তিন মেয়েসহ মাকে পুড়িয়ে হত্যা -বিয়েতে রাজি না হওয়ায় বখাটের আক্রোশ!

‘বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে ঘর থেকে ছুটে গিয়ে দেখি, ওই বাড়ির বারান্দায় আগুন জ্বলছে। অন্যদের সঙ্গে আগুন নেভাতে লেগে যাই। কিন্তু পানি দিতেই আরও জ্বলে ওঠে। বালু ফেলে আগুন নেভানোর পর দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে দেখি, বিছানার ওপর চারটি পোড়া লাশ।’
টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলায় তিন মেয়েসহ এক মাকে নৃশংসভাবে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার একটি দৃশ্যের এ রকম বর্ণনাই দেন মো. মনিরসহ আরও কয়েকজন প্রতিবেশী। মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি না হওয়ায় এক বখাটের ক্ষোভের আগুনে এভাবেই প্রাণ দিতে হলো একই পরিবারের চার সদস্যকে। ঘরের ভেতর পেট্রলের আগুনে ঘুমন্ত মানুষগুলোকে পুড়িয়ে মেরেছে সে।
পবিত্র ঈদুল আজহার দিন গত সোমবার দিবাগত রাতে এ হত্যার ঘটনা ঘটে উপজেলার সোহাগপাড়া গ্রামে। নিহত ব্যক্তিরা হলেন মালয়েশিয়াপ্রবাসী মজিবর রহমানের স্ত্রী হাসনা বেগম (৩৫) এবং তাঁর তিন মেয়ে উপজেলার সোহাগপুর উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী মনিরা আক্তার (১৪), বাক্প্রতিবন্ধী মীম আক্তার (১০) ও স্থানীয় ব্র্যাক স্কুলের নার্সারি শ্রেণির শিক্ষার্থী মলি আক্তার (৭)।
পুলিশ ও এলাকাবাসীর ভাষ্য, সোমবার দিবাগত রাতে মেয়েদের নিয়ে একতলা বাড়ির একটি কক্ষে ঘুমিয়ে ছিলেন হাসনা বেগম। রাত সাড়ে তিনটার দিকে এক বিকট শব্দ শুনতে পান প্রতিবেশীরা। যে যাঁর মতো বাইরে বেরিয়ে দেখেন হাসনাদের বাড়ির বারান্দায় আগুন জ্বলছে। যে কক্ষের সামনে আগুন জ্বলছিল, সেটির পাশেই আরেক কক্ষে ঘুমাচ্ছিলেন মজিবর রহমানের বাবা চান মিয়া ফকির (৭০) ও মা জবা খাতুন (৬০)। বিকট শব্দ আর এর পরপরই দরজার নিচ দিয়ে নিজেদের কক্ষে আগুন ঢুকতে দেখে তাঁরাও বাইরে বেরিয়ে আসেন। বেঁচে যান প্রাণে। ছুটে আসেন আশপাশের অনেকে। পানি ও বালু দিয়ে আগুন নেভান তাঁরা।

>>এই খাটেই ঘুমিয়ে ছিলেন তিন সন্তানসহ মা হাসনা বেগম। গতকাল সকালে তোলা ছবি l প্রথম আলো
আগুন নেভার পর দেখা যায়, হাসনা বেগম ও তাঁর মেয়েরা যে কক্ষে ঘুমিয়ে ছিলেন, সেটার দরজা ভেতর ও বাইরে থেকে লাগানো। এতে এলাকাবাসী দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে দেখেন, বিছানার ওপর পড়ে আছে চারজনের পুড়ে যাওয়া লাশ। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশগুলো উদ্ধার করেন।
গোড়াই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আদিলুর রহমান ও নিহত হাসনা বেগমের মামা হায়দার আলী বলেন, আগুন লাগানোর আগে সংশ্লিষ্ট কক্ষের দরজার সামনে কাদামাটি ও ইটের খোয়া দিয়ে বেড়ার মতো তৈরি করা হয়েছিল। এরপর কক্ষের ভেতর পেট্রল ঢেলে আগুন দেওয়া হয়।
হত্যার নেপথ্যে: নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী মনিরা আক্তারকে একই গ্রামের বাহার উদ্দিনের ছেলে ও সিঙ্গাপুরপ্রবাসী জাহাঙ্গীর আলম সম্প্রতি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু এ প্রস্তাবে রাজি হননি মনিরার মা। এতে ক্ষুব্ধ ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে জাহাঙ্গীর আলম সহযোগীদের নিয়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন পরিবারের অন্য সদস্য ও প্রতিবেশীরা।
নিহত হাসনার শ্বশুর চান মিয়া ফকির বলেন, তাঁর নাতনি মনিরার বয়স যখন সাত বছর, তখন জাহাঙ্গীর হোসেনের সঙ্গে পারিবারিকভাবে তার বিয়ের কথা হয়েছিল। দুজনের মধ্যে আংটিও বদল হয়। তবে প্রায় দেড় বছর আগে জাহাঙ্গীর বিদেশে থাকাকালীন মনিরা গ্রামের একটি গানের অনুষ্ঠান দেখতে যায়। ওই খবরে সে সিঙ্গাপুর থেকে বাড়িতে ফোন করে বকাঝকা করে। এ ঘটনায় বিয়ে দেওয়ার বিষয়টি আর না এগিয়ে বরং ভেঙে যায়। ১০ মাস আগে জাহাঙ্গীর দেশে ফিরলে বসে গ্রাম্য সালিস। তাতে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে মনিরার বিয়ে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর জাহাঙ্গীর সিঙ্গাপুর গিয়ে দুই মাস পর আবার দেশে ফেরে। আবারও মনিরাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় সে। কিন্তু তাতে মনিরার মা রাজি না হলে জাহাঙ্গীর পরিবারটির ওপর বিভিন্নভাবে অত্যাচার শুরু করে।
প্রতিবেশী আবদুস ছবুর ও মনির হোসেন বলেন, সপ্তাহ খানেক আগে জাহাঙ্গীর মনিরার মায়ের গলা চেপে ধরেছিল।
মনিরার মামা মো. মোফাজ্জল হোসেনের অভিযোগ, বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর থেকে জাহাঙ্গীর মনিরাকে উত্ত্যক্ত করা শুরু করে। তাই মনিরাকে একই গ্রামে নানার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ঈদ উপলক্ষে মনিরা দাদার বাড়ি এসেছিল। আর এ আসাই সবার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল।
পূর্ব প্রস্তুতি নিয়েছিল জাহাঙ্গীর: টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (দক্ষিণ) পংকজ চন্দ্র রায়ের ভাষ্য অনুযায়ী, জাহাঙ্গীর সোমবার রাত নয়টার দিকে একটি পেট্রলপাম্প থেকে দুটি কনটেইনারে দাহ্য পদার্থ নেয়। এগুলো বহনে সে ২০০ টাকায় রিকশা ভাড়া করে। ঘটনাস্থল থেকে কনটেইনারের দুটি ঢাকনা ও জাহাঙ্গীরদের বাড়ির রান্নাঘর থেকে আরও দুটি কনটেইনার উদ্ধার করা হয়েছে।
গ্রেপ্তার ১, আটক ২: হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার সন্দেহে পুলিশ জাহাঙ্গীরের ছোট ভাই হানিফ মিয়াকে (২২) গত মঙ্গলবার রাতে মির্জাপুরের ইন্নত খাঁ চালা গ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করেছে। এ ছাড়া পেট্রল আনার কাজে ব্যবহৃত রিকশাটির চালক আলী হোসেন ছাড়াও জাহাঙ্গীরের চাচি নাছিমা বেগমকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে পুলিশ।
এদিকে নিহত হাসনা বেগমের ভাই মো. মোফাজ্জল হোসেন বাদী হয়ে মঙ্গলবার রাতে মির্জাপুর থানায় মামলা করেছেন। মামলায় জাহাঙ্গীর আলমসহ ১০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
এলাকায় শোকের ছায়া: হত্যার ঘটনাটিতে সোহাগপাড়া গ্রামসহ আশপাশের এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া। গতকাল বুধবারও অনেককে ঘটনাস্থলে জড়ো হতে দেখা যায়। তাঁরা সান্ত্বনা দিচ্ছেন নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের। স্ত্রী ও তিন মেয়েকে হারিয়ে মজিবর শোকে পাথর হয়ে গেছেন। স্ত্রী ও মেয়েরা অসুস্থ—এ কথা বলে তাঁকে দেশে আনা হয়। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে মালয়েশিয়া থেকে ঢাকায় পৌঁছান তিনি। রাত দুইটার দিকে গ্রামের বাড়ি এসে স্ত্রী-সন্তানদের নিহত হওয়ার খবর পেয়েই তিনি জ্ঞান হারান।
মঙ্গলবার সকালে স্থানীয় সাবেক সাংসদ আবুল কালাম আজাদ সিদ্দিকী, দুপুরে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ঘটনাস্থলে যান। তাঁরা এ হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন।
পলাতক জাহাঙ্গীরের পুরো পরিবার: ঘটনার পর থেকেই পলাতক রয়েছেন জাহাঙ্গীরের পরিবারের সদস্যরা। তাঁর চার চাচার ঘরও তালাবদ্ধ। মঙ্গলবার সকাল থেকে বাড়িগুলোতে বসানো হয়েছে পুলিশের পাহারা।
ওদিকে মির্জাপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শ্যামল কুমার দত্ত জানান, নিহত ব্যক্তিদের লাশ ময়নাতদন্ত শেষে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। জানাজা শেষে বাড়ির পাশেই তাঁদের দাফন করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.