নোবেল শান্তি পুরস্কার ও বঞ্চিত জাপান by মনজুরুল হক

নোবেল শান্তি পুরস্কার যে পশ্চিমের দেশগুলো রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, সেটা নতুন কথা নয়। অতীতের বিভিন্ন নোবেল শান্তি বিজয়ীদের পূর্ব জীবন ও পরবর্তী কার্যকলাপের দিকে দৃষ্টিপাতে সেই সত্যই বেরিয়ে আসে। এর বড় প্রমাণ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নোবেল পুরস্কার। বিশ্ববাসীকে বলা হয়েছিল যে চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানীতে দেওয়া ভাষণে বিশ্বকে মারণাস্ত্রমুক্ত করার যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন, সেই পথ ধরে তাঁর এগিয়ে চলাকে উৎসাহিত করতে নোবেল শান্তি পুরস্কারে তাঁকে ভূষিত করা হলো। শান্তির সেই পুরস্কার পকেটে ভরে নিয়ে পরবর্তী সময়ে তিনি যা করলেন, তা হলো বিশ্বজুড়ে হানাহানির মাত্রা আরও কিছুটা বাড়িয়ে দেওয়া।
বারাক ওবামার কথা বাদ দিয়ে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পাওয়া অন্যদের দিকে দৃষ্টিপাত করলেও রাজনীতির ফায়দা লুটে নেওয়ার হিসাবটাও সহজে চোখে পড়ে। এবারের নোবেল শান্তি পুরস্কারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তানের পাঠান বংশোদ্ভূত বালিকা কিংবা ভারতের এক এনজিওকর্মী কতটা অবদান রাখতে পারবেন, তা ভেবে দেখা দরকার। মালালার বেলায় পরিষ্কার যে আভাস ইতিমধ্যে পাওয়া যাচ্ছে তা হলো, ওকে এখন সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠানো হবে পশ্চিমের মানবাধিকার আর সম-অধিকারের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার কাজে। সম্ভবত এটাই ছিল নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য সেই বালিকাকে বাছাই করে নেওয়ার উদ্দেশ্য। একা ওকে পুরস্কার দেওয়া হলে ব্যাপারটা গোলমেলে ঠেকতে পারে বলেই হয়তো ভারতের সত্যার্থীর ভাগ্য খুলে গেল। বিবদমান উপমহাদেশে তাঁরা দুজনে মিলে কীভাবে শান্তি ফিরিয়ে আনেন, মানুষ সেটা দেখার অপেক্ষায় থাকবে।
নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রবর্তনের পেছনের উদ্দেশ্য ছিল, বিশ্বজুড়ে হানাহানি আর সংঘাত বন্ধে সত্যিকার অর্থে যাঁরা অবদান রেখেছেন বা রাখছেন, তাঁদের পুরস্কৃত করার মধ্য দিয়ে শান্তির সম্ভাবনার ধারণাকে এগিয়ে নেওয়া। ফলে অশান্তি সৃষ্টির পেছনে সামষ্টিক যে কাঠামোকে সব সময় কাজে লাগানো হয়, সেই সামরিক বাহিনীর বিলুপ্তিতে সহায়ক পদক্ষেপ গ্রহণকেও পুরস্কৃত করার বিষয়টি আলফ্রেড নোবেল তাঁর রেখে যাওয়া দলিলে উল্লেখ করেছিলেন। আমরা জানি, সারা বিশ্বে এখন পর্যন্ত সে রকম কিছুর জন্য কাউকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়নি, এবার যদিও নোবেল শান্তি পুরস্কার কমিটির সামনে সেই সুযোগ উপস্থিত হয়েছিল।
নোবেল শান্তি পুরস্কারের এবারের এক প্রত্যাশী প্রার্থী ছিল জাপানের জনগণ। এই সত্য হয়তো জাপানের বাইরে অনেকেরই অজানা। এর কারণ হলো, এমনকি জাপান সরকারও চায়নি যে পুরস্কার তাদের দেশের নাগরিকদের সম্মিলিতভাবে দেওয়া হোক। কেননা, তেমন কিছু ঘটলে রাজনীতির হিসাব-নিকাশের দিক থেকে খুবই অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়তে হতো প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সরকারকে। সমালোচকেরা বলছেন, জাপানের নাগরিকদের পুরস্কৃত না করার জন্য জোর লবি যারা চালিয়েছিল, তাদের মধ্যে সক্রিয় ছিল জাপান সরকার। প্রশ্ন হচ্ছে, নিজের দেশের নাগরিকদের যেন নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য বেছে নেওয়া না হয়, সে জন্য জাপান সরকার কেন মরিয়া হয়ে উঠল? রাজনীতির হিসাব-নিকাশের মধ্যেই প্রশ্নের উত্তর নিহিত।
জাপানের সংবিধান হচ্ছে বিশ্বের একমাত্র সংবিধান, যুদ্ধ পরিহারের পরিষ্কার বার্তা যুক্ত থাকার পাশাপাশি সামরিক বাহিনী রাখার অধিকার থেকেও যে সংবিধান দেশকে বঞ্চিত করেছে। ফলে আলফ্রেড নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য যেসব শর্ত তাঁর দলিলে উল্লেখ করে গেছেন, তার সঙ্গে খুবই সামঞ্জস্য আছে জাপানের সংবিধানের বিশেষ সেই ধারাটির, সাধারণভাবে নবম সাংবিধানিক ধারা বা শান্তির ধারা নামে যেটা পরিচিত।
তবে জাপানের বর্তমান সরকার দেশকে আবারও রণসাজে সজ্জিত করার ব্রত নিয়ে সংবিধানের নবম ধারাকে বাদ দেওয়ার পাঁয়তারা শুরু করার পর শান্তির সেই সনদকে কীভাবে সংবিধানে টিকিয়ে রাখা যায়, তা নিয়ে অনেকেই ভাবতে শুরু করেন। নাগরিক পর্যায়ের সেই ভাবনাচিন্তার প্রক্রিয়ায় কাওয়াসাকি শহরের দুই সন্তানের জননী, ৩৭ বছর বয়সী এক গৃহবধূর মাথায় হঠাৎ করেই সাংবিধানিক সেই ধারাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাইয়ে দেওয়ার ধারণাটি এসেছিল। কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে মিলে তিনি প্রথমবারের মতো নোবেল শান্তি পুরস্কার কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে চেয়েছিলেন, সংবিধানের নবম ধারাকে কীভাবে তারা পুরস্কারের জন্য মনোনীত করতে পারে। নোবেল কমিটি উত্তরে তাঁদের জানিয়েছিল যে বিশেষ ধারণা বা নীতিমালার মতো অস্পষ্ট কোনো কিছুকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয় না এবং শুধু ব্যক্তি কিংবা সংঘবদ্ধ কোনো গ্রুপ বা দলই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হতে পারে।
তত দিনে কাওয়াসাকির সেই গৃহবধূর ব্যক্তিগত উদ্যোগ সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত খবরে অনেকেই জেনে গিয়েছিলেন এবং তাঁরা একসময় এ রকম প্রস্তাব রেখেছিলেন যে সংবিধান যেহেতু জাপানের নাগরিকদের সম্পত্তি, ফলে নবম সংবিধানের রক্ষক হিসেবে জাপানের জনগণকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেওয়া হোক। নাগরিক সমাজের অনেকের কাছে এই প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য মনে হওয়ায় দেশজুড়ে স্বাক্ষর অভিযান চালানোর মধ্য দিয়ে জাপানের জনগণকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয় এবং নোবেল কমিটিও সেই মনোনয়ন গ্রহণ করে। তবে বিষয়টি জাপান সরকারের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
জাপান সরকার এখন চীনের ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠাকে হুমকি হিসেবে গণ্য করছে এবং তা মোকাবিলার পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে। অন্যদিকে, জাপানের সনাতন সামরিক মিত্র যুক্তরাষ্ট্র চাইছে জাপান যেন দ্বিপক্ষীয় শান্তি চুক্তির আওতাকে সম্প্রসারিত করে নিয়ে আত্মরক্ষার সম্মিলিত অধিকার প্রয়োগের ধারণা মেনে নেয়। আত্মরক্ষার সম্মিলিত অধিকার প্রয়োগের ধারণার পেছনে যে প্রক্রিয়া কাজ করে থাকে তা হলো, একটি দেশ আক্রান্ত হলে চুক্তির আওতায় সেই দেশের সমর্থনে অন্যের এগিয়ে আসা। অর্থাৎ, চীন কিংবা রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে লিপ্ত হলে জাপানকেও সেই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে শামিল হতে হবে।
জাপান সরকার চীনের বিরুদ্ধে নিবারক পদক্ষেপ হিসেবে আত্মরক্ষার এই যৌথ অধিকার প্রয়োগে আগ্রহী। তবে সংবিধানের বিশেষ সেই ধারা যেহেতু দেশের ভৌগোলিক সীমানার বাইরে যেকোনো সামরিক কর্মকাণ্ডে জাপানের জড়িত হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে, তাই সেই সাংবিধানিক ধারাকে কীভাবে বাদ দেওয়া কিংবা অকেজো করে ফেলা যায়, সেই লক্ষ্যে সরকার এখন কাজ করে চলেছে। তাই সংবিধানের শান্তির ধারার রক্ষক হিসেবে জাপানের নাগরিকদের নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হলে আবে সরকারের হিসাব-নিকাশ ভন্ডুল হতে পারে, সে রকম আশঙ্কা থেকেই দেশের নাগরিকদের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার বিরুদ্ধে সরকার অবস্থান নিয়েছিল।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশ্বজুড়ে জাপান সরকারের শক্তিশালী সব মিত্রও পুরস্কার না দেওয়ার ধরনায় আবে সরকারের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। সে রকম চাপের মুখে কাওয়াসাকি শহরের অজানা এক গৃহবধূর মাথায় প্রথম দেখা দেওয়া ধারণার যে খুব বেশিদূর অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়, তা তো সহজেই অনুমান করে নেওয়া যায়।

No comments

Powered by Blogger.