মোদির আমেরিকা সফর কি ফপ? by মাসুম বিল্লাহ

ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু ১৯৪৯ সালে যখন আমেরিকা সফরে গিয়েছিলেন তিনি তখন কয়েক সপ্তাহ নিয়ে দেশটির এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত সফর করেন। তখন তিনি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য রাখেন এবং আলবার্ট আইনস্টাইনের সাথে দেখা করেন। আমেরিকার সব কিছু বাণিজ্যিকীকরণ দেখে তিনি বেশ হতাশ হন। তখন তিনি কৌতুক করে বলেছিলেন, ‘কারোই প্রথমবার আমেরিকা সফর করা উচিত নয়।’

ভারতীয় রাজনীতির নতুন জায়ান্ট নরেন্দ্র মোদির প্রথম আমেরিকা সফরে নেহরুর মতো তেমন কোনো বৈচিত্র্য ছিল না। জাতিসঙ্ঘের নির্ধারিত অনুষ্ঠানসূচির বাইরে তিনি কেবল কয়েকজন রাজনীতিক ও প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাথে সাক্ষাৎ করেন। অবশ্য এর আগে তিনি ওয়ালস্ট্রিটের কয়েকজন ব্যবসায়ী নেতা ও নিউ ইয়র্কের মেডিসন গার্ডেনে প্রায় ১৮ হাজার ভারতীয়ের অংশগ্রহণে একটি সমাবেশে যোগ দেন। সমাবেশটি অবশ্য ছিল বেশ জমকালো। বিশাল স্ক্রিনে প্রদর্শন, ফুরেসেন্ট পোশাকে সজ্জিত নর্তক-নর্তকী দলের রকগান ‘বর্ন ইন ইউএসএ’। ভারতীয়দের আয়োজনে এসব পরিবেশনা আমেরিকানরা একটি ব্যঙ্গ টেলিভিশন শোর উপস্থাপক জন স্টুয়ার্টকে বেশ মুগ্ধ করে। তার ভাষায়, ‘সম্ভবত বার্লুসকোনির বুঙ্গা-বুঙ্গা পার্টি ছাড়া বিশ্বের আর কোনো নেতা এত বেশিসংখ্যক আমেরিকানকে আর কোনো কিছুর জন্য এতটা আকৃষ্ট করতে পারেননি।’
নেহরুর সময় থেকেই ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক কখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক ছিল না। গত মে মাসে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে মোদির প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গার পর মোদির বিরুদ্ধে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ওই দাঙ্গায় কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়, যাদের বেশির ভাগ ছিল মুসলমান। মোদি তখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তার বিরুদ্ধে দাঙ্গায় উসকানি দেয়া ও দাঙ্গা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়ার অভিযোগ ওঠে। এটা ছিল মার্কিন কর্মকর্তাদের মূল্যায়ন। এখন মোদি রাষ্ট্রপ্রধান। তাই তার ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞার আইন কার্যকর হবে না।
গত ডিসেম্বরে নিউ ইয়র্কে ভারতীয় কূটনীতিক দেবজানিকে গ্রেফতার নিয়ে দুই দেশের সম্পর্কে তিক্ততা দেখা দেয়। গত জুলাইয়ে ভারত নতুন বিশ্ববাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরে অস্বীকার করে। ওই চুক্তির পক্ষে ছিল যুক্তরাষ্ট্র। দুই দেশের সামরিক সম্পর্ক কিছুটা উষ্ণ হলেও রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ওয়াশিংটন-দিল্লি সম্পর্কে নতুন করে টানাপড়েন দেখা দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে মোদির সফর এবং এ নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা ভারতে ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করে। এই সফর পরিকল্পনার বড় অংশ ছিল আমেরিকার রাজনীতিকদের মধ্যে তার সুনামকে ছড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা। মোদি যুক্তরাষ্ট্রে তার ক্যারিশমা দেখানোর চেষ্টা করেন নানাভাবে। তাই তিনি নিউ ইয়র্কের সমাবেশে বলেন, ‘আপনারা আমাকে যে ভালোবাসা দিয়েছেন। এ ধরনের ভালোবাসা আগে কোনো ভারতীয় নেতার কপালে জোটেনি।’
তবে অনেকের মধ্যে অন্তত প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা একজন পরিবর্তিত মানুষ হিসেবে মোদিকে গ্রহণের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। তারা দু’জন একসাথে ক্যাপিটল হিলে মার্টিন লুথার কিংয়ের স্মৃতিস্তম্ভ পরিদর্শনে যান। অথচ মাত্র কয়েক বছর আগেই এ ধরনের ঘটনা কল্পনাও করা যেত না। একজন বাণিজ্যবান্ধব ব্যক্তি হিসেবে রিপাবলিকানদের কাছেও মোদি কম সমাদৃত নন।
ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক সুদৃঢ় করার যে মিশন নিয়ে মোদি যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান, সেটা কতটা সফল হয়েছে তা অন্য বিষয়। কিন্তু সফরকালে বড় ধরনের কোনো চুক্তি স্বাক্ষর হয়নি। ভারতের শ্রমঘন শিল্পগুলোকে সাহায্য করার মতো তেমন কিছুই নেই মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর। অথচ লাখ লাখ ভারতীয় তরুণের কর্মসংস্থানের জন্য এখানকার শিল্প খাতের উন্নয়ন জরুরি। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন কোম্পানির জন্য হয়তো ভারত বিনিয়োগের ক্ষেত্র হতে পারে, মোদি সম্ভবত এই বিশেষ ক্ষেত্রটিকে উপেক্ষা করছেন। এশিয়ার এমন একটি প্রতিষ্ঠান যাদের হাজার হাজার কর্মী ছড়িয়ে আছে সারা বিশ্বে, তার কর্তাব্যক্তিটি মোদির সাথে বৈঠকে বসতে অস্বীকৃতি জানান।
এখন পর্যন্ত মোদির দর্শন হলো, দোদুল্যমান মন নিয়ে গগনচুম্বী প্রত্যাশা পূরণের জন্য এগিয়ে যাওয়া। এর বিপদ অনেক। ১৯৪৯ সালে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বক্তৃতায় নেহরু এ ব্যাপারে বলেছিলেন, ‘দরিদ্রের প্রত্যাশা পূরণ করা না হলে হতাশার বিস্তার ঘটে অথবা শুরু হয় বিপ্লবের ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়া।’
(ইকোনমিস্ট থেকে)

No comments

Powered by Blogger.