯ জনকে জিম্মি করেছিল একজন আদিবাসী।
জনসন বৃট এবং সমালোচকরা বলছেন, রস্কো আর্টিস-কে যে তখন বিন্দুমাত্র সন্দেহ করা হয়নি সেটা খুবই আশ্চর্যের। কারণ, ধর্ষিতার মৃতদেহ যে সময় ক্ষেতের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল তার পাশেই থাকতো রস্কো আর্টিস। সবারই জানা ছিল তার আগেই সে জেল খেটেছিল এবং একাধিকবার সহিংস যৌন অপরাধে অভিযুক্ত হয়েছিল। ১৯৮৪-তে মামলার সময়ে সরকারি কৌসুলি জো ফৃম্যান বৃট একটা সিগারেট আলামত হিসাবে কোর্টে দেখিয়ে দাবি করেছিলেন, সেটি ওই ক্ষেতে পাওয়া গিয়েছিল এবং সেটি ছিল দুই খুনির মধ্যে একজনের।
কিন্তু ল্যাবরেটরিতে সাম্প্রতিক পরীক্ষায় ওই সিগারেটে রস্কো আর্টিসের ডিএনএ পাওয়া যাওয়ার পর ম্যাককালাম ও ব্রাউনের মুক্তিপ্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়।
প্রথম কিশোরী সাবৃনা ধর্ষিতা ও খুন হবার চার সপ্তাহ পরে একইভাবে প্রায় একই স্থানে এক ধর্ষিতা এক টিনএজার মেয়ের মৃতদেহ পাওয়া যায়। এই ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগ আর্টিস স্বীকার করেছিল এবং তার দন্ড হয়েছিল। সে এখনো জেলে আছে। কিন্তু আর্টিস যে দুই মেয়েকেই ধর্ষণ ও হত্যা করেছিল সেই সম্ভাবনা বিষয়ে কোনো সরকারি তদন্ত হয়নি।
জনসন বৃট বলেন, রেড স্পৃংস শহরটি খুবই ছোট। এই ছোট একটি শহরে অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে প্রায় একই ধরনের দুটি খুন যদি হয়- তাহলে অতি স্বাভাবিকভাবে সন্দেহ করা উচিত ছিল দুটি খুনের মধ্যে একটি যোগসূত্র আছে। জো ফৃম্যান বৃট ৯০ দিনের ব্যবধানে দুটি মামলাই পরিচালনা করেছিলেন। কিন্তু এই যোগসূত্রের সম্ভাবনার বিষয়টি তিনি এড়িয়ে গিয়েছিলেন। এটা খুবই দুঃখজনক। ...ওই সময় ক্ষেতে বিয়ারের একটা ক্যান পাওয়া গিয়েছিল। তাতে যে দুটি আঙুলের ছাপ পাওয়া গিয়েছিল তার একটি ছিল নিহত কিশোরী সাবৃনার। কিন্তু অপর ছাপটি কার আঙুলের ছিল? ম্যাককালামের? ব্রাউনের? আর্টিসের? নাকি সিনকেয়ারের? অতি দুঃখের বিষয় সেই টেস্ট তখন করা হয়নি।
জনসন বৃট বলেন, এই নিষ্ক্রিয়তার কথা তখন ম্যাককালাম-ব্রাউনের উকিলদের জানানো হয়নি।
ইনফর্মার সিনকেয়ার আদালতে বলেছিলেন, কিশোরীটিকে খুনের কথা ম্যাককালাম তার কাছে স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু তার আগে ম্যাককালাম তারই কাছে বলেছিলেন খুনের বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। একটা লাই ডিটেক্টর মেশিন টেস্টে তখন ধরা পড়েছিল ম্যাককালাম সত্যি কথাই বলেছিলেন- অর্থাৎ, বিষয়টি তিনি জানতেন না। জনসন বৃট বলেন, এটা আরেকটা আশ্চর্য যে লাই ডিটেক্টরে ম্যাককালামকে টেস্ট করার ঘটনাটিও আদালতে তখন জানানো হয়নি।
জনসন বৃট বলেন, আরেকটি উদ্বেগের বিষয় যে, রেড স্পৃংস পুলিশ বহু বছর যাবত দাবি করে আসছিল যে তাদের কাছে কোনো ফিজিকাল এভিডেন্স নেই। অথচ এই বছরে ইনোসেন্স কমিশন কর্মকর্তারা থানায় গিয়ে ফিজিকাল এভিডেন্স আবিষ্কার করেন। খুনের স্থান থেকে সংগৃহীত চুলের স্যাম্পল তারা পান এবং তার কোনো ডিএনএ ম্যাককালাম অথবা ব্রাউনের সঙ্গে ম্যাচ করেনি।
ম্যাককালামের উকিল কেনেথ রোজ বলেন, যে স্বীকারোক্তি আদালতে পেশ করা হয়েছিল তার পুরোটাই ছিল বানোয়াট। ...বরং সেই স্বীকারোক্তিতে বোঝা যায় ম্যাককালাম ছিলেন আংশিকভাবে মানসিক প্রতিবন্ধী। ...এটা দেখে হতভম্ব হয়ে যেতে হয়, যে নিরপরাধ একটি ব্যক্তির জীবন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে জেনেও জো ফৃম্যান বৃটের মতো ব্যক্তিরা বিভিন্ন আলামত আমলে নেননি।
জো ফৃম্যান বৃট এখন বলেছেন, এসব কিছু আমার মনে নেই। ডিএনএ এভিডেন্সকে কেন যে এত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে সেটা আমি বুঝি না। যখনই কোর্টে আমরা জেরা শুরু করেছি তখনই তাদের উকিলরা বলতো ওরা মানসিক প্রতিবন্ধী! এটা আমার কাছে হাস্যকর মনে হতো। ...আদালতে আমি যেসব যুক্তিতর্ক করেছি তার দরকার ছিল।
ল্যামবারটনের জনৈক উকিল উডি বাওয়েন বারো বছর জো ফৃম্যান বৃটের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। বাওয়েন বলেন, ম্যাককালাম ও ব্রাউনকে তিন দশক জেলবন্দী রাখাটা হয়েছে একটি অবর্ণনীয় মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি। ...জো ফৃম্যান বৃটকে ভয় করতেন অন্য সব উকিলরা।
আরেকজন উকিল এংগাস টমসন বলেন, যখন কোনো ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় তখন বিচারক তার রায়ের সমাপ্তি টানেন তাকে এই বলে যে, তোমার আত্মার প্রতি ঈশ্বরের করুণা বর্ষিত হোক। তারপর বিচারক আদালতের বেইলিফ বা নাজিরকে বলেন, এই ব্যক্তি এখন আপনার হেফাজতে। আমি (টমসন) আশা করি এখন জো ফৃম্যান বৃটের আত্মার প্রতি ঈশ্বর করুণা বর্ষণ করবেন।
কোনো ক্ষতিপূরণ সম্ভব না
নর্থ ক্যারোলাইনার নিয়ম অনুযায়ী অন্যায়ভাবে দণ্ডিত হবার ক্ষতিপূরণস্বরূপ ম্যাককালাম ও ব্রাউন উভয়েই ৭৫০,০০০ ডলার পাবেন। কিন্তু তাতে তাদের ৩০ বছরের জেলজীবনের কোনো ক্ষতিপূরণ সত্যিই কি হবে?
এ বিষয়ে তীব্র ক্ষোভ জানিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টে ম্যাককালামের উকিল কেনেথ রোজ লিখেছেন, ম্যাককালাম ও ব্রাউন শেষ পর্যন্ত যে মুক্তি পেয়েছেন তাতে কেউ কেউ আশা করছেন আমি সন্তুষ্ট হবো - এমনকি খুশিও হবো। কিন্তু সত্যটা হচ্ছে এই যে আমি ক্রুদ্ধ। আমি প্রচণ্ড রেগে আছি। কারণ, আমরা এমন একটা পৃথিবীতে বাস করছি যেখানে পুলিশ মিথ্যা বলতে পারে, নির্দোষ মানুষকে অত্যাচার করে বানোয়াট স্বীকারোক্তি আদায় করতে পারে, মিথ্যা সাক্ষী হাজির করাতে পারে, ভুয়া ইনফর্মারকে আদালতে আনতে পারে। আর সেই আদালতে প্রকৃত সত্য প্রতিষ্ঠা অসম্ভব হতে পারে বিভিন্ন কারণে। আর তার ফলে নিরপরাধ ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। ...আমি রাতে ঘুমাতে পারি না। যখন জেগে থাকি এবং এই মামলার বিস্তারিত বিষয়গুলো চিন্তা করি তখন ভাবি, ম্যাককালামের মতো আরো কত মানুষ ডেথ সেলে আছেন যারা ব্যাকুলভাবে সাহায্যের অপেক্ষায় আছেন যে সাহায্য হয়তো কখনোই তারা পাবেন না।
বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি
কেনেথ রোজের এই ক্ষোভে হয়তো বাংলাদেশের মানুষ নিজ দেশেরই প্রতিচ্ছবি দেখতে পাবেন। বাংলাদেশে হাই প্রোফাইল পলিটিকাল বন্দীদের মৃত্যুদণ্ড এবং সেসব কার্যকর হওয়া অথবা না হওয়া নিয়ে গণদাবি হয়, টকশো হয়, পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়। কিন্তু লো প্রোফাইল অথবা নো প্রোফাইলের সাধারণ মানুষের মৃত্যুদণ্ড বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না।
বাংলাদেশে বিচারব্যবস্থা যে অস্তাচলে যাচ্ছে সেই কথা বলা হয় না।
সবচেয়ে বড় কথা যেহেতু হেনরি ম্যাককালামের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে দেরি হয়ে গিয়েছিল এবং যেহেতু এই সময়ের মধ্যে ডিএনএ শনাক্তকরণ পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়, সেহেতু আমেরিকার মতো উন্নত দেশে ত্রিশ বছর পরে জানা গেল ম্যাককালাম ও ব্রাউন নির্দোষ ছিলেন।
যদি ম্যাককালামের মৃত্যুদণ্ড আগেই কার্যকর হয়ে যেত তাহলে এই সত্যটা কোনো দিনই জানা যেত না। আর তাই কোনো অপরাধেই অপরাধীর শাস্তি রূপে মৃত্যুদণ্ড গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবার পরে ভুল সংশোধনের কোনো উপায়ই থাকে না।
তখন শুধু থাকে উকিল, বিচারক ও জুরিবৃন্দকে অস্তাচলে পাঠানোর অদম্য প্রতিশোধস্পৃহা।
facebook.com/Shafik Rehman Presents
৫ নভেম্বর, ২০১৪

No comments

Powered by Blogger.