দায়মুক্তি পাচ্ছেন ক্ষমতাসীনেরা- ছাড় পাচ্ছেন না বিরোধী দলের রাজনীতিবিদেরা by মোর্শেদ নোমান

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যেন অনেকের জন্য দুর্নীতি থেকে দায়মুক্তির কমিশনে পরিণত হয়েছে। ‘অভিযোগের আমলযোগ্য তথ্য-প্রমাণ না পাওয়ার কারণে’ দুর্নীতির অভিযোগ থেকে একের পর এক দায়মুক্তি পাচ্ছেন সরকার-সমর্থিত রাজনীতিবিদ, প্রভাবশালী আমলা ও বিত্তশালী ব্যক্তিরা। দায়মুক্তির ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে দৃশ্যমান প্রমাণ থাকলেও দুদকের কর্মকর্তারা কোনো প্রমাণ পাননি। নির্বাচন কমিশনে নিজেদের দেওয়া হলফনামায় আর্থিক অনিয়মের প্রমাণ থাকলেও ‘ভুল হয়েছে’ অজুহাত গ্রহণ করে দেওয়া হয়েছে দায়মুক্তি। অবশ্য বিরোধী দলের রাজনীতিবিদেরা দায়মুক্তির কোনো সুযোগ পাননি। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে এক হাজার ৫৯৮ জনকে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দিয়েছে দুদক। এ সময়ে ৯০৪টি দুর্নীতির অভিযোগের মধ্যে ৮৭০টিতে কোনো মামলাই হয়নি। সব মিলিয়ে ২০১১ থেকে ২০১৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত তিন বছর আট মাসে দুদক পাঁচ হাজার ৩৪৯টি দুর্নীতির অনুসন্ধান নথিভুক্ত করে আসামিদের দায়মুক্তি দিয়েছে। এর মধ্যে বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরোর সময়ে করা মামলাও রয়েছে। তবে সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত কতজনকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে, তার কোনো পরিসংখ্যান দুদকের কাছেও নেই।

দুর্নীতি প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেভাবে রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছেন, তাতে দুদকের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। অনেকেই ব্যঙ্গ করে এ সংস্থাটিকে “দায়মুক্তি কমিশন” বলছেন। আমার কাছেও আপাতদৃষ্টিতে তা-ই মনে হচ্ছে।’ প্রতিটি ছাড় ও দায়মুক্তির বিষয়ে দুদকের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকা উচিত বলে মনে করেন সাবেক এই মহাহিসাবনিয়ন্ত্রক। তবে দুদকের চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ পেলে দুদক কাউকেই ছাড় দেয় না। তদন্তে কোনো অভিযোগের প্রমাণ না পাওয়া গেলেই কেবল চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। কমিশন রাজনৈতিক বিবেচনায় কোনো মামলা করে না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে করে থাকে। ঢালাওভাবে কাউকে আটক করা কিংবা ছেড়ে দেওয়া হয় না।
দুদকের দেওয়া দায়মুক্তির ক্ষেত্রে অন্যতম সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হচ্ছে পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ থেকে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীসহ ১০ জনকে দায়মুক্তি দেওয়া। অথচ একই অভিযোগে কানাডার আদালতে মামলা চলছে। এ ছাড়া নবম জাতীয় সংসদের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-সাংসদদের হলফনামা নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে চলতি বছরের জানুয়ারিতে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক, গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান, সাংসদ আসলামুল হক, এনামুল হক, আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দুদক। তাঁদের মধ্যে হলফনামায় তথ্য দিতে ‘ভুল হয়েছে’—এ যুক্তি গ্রহণ করে আ ফ ম রুহুল হক ও আসলামুল হককে অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দেয় সংস্থাটি। এরও আগে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন সাবেক সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মোজাম্মেল হোসেন ও বিটিএমসির সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কালাম। ২০১২ সালে বহুল আলোচিত রেলের কালো বিড়াল কেলেঙ্কারির ঘটনায় মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানই চালায়নি দুদক। আর টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নেওয়ার ক্ষেত্রে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ বিষয়ে তাঁর পুত্র সৌমেন সেনগুপ্তকে দায়মুক্তি দেয় দুদক। অথচ, চলতি বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা প্রবাসী বন্ধুদের সম্মাননা ক্রেস্টের সোনা জালিয়াতির অনুসন্ধানের কাজ শুরু হলেও এ বিষয়ে তেমন অগ্রগতি নেই।
প্রভাবশালীদের অব্যাহতি: এ বছর দুর্নীতির অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন সরকারদলীয় বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তাঁদের মধ্যে আছেন সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এবং প্রধানমন্ত্রীর সাবেক স্বাস্থ্য উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী।
কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) কর্মসূচির আওতায় বরাদ্দকৃত গম আত্মসাতের অভিযোগ থেকে চলতি মাসেই দায়মুক্তি পেয়েছেন এরশাদের ভাইয়ের ছেলে ও রংপুর-১ আসনের সাংসদ হোসেন মকবুল শাহরিয়ার।
রেলের নিয়োগ-বাণিজ্যে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে কারাবন্দী রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় মহাব্যবস্থাপক ইউসুফ আলী মৃধাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে পাঁচটি মামলা থেকে। ঋণ কেলেঙ্কারির অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি পেয়েছেন সোনালী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী বাহারুল ইসলাম ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিজাম চৌধুরী। হল-মার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই আনেনি দুদক।
চলতি বছর দুদক থেকে আরও দায়মুক্তি পেয়েছেন ফিলিপাইনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মাজেদা রফিকুন্নেসা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর কমিশনার এমদাদুল হক, রেলওয়ের সাবেক মহাপরিচালক আবু তাহের, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইকবাল, পেট্রোবাংলার মহাব্যবস্থাপক আইয়ুব খান চৌধুরী, সাবেক পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন, বিমানের হিসাব তত্ত্বাবধায়ক আবুল কাশেম মো. ফজলুল হক, নওরোজ মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক খলিলুর রহমান, হোসাফ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন প্রমুখ। এ ছাড়া বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) দুর্নীতির অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব (বিপিসির সাবেক চেয়ারম্যান) আবু বকর সিদ্দিক, সাবেক দুই চেয়ারম্যান এ কে এম জাফরউল্লাহ ও মুক্তাদির আলী, ওএসডি অতিরিক্ত সচিব (বিপিসির সাবেক সচিব) আনোয়ারুল করিমসহ সংস্থাটির ১১ জন কর্মকর্তা। অন্যদিকে কমিশনের কাছে অপরাধ স্বীকার করেও দায়মুক্তি পেয়েছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মঞ্জুর আহমেদ ভূঁইয়া ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (ট্রাফিক) পরিদর্শক আবদুর রব।
এর আগে ২০১৩ সালে ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও সাবেক সাংসদ এইচ বি এম ইকবালকে অবৈধ সম্পদ অর্জনের দুটি অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দেয় কমিশন। ২০০১ সালে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে আদমশুমারি প্রকল্পে ৯৪ কোটি টাকা অপব্যবহারের অভিযোগে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের বিরুদ্ধে দুদক অনুসন্ধান শুরু করে ২০০৭ সালে। ২০১৩ সালে এ অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি পান তিনি। একই বছর সাবেক প্রতিমন্ত্রী এ টি এম গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, সাবেক সাংসদ আবদুল কাদের খান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহকারী আবদুল মতিন ও চট্টগ্রামের সাবেক পুলিশ সুপার ইফতেখার আহমেদকেও দায়মুক্তি দেয় দুদক।
ছাড় নেই বিরোধী দলের: ক্ষমতাসীন দলের সদস্য ও সমর্থকেরা একের পর এক ছাড় পেলেও বিরোধী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান বা তদন্তে ছাড় দিচ্ছে না দুদক। এলডিপির চেয়ারম্যান অলি আহমদকে দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে ১৯৯৬ সালের একটি নোটিশের ধারাবাহিকতায় এ বছর সম্পদ বিবরণী দিতে হয়েছে দুদকে। বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ ও তাঁর প্রবাসী ভাই মঞ্জুর আহমদের বিরুদ্ধে গুলশানে বাড়ি দখলের অভিযোগে মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে দুদক। এ ছাড়া বিএনপি নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেন, সাদেক হোসেন খোকা, জমির উদ্দিন সরকার, এম মোর্শেদ খান, মোসাদ্দেক আলী, এহছানুল হক মিলন, এ কে এম মোশাররফ হোসেন, আলী আসগার ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা এবং ইকবাল হাসান মাহমুদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা দুদকের মামলায় লড়ছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তাঁর দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানের বিরুদ্ধেও দুদকের মামলা চলছে। আরাফাত রহমানের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের মামলায় সিঙ্গাপুর থেকে ঘুষের টাকা ফেরত এনেছে দুদক।
তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন নিয়েও প্রশ্ন: দুর্নীতির অভিযোগে এ বছরের শুরুর দিকে পেট্রোবাংলার সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান ড. হোসেন মনসুরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। ৯ মার্চ দুদকের উপপরিচালক আহসান আলীকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। দায়িত্ব পেয়ে আহসান আলী পেট্রোবাংলার অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের নথিপত্র সংগ্রহ এবং ৩৮ কর্মকর্তাকে তলব করেন। এরপর আহসান আলীর কাছ থেকে অনুসন্ধান ক্ষমতা প্রত্যাহার করে তাঁকে কুষ্টিয়ায় বদলি করা হয়। পরবর্তী সময়ে আহসান আলীকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। এরপর ১৩ এপ্রিল সহকারী পরিচালক শেখ আবদুস সালামকে অনুসন্ধান কর্মকর্তার দায়িত্ব দেয় দুদক। অনুসন্ধান শেষে ৭ সেপ্টেম্বর ড. হোসেন মনসুরসহ ১১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন চেয়ে কমিশনের কাছে প্রতিবেদন জমা দেন তিনি। কিন্তু প্রতিবেদনটি আমলে না নিয়ে আরও পর্যালোচনা করে অনুসন্ধান প্রতিবেদন তৈরির নির্দেশনা দিয়ে ২৩ সেপ্টেম্বর অনুসন্ধান কর্মকর্তার কাছে তা ফেরত পাঠায় কমিশন। ৩০ সেপ্টেম্বর দুদকের এক আদেশে আবদুস সালামকে অব্যাহতি দিয়ে উপপরিচালক ঋত্বিক সাহাকে অনুসন্ধান কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
জানতে চাইলে দুদকের কমিশনার মো. শাহাবুদ্দিন বলেন, কমিশন চাইলে যেকোনো সময় কর্মকর্তা বদল করতে পারে এবং নতুন করে অনুসন্ধান বা তদন্তের নির্দেশ দিতে পারে। তবে এভাবে বারবার অনুসন্ধান কর্মকর্তা বদলের বিষয়ে দুদকের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দায়মুক্তি দেওয়ার জন্যই এভাবে বারবার তদন্ত কর্মকর্তার বদল হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.