আন্তর্জালিক- অ্যাকাউন্টিং বিভ্রাট by নুসরাত শ্রাবণী

আমি একটা ব্যাংকে চাকরি করি, অ্যাকাউন্ট সেকশনে। কিছুদিন হলো আমার সেকশনে নতুন একটা ছেলে এসেছে, সুমন। বয়সে তরুণ। আমার বেশ ভালো লেগে গেল, অল্প কিছুদিনেই তার সাথে সখ্য জমিয়ে ফেললাম।
কিছুদিনের মধ্যেই বুঝলাম দারুণ মেধাবী সুমন। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাকাউন্টিংয়ে ¯স্নাতকোত্তর করেছে। অফিসের সবাই তো তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অ্যাকাউন্ট সেকশনের হেড হাফিজ ভাই সুমনকে একরকম পদবি দিয়ে ফেললেন, তুখখাড় মেধাবী! বুঝেছিলাম যে সে অ্যাকাউন্টিং বেশ ভালোই বোঝে; কিন্তু এত ভালো যে, কিছুদিন পরে তাকে নিয়ে পড়লাম বিপাকে।

সে দিন অফিস ছুটি। সুমনকে নিয়ে বেরুলাম, গেলাম জাদুঘরে। গ্যালারিগুলো দেখছি আর সে আমাকে বর্ণনা দিচ্ছেÑ বুঝছেন, এই মূর্তিটার বয়স ৩০৩ বছর আট মাস, ওইটা ৫০৩ বছর আট মাসের পুরনো ইত্যাদি। প্রথমে ভাবলাম, সে ‘তুখখাড়’ ছেলে, আমার চেয়ে বেশিই জানে; কিন্তু কিছুক্ষণ পরে আমার একটু খটকা লাগল। বললাম, তুমি এত নিশ্চিত কিভাবে যে এগুলোর বয়স এত?
সুমন বলল, আমি তিন বছর আট মাস আগে এখানে এসেছিলাম। তখন রুম সার্ভিসে যে লোকগুলো থাকে তারা বলছিল। এখন দেখেন, তিন বছর আট মাস আগে যদি এইটার বয়স ৫০০ বছর হয় তাহলে এখন ৫০৩ বছর আট মাস হয়।
ও, আচ্ছা! আমি একটু বিষম খেয়ে বললাম, তাহলে দিনটাও হিসাব করে রাখা উচিত ছিল। তাহলে পুরোপুরি সঠিক বয়স বলতে পারতে।
বেচারা আমার রসিকতাটুকু ধরতে পারল না। বলল, হ্যাঁ, একদম ঠিক বলেছেন! আগে ভাবি নাই তো!
কয়েক দিন ধরে দেখছি সুমনের চোখের নিচে কালি। লাঞ্চের সময় ক্যান্টিনে বসে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে, চোখের নিচে কালি পড়ছে কেন? রাতে ঘুমাওনি?
- কী যে হইছে বুঝতেছি না। ঘুমই হয় না।
-ঘুম আনানোর একটা প্রাচীন পদ্ধতি আছে, ভেড়া গোনা। গুনছ কখনো?
- হুম জানি। সেইখানে তো প্রবলেম। ভেড়া গুনতে গেলে কোথায় যেন একটা ভুল হযে যায়! তারপর তিন চার ঘণ্টা চলে যায়; কিন্তু আমি আর খুঁজে পাই না যে ভুল কোথায় করলাম।
আমি বুঝতে পারলাম না আমার কী বলা উচিত। তাই নীরব থাকলাম।
আমি ভেবেছিলাম সুমন বোকা; কিন্তু ভালো অ্যাকাউন্ট্যান্ট। কিন্তু ঠিক কত ভালো সেটা বুঝলাম কয়েক দিন পর। কিছু কাজ নিয়ে হেড অফিসে যাওয়া লাগবে। আমি, সুমন, সাথে আরো দুইজন কলিগ, অফিসের মাইক্রোবাসে যাচ্ছি। আমাদের সাথে ব্যাংকের কিছু টাকাও ছিল। বিধি বাম, রাস্তায় পড়লাম ছিনতাইকারীর কবলে। তারা বলল, ‘সাউন্ড না কইরা যার কাছে যা আছে দিয়া দেন।’ আমরাও সুবোধ ছেলের মতো তাই করছিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে খোঁচা খেয়ে তাকালাম। দেখি সুমনের হাতে ৫০০ টাকার একটা নোট। বলল, আপনি আমার কাছে ৫০০ টাকা পেতেন না? নিন, রাখেন।
আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, মানে কী? এখন কেন দিচ্ছ? সে চিঁ চিঁ করে বলল, না রাখেন,্ ধারদেনা রাখা ভালো না।
আমি তার কথা বোঝার আগেই এটা বুঝলাম যে আমি টাকা তার হাত থেকে নিয়ে ছিনতাইকারীদের হাতে দিয়ে দিয়েছি। তারপর বাকি রাস্তা অফিসে যেতে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে লাগলাম, অ্যাকাউন্ট্যান্ট মানে হিসাবরক্ষক। জীবনের হিসাব তারা চুলচেরাভাবে করবে সেটাই স্বাভাবিক।
সুমন অন্য একটা ব্রাঞ্চে চলে গেছে কিছুদিন আগে, আর আমি অপেক্ষা করছি নতুন কোনো অ্যাকাউন্ট্যান্টের।

No comments

Powered by Blogger.