ঢাকার রাস্তাজুড়ে অবৈধ তোরণ by অরূপ দত্ত ও সামছুর রহমান

রাজপথ বা সড়কে গর্ত করে তোরণ তৈরি অবৈধ হলেও সরকারি দলের নেতারাই তা মানছেন না। ব্যবস্থা নিচ্ছে না সিটি করপোরেশনও। অথচ এর ফলে চলাচলে ভোগান্তিতে পড়ছে রাজধানীবাসী। এবারও ঈদ ও পূজা উপলক্ষে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে প্রচুর তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে। কোনো কোনো তোরণে ব্যানার টানিয়ে রাজনীতিবিদেরা এলাকাবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। অনেক তোরণে কোরবানির পশুর হাটের ব্যানার টানানো হয়েছে। গতকাল সরেজমিনে ঘুরে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ১৯টি তোরণ পাওয়া গেছে। এগুলোর কোনো অনুমোদন নেই।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আনছার আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, তোরণ তৈরির বিষয়ে সিটি করপোরেশন থেকে কখনোই অনুমোদন নেওয়া হয় না। করপোরেশনও কোনো অনুমতি দেয় না। তাই এগুলো সম্পূর্ণ অবৈধ।
আনছার আলী খান বলেন, কোরবানির বর্জ্য অপসারণের পর অবৈধ এসব তোরণ ভাঙার কাজ শুরু করা হবে। তিনি জানান, তোরণ তৈরি নিয়ে একটি আইন করার কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে। সংসদে আইনটি পাস হলে অবৈধ তোরণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বি এ এনামুল হক বলেন, কোনো অনুমতি ছাড়া তোরণ নির্মাণ করে মানুষের সমস্যা বাড়ানো হয়েছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এসব তোরণ উচ্ছেদ করা হবে।
পুরান ঢাকার দয়াগঞ্জ চৌরাস্তার মোড়ে বিশাল এক তোরণ করা হয়েছিল ঈদুল আজহার অনেক আগেই। সেখানে এখন ‘ঐতিহ্যবাহী ধোলাইখাল হাট’-এর ব্যানার টানানো আছে। ব্যানারে হাটের ইজারাদার হিসেবে নাম আছে মোহাম্মদ আলীর। মোহাম্মদ আলী দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সভাপতি এবং আওয়ামী লীগের সূত্রাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত সহসভাপতি। ব্যানারে হাট পরিচালনায় নাম আছে নিজাম উদ্দিন নিজামসহ ২৪ জনের। নিজাম উদ্দিন ৪৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি। বাকিরা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের স্থানীয় নেতা।
তোরণ তৈরির জন্য সিটি করপোরেশনের অনুমতি নেওয়া হয়েছে কি না, জানতে চাইলে ইজারাদার মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, হাটের ইজারা পাওয়ার অর্থ হলো তোরণ তৈরিরও অনুমোদন পাওয়া। আলাদা অনুমতির প্রয়োজন নেই।
গোপীবাগ বালুর মাঠের চারপাশে কোরবানির হাটের চারটি তোরণ করা হয়েছে। এর একটি মতিঝিল মধুমিতা সিনেমার পাশে, একটি ব্রাদার্স ক্লাবের পাশে এবং বাকি দুটি কমলাপুর প্রান্তে। গোপীবাগের কয়েকজন বাসিন্দা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অতীতে কখনো ব্রাদার্স ক্লাব মাঠে হাটের গরু রাখা হয়নি। এবার মাঠে হাটের গরু রাখায় নামাজ আদায় করা যায়নি। এন এস নামের একটি প্রতিষ্ঠান এই হাটের ইজারাদার। প্রতিষ্ঠানটির মালিক মো. নাসির দেশের বাইরে থাকেন। তাঁর পক্ষের কাউকে গতকাল পাওয়া যায়নি। আবার গত জুন থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত খামারবাড়ি মোড়ে বানানো এক তোরণে বিভিন্ন উপলক্ষে শুধু লেখা বদলানো হয়েছিল। গত মাসের শুরুতে তোরণটি সরিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু কয়েক দিন না যেতেই একই স্থানে গত মাসের শেষের দিকে দুর্গাপূজার শুভেচ্ছা জানিয়ে বিশাল এক তোরণ বসানো হয়। গতকাল এতে দেখা যায় ঈদুল আজহার শুভেচ্ছাসংবলিত ব্যানার। রঙিন কাপড়ে বানানো তোরণটিতে লেখা রয়েছে ‘সৌজন্যে: মনি সিং। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, সমাজসেবক এবং ২৭ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা’। গতকাল ফোনে তাঁকে পাওয়া যায়নি।
তবে এই এলাকার সাংসদ, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘মনি সিং এই এলাকায় ব্যবসা করে। সে এলাকাবাসীকে পূজা ও ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছিল। আমি বলে দিব আজকের মধ্যে সরিয়ে নিতে।’
পলাশী মোড়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অস্থায়ী বাজারের সামনে নির্মাণ করা হয়েছে আরেকটি তোরণ। এখানে আরেকটি তোরণ প্রায় চার বছর ছিল। গত ২৫ আগস্ট প্রথম আলোতে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নড়বড়ে তোরণটি ভেঙে ফেলে। নতুন করে তোরণটি বানানো হয়েছে গত মাসের শেষের দিকে। তোরণটি বসিয়েছেন হাটের ঠিকাদার শেখ মোহম্মদ আলমগীর।
ইডেন কলেজের মূল ফটকের সামনে আছে একটি তোরণ। এর বাশঁগুলো বাঁকা হয়ে আছে। লাগানো ব্যানারগুলো ছিন্নভিন্ন। যেকোনো সময় ভেঙে পড়ে ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। এ ছাড়া আজিমপুর বাসস্ট্যান্ডের চৌরাস্তার প্রতিটিতেই একটি করে তোরণ দেখা গেছে। এর মধ্যে একটি হাটের তোরণ। বাকি তিনটিতে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের নামে ব্যানার লাগানো রয়েছে। ১৫ আগস্ট শোক দিবসের বাণী এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচারের দাবি জানিয়ে লাগানো ব্যানারগুলো জায়গায় জায়গায় ছিঁড়ে গেছে।

রাজধানীর দৈনিক বাংলা মোড়ে ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এ কে এম মমিনুল হক সাইদের বসানো তোরণটি স্থায়ী হয়ে গেছে। বিভিন্ন উপলক্ষে তোরণটির লেখা, ব্যানার পরিবর্তন করা হয়। গতকাল বুধবার সরেজমিন দেখা যায়, তোরণটিতে ঈদুল আজহা ও দুর্গাপূজার শুভেচ্ছা পাশাপাশি লাগানো। তোরণটির কারণে রাস্তার প্রস্থ কমে যাওয়ায় যান চলাচল ধীর হয়ে পড়ছে।
খিলগাঁও-গুলিস্তান রুটে চলাচলকারী লেগুনার চালক মো. ইব্রাহিম বলেন, ‘এটা তো অনেক দিন ধইরা। কী লেখা থাকে তা তো দেখি না। এইটার জন্য গাড়ি এই রাস্তায় ঢুকাইতে সমস্যা হয়।’ গতকাল মমিনুল হক সাইদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় বারবার। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি।
জুরাইন রেলগেট-সংলগ্ন প্রধান সড়কের দুই পাশের বৈদ্যুতিক খুঁটির ওপর বাঁশ ও কাঠ দিয়ে নতুন ধরনের তোরণ করা হয়েছে। বৈদ্যুতিক খুঁটির ওপর হওয়ায় এটি ঝুঁকিপূর্ণও। ঈদুল আজহার আগে এখানে বিশাল ব্যানার টানানো হয়েছে। লেখা আছে, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুর কন্যা, জননেত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে প্রিয় এলাকাবাসীকে পবিত্র ঈদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন’। অভিনন্দন জানিয়েছেন সাংসদ এবং শ্যামপুর ও কদমতলী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সানজিদা খানম।
যোগাযোগ করা হলে গতকাল সাংসদ সানজিদা খানম প্রথম আলোকে বলেন, যে অর্থে তোরণ বলা হয়, এটা সে ধরনের তোরণ না। এটা রেলগেটের পাশে স্থায়ী একটি স্থাপনার মতো। আগে মাদারীপুরের চেয়ারম্যান এটা করেছিলেন। বিভিন্ন উপলক্ষে এখানে ব্যানার টানানো হয় এবং খুলে ফেলা হয়। তিনি বলেন, প্রতিবছরই বাঁশ দিয়ে আলাদা তোরণ করা হয়, এবার তিনি তা করেননি।
শ্যামলী বাসস্ট্যান্ড, আদাবর থানার সামনে, মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদের র্যাব-২ ব্যাটালিয়ন কার্যালয়ের সামনে, কলেজ গেটে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের উল্টো পাশে আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের নামে একটি করে তোরণ বসানো রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.