বিদায় ভাষা–মতিন -মহান সংগ্রামীকে সশ্রদ্ধ অভিবাদন

নিষ্কলুষ জীবন পার করে প্রয়াণ করলেন আগুয়ান ভাষাসংগ্রামী ও মুক্তিকামী রাজনীতিক আবদুল মতিন। বার্ধক্য তাঁকে পরাজিত করলেও আমৃত্যু তাঁর মনোবল ছিল অটুট। জীবনের মতো মৃত্যুতেও তিনি ত্যাগের নিষ্ঠা দেখিয়ে গিয়েছেন। দৃষ্টিহীনদের জন্য চোখ আর চিকিৎসা-গবেষণার জন্য মরণোত্তর দেহ দান করে জীবনের মতো মরণেও মহান হয়ে রইলেন তিনি।
আবদুল মতিনের জন্ম ১৯২৬ সালে। ১৯৫২ সালে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন তিনি। ভাষার অধিকারের জন্য বাঙালির সেই ঐতিহাসিক আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল নেতৃস্থানীয়। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রযন্ত্রের ১৪৪ ধারা ভঙ্গেরও অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। ভাষা আন্দোলনের মর্মে যে জাতীয় স্বাধীনতা ও সাম্যের আকাঙ্ক্ষা ছিল, পরের জীবনে তিনি তার জন্য নিষ্ঠাভরে লড়াই করে গেছেন। স্বাধীনতার আগে ছিলেন মওলানা ভাসানীর সহচর, কৃষক আন্দোলনের নেতা। কারাবাস সয়েছেন, সয়েছেন নিপীড়ন-নির্যাতন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তিনি। এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তাঁর বাবা ও এক ভাইকে হত্যা করেছে। স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়েও তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে নানা সমালোচনা ও বিতর্ক রয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তিনি নিয়োজিত হন সমাজতন্ত্রের সংগ্রামে; হয়ে ওঠেন কৃষককেন্দ্রিক সাম্যবাদী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। আমৃত্যু যেখানেই শোষণ-নির্যাতন দেখেছেন, সেখানেই গণমানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর লেখা, বক্তৃতা ও জীবনাচরণে সুবিধাবাদ ও অহংকারের লেশমাত্র ছিল না। বাংলাদেশ তাঁর অবদান চিরভাস্বর করে রাখবে—এটাই আজকের প্রত্যাশা।
সংগ্রামী আবদুল মতিন ছিলেন কৃষকের সন্তান। ছাত্রজীবনে তিনি হন প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ নেতা। এরই পরের ধাপে তিনি কৃষক সংগ্রামের নেতা হয়ে ওঠেন। জনমানুষের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন ‘ভাষা–মতিন’। তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীদের অনেকেই যখন ভ্রান্তি আর আপসের চোরাবালিতে নিমজ্জিত হচ্ছেন, তখনো তিনি আপন নীতি ও আদর্শে অবিচল থেকেছেন। অভাব ও দুঃখভোগ ছিল তাঁর জীবনসঙ্গী; অথচ আমৃত্যু তিনি ছিলেন আশাবাদের প্রেরণা।
আবদুল মতিনের উজ্জ্বল ও ব্যতিক্রমী জীবনসাধনা নতুন প্রজন্মের কাছে নিত্য প্রেরণা হয়ে উঠুক, আগামীর বাংলাদেশে তাঁর স্মৃতি অম্লান থাকুক; বিদায়কালে এই ভাষাসংগ্রামীর প্রতি আমরা জানাই শ্রদ্ধাবনত অভিবাদন।

No comments

Powered by Blogger.