আইএসের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই by শেখ মোহাম্মেদ বিন রশিদ আল মাকতুম

বৈশ্বিক আর্থিক সংকট আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, সারা দুনিয়ার অর্থনীতি কীভাবে পরস্পর সম্পর্কিত। আর বর্তমান এই চরমপন্থার সংকটের কালে আমাদের এটা বুঝতে হবে যে আমার নিরাপত্তাও পরস্পর নির্ভরশীল। আইএস পরাজিত করার সংগ্রামে এটা এখন দিবালোকের মতো পরিষ্কার।
এই ব্যাপার বুঝতে আমাদের যেন চরম মূল্য দিতে না হয়, আইএস যেন সেই সুযোগ না পায়। আমাদের এটাও অনুধাবন করতে হবে যে চরমপন্থার আগুন আমরা কেউই এককভাবে নেভাতে পারব না। যে আদর্শের কারণে চরমপন্থার বাড়বাড়ন্ত হয়, সেটা মোকাবিলায় দুনিয়ার দেশগুলোকে একত্র হতে হবে। আর যে মানুষেরা এই দলগুলোতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, তাদের জীবনের আশা ও মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে হবে।

আইএস মোকাবিলায় যে আন্তর্জাতিক ঐক্য গড়ে উঠেছে, তাদের কাছে আইএস নিশ্চিতভাবে পরাজিত হবে। সংযুক্ত আরব আমিরাত এতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে। কিন্তু সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে এই সমস্যার আংশিক সমাধান করা যেতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে আরও তিনটি ব্যাপার নিশ্চিত করতে হবে: চিন্তার যুদ্ধে জয়লাভ, দুর্বল শাসনের উন্নতি ঘটানো এবং তৃণমূলে মানবীয় উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ।
এ রকম একটি সমাধান পেতে হলে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর উচিত হবে একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানো। উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার একজন রাজনীতিকও মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাপ্রবাহের দিকে চোখ বন্ধ করে থাকতে পারেন না। বৈশ্বিক হুমকি মোকাবিলায় বৈশ্বিক সাড়া প্রয়োজন। এ আগুনের আঁচ সবার গায়েই লাগবে, কারণ আগুন কোনো সীমানা মানে না। আইএস প্রায় ৮০টি দেশের নাগরিকদের দলে ভিড়িয়েছে।
আইএস একটি বর্বরোচিত ও নিষ্ঠুর সংগঠন। তারা ইসলাম ও মানবতার সবচেয়ে মৌলিক মূল্যবোধেরও তোয়াক্কা করে না। তথাপি, যারা তাদের বিরোধিতা করছে, সংগঠনটি তাদের প্রতিহত করে যাচ্ছে। আমরা শুধু একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের মোকাবিলা করছি না। তারা একটি হানিকর আদর্শের মূর্ত প্রকাশ, সেটাও আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পরাজিত করতে হবে।
আমি মনে করি, আগামী দশকে এই আদর্শ দুনিয়ার সামনে সবচেয়ে বড় বিপদ হিসেবে আবির্ভূত হবে। ইউরোপ, এশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, এশিয়াসহ সব জায়গাতেই এর বীজ বপন হয়েছে। এরা ধর্মের বিকৃতি ঘটিয়েছে, ঘৃণার প্রতিমূর্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে সংগঠনটি। ফলে যেকোনো সন্ত্রাসী সংগঠনই এটা গ্রহণ করতে পারে। তারা হাজার হাজার মরিয়া, প্রতিশোধপরায়ণ ও ক্রুদ্ধ তরুণ জড়ো করে সভ্যতার মূলে কুঠারাঘাত করতে পারে।
আইএসের আদর্শের সঙ্গে আল-কায়েদা ও নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সোমালিয়া, ইয়েমেন, উত্তর আফ্রিকা ও আরব উপসাগরীয় অঞ্চলে এর সহযোগী সংগঠনগুলোর আদর্শের মিল রয়েছে। আমার কাছে সবচেয়ে উদ্বেগজনক ব্যাপার হচ্ছে, এই এক দশক আগেই এ রকম একটি আদর্শে বলীয়ান হয়ে আল-কায়েদা আদিম কায়দায় আফগানিস্তানের গুহা থেকে সারা দুনিয়াটাই অস্থির করে তুলেছিল। আর আজ আইএসের নেতৃত্বে তার অনুগামীদের হাতে প্রযুক্তি, অর্থ, বিপুল পরিমাণ ভূমি ও একটি আন্তর্জাতিক জিহাদি নেটওয়ার্ক রয়েছে। পরাজিত হওয়ার চেয়ে এই ক্রোধ ও ঘৃণানির্ভর আদর্শ আরও শক্তিশালী হয়েছে। সেটা আরও ক্ষতিকর হয়েছে, আরও ছড়িয়ে পড়েছে।
এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে গুঁড়িয়ে দিলেই দীর্ঘস্থায়ী শান্তি নিশ্চিত হবে না। আমাদের এই আদর্শের ভিত্তিমূলে আঘাত করতে হবে, যার মাধ্যমে এই অসহায়, আশাহীন ও বেপরোয়া মানুষের মাধ্যমে যাতে এই আদর্শ মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আর সেটা করতে হলে আমাদের ইতিবাচক হতে হবে।
এর সমাধানের তিনটি দিক আছে। প্রথমত, আলোকিত চিন্তার মাধ্যমে এই হানিকর চিন্তা পরাজিত করতে হবে। তার সঙ্গে লাগবে মুক্ত মন, সহনশীলতা ও গ্রহণযোগ্যতা। আমাদের ইসলাম ধর্মেই এই অ্যাপ্রোচ রয়েছে। এই ধর্মে রয়েছে শান্তির আহ্বান; জীবনের প্রতি সম্মান, মূল্যবোধ, মানবীয় বিকাশের পথ প্রশস্তকরণ এবং অন্যের ভালো করার নির্দেশনা আছে এতে।
আইএসের হয়ে আত্মঘাতী বোমা হামলা করা থেকে তরুণদের বিরত রাখতে পারে একটি জিনিস: একটি শক্তিশালী আদর্শ, যা তাঁকে সঠিক পথে পরিচালনা করবে এবং তাঁকে এটা বোঝাবে যে আল্লাহ আমাদের দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন এর উন্নতির জন্য, ধ্বংসের জন্য নয়। মনের এই যুদ্ধে চিন্তক ও বুদ্ধিজীবীদেরই নেতৃত্ব দিতে হবে।
দ্বিতীয়ত, জনগণকে ভালো সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে স্থিতিশীল প্রতিষ্ঠান নির্মাণে সরকারকে সহায়তা করতে হবে। সিরিয়া ও ইরাকে আইএসের উত্থানের পেছনে যে দেশ দুটির সরকারের ব্যর্থতা রয়েছে, সেটা বুঝতে হবে। সিরিয়া নিজের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়েছে আর ইরাক গোষ্ঠীগত বিভাজন উসকে দিয়েছে। সরকার অস্থিতিশীলতা মোকাবিলা করতে না পারলে জনগণের মনে ক্ষোভ-বিক্ষোভ তৈরি হয়, গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে সরকার। এ পরিবেশে ঘৃণাভিত্তিক আদর্শের জন্ম হয়। ফলে সন্ত্রাসী সংগঠন এই শূন্য স্থান দখল করে নেয়।
মানবীয় বিকাশে কিছু কালো গহ্বর রয়েছে, মধ্যপ্রাচ্য এর জেরে জেরবার হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি অনতিবিলম্বে আমলে নিতে হবে। এটা শুধু আরবের নয়, সারা দুনিয়ার কর্তব্য। কারণ, এই অঞ্চলের তৃণমূলের মানুষের ভালো সেবা দেওয়া গেলে বা তাদের জীবনমান উন্নত করা গেলে তা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সমস্যা নিরসন করবে। অস্থিতিশীলতা ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত কমবে। দারিদ্র্য দূরীকরণে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প ও উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে হবে। অবকাঠামো নির্মাণ এবং অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা তৈরি করতে হবে। টেকসই উন্নয়নই হচ্ছে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার সবচেয়ে টেকসই পন্থা।
আমাদের অঞ্চলে প্রায় ২০০ মিলিয়ন তরুণের বসবাস। এই মানুষের জীবনে আশার সঞ্চার করে তাদের উজ্জীবিত করতে হবে। তাদের শক্তির ব্যবহার করতে হবে তাদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে, তাদের আশপাশের মানুষের জন্যও। আমরা ব্যর্থ হলে তাদের জীবন শূন্যতায় পর্যবসিত হবে; বেকারত্ব ও সন্ত্রাসবাদের হানিকর আদর্শের পঙ্কিলতায় তারা মুখ থুবড়ে পড়বে।
আমরা যদি অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে আমাদের দৈনন্দিন যাত্রায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও মানুষের জীবনমান উন্নতকরণে এগিয়ে যাই, তাহলে আশাহীনতা থেকে যে ভীতি ও ঘৃণার আদর্শের জন্ম হয়, সেটা আমরা প্রতিহত করতে পারব। সন্ত্রাসবাদ তৈরি হওয়ার কারণ দূর করতে পারলে এর জন্ম প্রতিহত করা সম্ভব হবে।
আমি আশাবাদী। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের জীবনে আশা আছে, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার আকাঙ্ক্ষা আছে। সেটা সুবিধাবাদী ও ধ্বংসাত্মক চিন্তার চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী। উন্নত জীবনের আশার চেয়ে শক্তিশালী কিছু থাকতে পারে না।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
শেখ মোহাম্মেদ বিন রশিদ আল মাকতুম: সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী।

No comments

Powered by Blogger.