দেশে এ বছর ১৯ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে -মোট কর্মক্ষম ব্যক্তিদের বেশির ভাগই তরুণ by মোছাব্বের হোসেন

চাকরি মানেই কি সোনার হরিণ? মোটের ওপর সবার ধারণা হয়তো তেমনটাই। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে কাজের বাজার দিনে দিনে বড় হচ্ছে। দেশের কর্মক্ষেত্র নিয়ে সরকারি জরিপ এবং বিশ্বব্যাংক ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, চলতি অর্থবছরে দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে প্রায় ১৯ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। সামনের বছরগুলোতে এই বৃদ্ধির হার আরও আশাব্যঞ্জক হবে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের তথ্য অনুসারে, ২০১১-১৫ এই পাঁচ বছরে মোট এক কোটি চার লাখ লোকের নতুন কর্মসংস্থানের লক্ষ্য রয়েছে। আর বিশ্বব্যাংক বলছে, এখন প্রতিবছর নতুন করে ১৩ লাখ মানুষ বাংলাদেশর শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ২০১২ সালের এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ২২ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হওয়াতেই দেশের কাজের বাজার বড় হচ্ছে।
কোথায় তৈরি হচ্ছে কর্মক্ষেত্র: গত বছরের প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমবাজার বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়ন প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে ভোগ্যপণ্য উৎপাদন, বিপণন প্রতিষ্ঠান, আর্থিক সেবা খাতের প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা-প্রশাসনিক খাতে, কৃষি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, পর্যটনশিল্প, আবাসন, স্বাস্থ্য ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে দক্ষ কর্মীর চাহিদা বেড়েছে। কাজের সুযোগ বেড়েছে টেলিযোগাযোগ খাত, পোশাকশিল্প, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবা, ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক সেবার প্রতিষ্ঠানে।
পরিকল্পনা কমিশনের সূত্র মতে, বাংলাদেশে আরেকটি বিকাশমান ক্ষেত্র হচ্ছে ওষুধশিল্প। মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসংলগ্ন বাউশিয়া ও লক্ষ্মীপুর মৌজায় ২০০ একর জমিতে ওষুধশিল্প পার্ক স্থাপন করবে সরকার। সেখানে ওষুধশিল্পের কাঁচামাল উৎপাদনের জন্য ৪২টি প্লট হবে। এতে প্রায় ২৫ হাজার লোকের সরাসরি কর্মসংস্থান হবে। এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত প্রথম আলো জবসসহ বিভিন্ন চাকরির পোর্টালে ৭০ হাজারেরও বেশি চাকরির বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে বিক্রয় ও বিপণন খাতে লোকের চাহিদা ছিল বেশি।
শ্রমশক্তির বর্তমান চিত্র: বাংলাদেশ সরকারের ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন পর্যালোচনা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০১০-১১ থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশের ভেতরে নতুন সাড়ে ৪৭ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এ ছাড়া ওই তিন বছরে ১৫ লাখ ৭০ হাজার লোক বিদেশে গেছেন। ২০১১-২০১৫ এই পাঁচ বছরে দেশ ও দেশের বাইরে মোট এক কোটি চার লাখ লোকের কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। চলতি অর্থবছরে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। সেই হিসাবে, এই অর্থবছরে প্রায় ১৭ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। একই সময়ে দুই লাখ লোক কাজের জন্য বিদেশে যাবেন। সব মিলিয়ে নতুন করে প্রায় ১৯ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে।
তবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সমীক্ষা অনুযায়ী, কোনো দেশে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ হলে নতুন করে আড়াই লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়। চলতি অর্থবছরে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। সেই হিসাবে, আগামী অর্থবছরে প্রায় ১৮ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। একই সময়ে দুই লাখ লোক কাজের জন্য বিদেশে যাবেন। সব মিলিয়ে প্রায় ২০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে।
প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষিত তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছেন। শিক্ষিত তরুণদের কর্মসংস্থান কীভাবে হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, এই অর্থবছরে এক হাজারের বেশি উন্নয়ন প্রকল্পে ৮৬ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হবে। এর বেশির ভাগ বিনিয়োগমুখী প্রকল্প। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে সরাসরি কর্মসংস্থানের পাশাপাশি বিনিয়োগে আকৃষ্ট ও মানবসম্পদ উন্নয়ন করা হবে। পরিকল্পনামন্ত্রী উদাহরণ দিয়ে বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ‘লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং’ প্রকল্পের মাধ্যমে আগামী কয়েক বছরে প্রায় ৫০ থেকে ৫৫ হাজার শিক্ষিত তরুণের কর্মসংস্থান হবে।
শ্রমশক্তি রপ্তানি: বাংলাদেশের মানুষের একটি বড় অংশের কর্মসংস্থানের বাজার রয়েছে দেশের বাইরে। এই বাজারে শিক্ষিতের পাশাপাশি স্বল্প শিক্ষিত, অশিক্ষিত ব্যক্তিরা যেমন আছেন তেমনি দক্ষ-অদক্ষ সব শ্রেণীর মানুষ আছেন। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর দেওয়া তথ্য অনুসারে, ১৯৭৬ থেকে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বিদেশে ৮৯ লাখ ৫৬ হাজার ৮১০ জন বাংলাদেশি কর্মরত আছেন। ধারণা করা হয়, সব মিলে এ সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে গেছে।
পোশাকশিল্প: দেশের মধ্যে সিংহভাগের কর্মসংস্থান হয়েছে পোশাকশিল্পে। পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম প্রথম আলোকে বলেন, সংগঠনের সদস্যভুক্ত তিন হাজার ৫৫১টি পোশাকশিল্প কারখানায় মোট ৪২ লাখ শ্রমিক কাজ করছেন, যাঁদের বেশির ভাগই নারী। ২০১০-১১-তে এই সংখ্যা ছিল ৩৬ লাখ। আগামী বছরগুলোতে এই খাতে কর্মসংস্থান আরও বাড়বে বলে বিজিএমইএ মনে করছে।
টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাত: দেশে এখন ছয়টি মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান আছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের তথ্য অনুসারে, দেশে মোবাইল গ্রাহকের ১১ কোটি ৬৫ লাখ। সক্রিয় এই বিপুল পরিমাণ গ্রাহককে সেবা দেওয়ার জন্য প্রতিটি মোবাইল অপারেটর নানা পর্যায়ে লোক নিয়োগ দিয়ে আসছেন। মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন এমটব জানিয়েছে, ছয়টি মুঠোফোন কোম্পানিতে স্থায়ী পদে আছেন ১৩ হাজার কর্মী। তবে এই খাতে নানা স্তরে কর্মসংস্থান হয়েছে ১৬ লাখ মানুষের। ফোনে টাকা ভরা (রিচার্জ) পাশাপাশি এখন মোবাইল ব্যাংকিং সেবাও দেওয়া হচ্ছে সেখানে। এ ছাড়া মুঠোফোন মেরামত, বিভিন্ন উপকরণ বিক্রি করেও অনেকে স্বাবলম্বী হয়েছেন। পাশাপাশি কম্পিউটারনির্ভর বিভিন্ন সেবার প্রচুর দোকান ও সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে সারা দেশে।
শ্রমশক্তিতে তরুণ নেতৃত্ব: বর্তমানে দেশের মোট কর্মক্ষম ব্যক্তির বেশির ভাগই তরুণ, যাঁদের বয়স ১৫ থেকে ২৯। আনুপাতিক হারে জনসংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনি কাজের ক্ষেত্রও বেড়েছে। এমনই তথ্য দিচ্ছে বাংলাদেশের সর্বশেষ শ্রম জরিপ। এখন দেশের মোট কর্মক্ষম ব্যক্তিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে তরুণ। এই হার ৫৩ দশমিক ২৪ শতাংশ।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ২০১২ সালের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ওই বছর দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক-স্নাতকোত্তরসহ উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেছেন প্রায় সাড়ে তিন লাখ শিক্ষার্থী। পড়াশোনা শেষ করে এই তরুণ জনবল ঢুকছেন কর্মক্ষেত্রে। চাকরির পাশাপাশি তরুণদের মধ্যে নিজ উদ্যোগে কিছু করার ইতিবাচক প্রবণতাও লক্ষ করা গেছে।
মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞ গ্রো-এন-এক্সেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এম জুলফিকার হোসেন মনে করেন, প্রতিবছর যে সংখ্যক স্নাতক বের হন, তাঁদের সঠিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আরও দক্ষ ও চৌকস করে গড়ে তোলা হলে দেশের বাজারে বিদেশিদের চাহিদা কমে যাবে।
দক্ষ লোকবলের সংকট: বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা অনুসারে এখানকার প্রধান গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো হলো, তৈরি পোশাক, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষিজাত খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, জাহাজ নির্মাণ, পর্যটন ও হালকা কারিগরি নির্মাণ ইত্যাদি। এসব খাতের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত যথাযথ কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীর অভাব রয়েছে। পোশাক খাতের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্য মতে, বাংলাদেশের পোশাক কারখানা ও বায়িং হাউসে বিদেশি কর্মীর সংখ্যা কয়েক হাজার, যাঁরা প্রত্যেকে মোটা অঙ্কের বেতন পান। মার্চেন্ডাইজার, প্যাটার্ন মাস্টার ও ডায়িংয়ে অনেক বিদেশি কাজ করেন। এখনো বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় পোশাক খাতের জন্য দক্ষ কর্মী তৈরির বিষয়টি তেমনভাবে গুরুত্ব পায়নি। যদিও দেশের মধ্যে এটি সবচেয়ে বড় কাজের ক্ষেত্র। দেশেই দক্ষ লোকবল তৈরি করা গেলে এই খাতে বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীলতা কমে আসবে, দেশের তরুণেরা এই ক্ষেত্রগুলোতে কাজের সুযোগ পাবেন। জুলফিকার হোসেন মনে করেন, আগামী পাঁচ বছরে কোন কোন চাকরির জন্য বেশি দক্ষ কর্মী প্রয়োজন তা নির্ধারণ করে সেই অনুপাতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে কাজের বাজার আরও বাড়বে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ ধরনের কর্মক্ষেত্র-সম্পৃক্ত শিক্ষার ব্যবস্থাও করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.