সাবধান শাকিব খান by এফ আই দীপু

শুরুটা তার চিত্র পরিচালক সোহানুর রহমান সোহানের হাত ধরে। ১৯৯৯ সালে ‘অনন্ত ভালোবাসা’ ছবি দিয়েই ঢালিউডে শাকিব খানের পথচলা শুরু। যদিও তার আগে নৃত্য পরিচালক আজিজ রেজার হাত ধরেই এফডিসির ধুলো মেখেছেন গায়ে। এই আজিজ রেজাই হাত ধরে তাকে এফডিসি চিনিয়েছেন। চিনিয়েছেন চলচ্চিত্র। আর সোহানুর রহমান সোহান তাকে নিয়ে গিয়েছেন লাখো দর্শকের কাছে। শাকিবের কাছে সেসব এখন অতীত। আজিজ রেজা অতীত, সোহানুর রহমান সোহান অতীত। যাদের হাত ধরে আজকের এই শাকিব খানের জন্ম, তাদের পরিচয় দিতে তিনি কুণ্ঠাবোধ করেন। কিন্তু কেন? এই সোহানুর রহমান সোহানের হাত ধরে ঢাকার চলচ্চিত্রে পা রেখেছিলেন প্রয়াত মহানায়ক সালমান শাহ। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চলচ্চিত্রে জন্মদাতা হিসেবে সোহানের নাম তিনি শ্রদ্ধাভরে স্মরণে রেখেছিলেন। গর্বিত পিতা হিসেবেও কখনও কখনও গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন। সালমান শাহ অতীত হলেও চলচ্চিত্রপ্রেমীদের হৃদয়ে বর্তমান হয়েই বেঁচে আছেন। ভবিষ্যতেও বেঁচে থাকবেন। কিন্তু শাকিবের ভাগ্যে তা ঘটবে কী? বিষয়টি প্রশ্নসাপেক্ষ।
সালমান শাহের জন্মদিন উপলক্ষে গেল সেপ্টেম্বরে এফডিসিতে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে আক্ষেপ করে সোহানুর রহমান সোহান সে কথাই বলেছেন। গর্বভরে সালমান শাহ’র নাম উচ্চারণ করেছেন। অথচ সোহানের মুখে শাকিবের সমালোচনা ছাড়া অন্য কিছু জোটেনি। যে মাধ্যমে কাজ করে, যাদের সঙ্গে সময় ব্যয় করে আজকের শাকিব খান হয়েছেন, তাদের মন জয় করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। বিষয়টি কী শাকিব কখনও অনুধাবন করেছেন? অতীত অস্বীকার করে কী কেউ কোনো দিন বড় হতে পেরেছে? শাকিব খান হয়তো বড় হয়েছেন, নিজস্ব দর্শক-ভক্ত তৈরি করেছেন। কিন্তু চলচ্চিত্রকর্মীদের মনে আজীবন বেঁচে থাকার মতো রসদ এখনও জোগাড় করতে পারেননি। বিষয়টি কী শাকিব আরও একবার ভেবে দেখবেন? কারণ অতীত মানুষকে যেমনি শিক্ষা দেয়, তেমনি জ্বালায়ও বটে!

একবিংশ শতাব্দীর শুরুটা চলচ্চিত্রের জন্য ভালো ছিল। কিন্তু এর বছর দুয়েক যেতে না যেতেই ঢাকার চলচ্চিত্রের অবস্থা একেবারেই নাজুক হয়ে পড়ে। ‘অশ্লীলতা’ নামক একটি শব্দ পুরোপুরিই গ্রাস করে ফেলে ঢাকার ছবিকে। পুরনো অনেকে সেই স্রোতে গা ভাসাতে না পেরে চলচ্চিত্র থেকে বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু শাকিব খান বিদায় নেননি। কালের স্রোতে গা ভাসিয়েছেন তিনি। নিজে কোনো অশ্লীল ছবিতে অভিনয় না করলেও তার অভিনীত বিভিন্ন ছবিতে অশ্লীল দৃশ্য সংযোজন করে হলে প্রদর্শিত হয়েছে। সে সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে শাকিব খানকে নিয়ে সমালোচনা হলেও তিনি কিন্তু এর কোনো প্রতিবাদ করেননি। বরং সমানতালে সেই সব অশ্লীল ছবির নির্মাতাদের সঙ্গে কাজ করে গেছেন। নিজের কাজের পরিমাণ কমে যাবে বলে শাকিবের এই নীরবতা- এমন অভিযোগও তখন কেউ কেউ তুলেছেন। তাতে মোটেও ভ্রুক্ষেপ করেননি শাকিব। ফলে ‘স্বার্থপর’ বলেও অনেকে তাকে বিশেষায়িত করেছেন।
অশ্লীলতা বিদায় নিয়েছে এক সময়। অশ্লীল শিল্পীরাও পালিয়েছেন। ফলে শিল্পীশূন্য চলচ্চিত্রে এক শাকিব খান ছাড়া আর কেউ ছিল না। এবার শুরু হল তার একক রাজত্ব। অবশ্য বেশ কিছু হিট ছবিও উপহার দিয়েছেন তিনি। এই হিট ছবিগুলোর কল্যাণে অশ্লীলতার তকমাটা নিজের শরীর থেকে মুছতে সক্ষম হয়েছেন শাকিব। এক শাকিবের প্রতিই সব নির্মাতা, প্রযোজকের দৃষ্টি। সঙ্গে দর্শকের দৃষ্টিও ছিল। এই রাজত্বের সুযোগটা কাজে লাগিয়েছেন শাকিব। ইচ্ছেমতো কাজ করা, দেরি করে সেটে আসা কিংবা হুটহাট নায়িকা পরিবর্তন- পাহাড়সম অভিযোগ নিয়েই নির্মাতারা তার প্রতি ঝুঁকে ছিলেন। বিকল্প তৈরির চেষ্টা করেননি। কিংবা সেটা হতে দেননি শাকিব। অথচ এই রাজত্বের ক্যারিয়ারটাকে ইচ্ছে করলে অনেক ওপরে নিয়ে যেতে পারতেন শাকিব খান। এখানে দরকার ছিল তার ভালোবাসার। কিন্তু কাজের প্রতি, কিংবা কর্মরত লোকদের প্রতি ভালোবাসা না দেখিয়ে অতিমাত্রায় বাণিজ্যিক হওয়ার কারণে শাকিব খান যে পরিমাণ শ্রদ্ধা পাওয়ার যোগ্য কিংবা সুযোগ ছিল সেট অর্জন করতে পারেননি। অথচ ইচ্ছে করলে বাংলার প্রসেনজিৎ হওয়া তার জন্য কঠিন কিছু ছিল না। সময় এবং সুযোগ সবটাই তার নাগালের মধ্যেই ছিল। যদিও সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি। বিষয়টি এখনও আরও একবার ভেবে দেখতে পারেন শাকিব।
শাকিবের রাজত্বে ধস নামিয়েছেন হাল আমলের আরেক সুপারহিট নায়ক অনন্ত জলিল। একক রাজত্বের রাজা শাকিব খানের প্রতি যখন দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন ঠিক তখনই অনন্তর আবির্ভাব। বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ছবি নির্মাণ করে তিনি এলিট শ্রেণীর দর্শকদের হলমুখী করেছেন। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছেন। এখনও আছেন। অথচ ক্যারিয়ারের ১৫ বছরেও কোনো ছবি দিয়ে এলিট শ্রেণীর দর্শকদের হলে টানতে পারেননি শাকিব। তিনি স্বীকার না করলেও এটা তার ব্যর্থতা বলেই মন্তব্য করে তার ভক্তরা।
শাকিবের ব্যবসাসফল বেশিরভাগ ছবিই নকল গল্পের। ভারতীয় তামিল, তেলেগু কিংবা মালয়লামের কোনো গল্প চুরি করেই এসব ছবি নির্মিত হয়েছে। বিভিন্ন সময় তা গণমাধ্যমে প্রকাশিতও হয়েছে। নকল গল্পের নায়ক বলেও কেউ কেউ তাকে সম্বোধন করেন। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে গেল রোজার ঈদে তার প্রথম প্রযোজিত ছবিটিও তামিল ছবির নকল। এসব সমালোচনা মোটেও পীড়া দেয় না তাকে। অর্থই যার কাছে বড় তার কাছে সম্মানের কোনো মূল্য নেই। দেশাÍবোধের কোনো জায়গা নেই। শাকিব খান কী সেটাই প্রমাণ করতে চাইছেন? অন্য দেশের গল্প চুরি করে দেশের সম্মান নষ্ট করা হচ্ছে। বিষয়টি কী শাকিব একবার ভেবে দেখবেন?
ক্যারিয়ারে এতটা সময় পার করেও আজীবন দর্শক বেঁচে থাকার মতো কোনো বিকল্প চরিত্রে অভিনয় করেননি শাকিব। এটাও তার জন্য একটা ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতা কী দিয়ে ঢাকবেন তিনি?
যদিও গেল কোরবানির ঈদে আবারও সফল তিনি। কিন্তু নকলের অভিযোগ মোটেও পিছু ছাড়েনি তার। বরাবরের মতো তিনি নকলের প্রতিই আকৃষ্ট এবং সন্তুষ্ট। শাকিবের বিরুদ্ধে আরও কিছু অভিযোগ অনেকেই করে থাকেন। নিজের অভিনীত ছবিতে নতুন কাউকে সুযোগ না দেয়াটা এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
চলচ্চিত্রের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা না থাকাটাও তার প্রতি আরেকটা অভিযোগ। শুধু বাণিজ্যিক চিন্তার মধ্যে ডুবে থাকলে ভবিষ্যৎ কিন্তু অন্ধকার।
অতএব, সাধু সাবধান। এখনও সময় আছে। শাকিব খানকে দর্শক ভালোবাসে। দর্শকের ভালোবাসার সেই প্রতিদান তাকেই দিতে হবে। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না।

No comments

Powered by Blogger.